ঝড়ের স্মৃতি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঝড় নিয়ে প্রায় সব স্মৃতিই আমার মনে দাগ কেটে আছে। ঝড়কে নিয়ে প্রথম স্মৃতিটা একটু অন্য রকমের। গ্রাম এলাকায় বিশেষ করে চর এলাকায় যেখানে সভ্যতার ছোঁয়া সেভাবে লাগেনি, সেখানে সব ঘটনার সঙ্গেই সৃষ্টিকর্তার সরাসরি যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা চলত। আর ঝড়কে দেখা হতো সৃষ্টিকর্তার রাগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। তাই ঝড় এলে সবাই যখন সবকিছু গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যেত তখন আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হতো আজানের? ঝড় শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কোনো সদস্য বলতেন ইয়াকুব আজান দাও। আমি তখন দুই হাত দিয়ে ভালো করে দুই কান বন্ধ করে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আজান দিতাম। গ্রামে বেশির ভাগ বিশ্বাস করতেন যত বেশি জোরে চিৎকার করে আজান দেওয়া যাবে সৃষ্টিকর্তা তত দ্রুত শুনবেন ও ঝড় বন্ধ করবেন। ঝড় অবশ্য সহসাই বন্ধ হয়ে যেত না। সৃষ্টিকর্তার আক্রোশ না মেটা পর্যন্ত উনি পৃথিবীর বুকে তার ক্ষমতা দেখাতেন, তারপর একসময় ঝড় বন্ধ হয়ে যেত।

মৌসুমের প্রথম ঝড় আসত হঠাৎ করেই। তাই প্রথম ঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ হতো বেশি। এর মধ্যে ঘরবাড়ি উলটে যাওয়া ছিল অন্যতম। মানুষ যেহেতু কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারত না, তাই ঝড় আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষেরা লেগে যেতেন ঘরে পেলা (ঠেকনা) দেওয়ার কাজে। যে যা হাতের কাছে পেতেন তাই দিয়ে ঝড়ের বাতাসের গতির বিপরীত দিকে পেলা দিতেন। মই, কাঠের খুঁটি, বাঁশের খুঁটি ইত্যাদি দিয়েও পেলা দেওয়া হতো। একবারের কথা খুব বেশি করে মনে আছে। ঝড় আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি বাইরের খানকা (বৈঠক) ঘরের জানালা বন্ধ করতে গেছি। জানালাটা যেই না বন্ধ করেছি অমনি সশব্দে সারা ঘরটা কেঁপে উঠল আর কাত হতে শুরু করল। আমি ভয় পেয়ে দ্রুত খাটের তলায় গেলাম। ওদিকে শুনি বাইরে আমার দাদি চিৎকার করছেন—হায় হায়রে আমার ইয়াকুব। তোরা কে কোথায় আছিস আমার ইয়াকুবকে বাঁচা। সবাই দ্রুত এসে হাজির। আমি ভেতর থেকেই সবার চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিলাম।

খাটের তলা থেকে উঁকি দিয়ে দেখি বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে। মানে যেদিকটা উলটে গেছে সেই দিকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি দ্রুত ওই ফাঁকা দিয়ে বের হয়ে এলাম। তখন আমার দাদির খুশি দেখে কে? এই মানুষটা মনে হয় নিজের জীবনের চেয়ে বেশি আমাকে ভালোবাসতেন। সব সময় আমার জন্য দোয়া করতেন, আলাদা করে নামাজ পড়তেন। আর একটা কথা এই অধমের নামকরণটা দাদিই করেছিলেন। আমি তার ফার্স্ট সাইটনেস দেখে মুগ্ধ। তিনি কীভাবে বুঝেছিলেন আমি বড় হয়ে বড় মাপের বেকুব হব। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, গ্রামের কোনো মানুষ আমার নামটা সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারতেন না। একেতো কঠিন নাম তার ওপর আবার চার অক্ষরের। কেউ বলতেন ইকুপ, কেউ বলত ইয়েকুপ ইত্যাদি। কিন্তু দাদি একদম সঠিকভাবে ইয়াকুব উচ্চারণ করতেন।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নদী ভাঙনের ফলে পরবর্তীতে আমাদের চলে আসতে হয় শহরে। কিন্তু আমাদের সব আত্মীয়রা গ্রামেই থেকে যান। তাই স্কুলের ছুটি হলেই গ্রামে যাওয়া হতো। একবার গরমের ছুটিতে আমি, আব্বা আর মেজো গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। নদীর ঘাটে পৌঁছানোর পর শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি। নৌকা ওই পাড়ে। এই বৃষ্টির মধ্য এ পাড়ে আসবে না। ঘাটে একটা ডিঙি নৌকা বাঁধা ছিল। অনেক ডাকাডাকি করে মাঝিরও সন্ধান পাওয়া গেল। তখনো ইঞ্জিনের নৌকার চল সেভাবে হয়নি। হলেও ওই রকম অজ পাড়া গায়ে চল ছিল না। অগত্যা পাল তুলে শক্ত হাতে হাল ধরলেন আব্বা। আমাদের বললেন, তোমরা দুই ভাই শক্ত করে নৌকার পাটাতন ধরে বসে থাক। আর মাঝিকে বললেন তুমি নৌকার পানি অবিরাম সেচতে থাকো। এরপরের সময়টা আর ফুরাতে চায় না। আমি আর মেজো ভয়ে চোখ বন্ধ করে নৌকার পাটাতনে বসে বসে কাঁপছি।

আমি আমি মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখছি সে কী ভয়ংকর ঢেউ। বর্ষার আগমনী বার্তা দিচ্ছে পদ্মা নদী তার ঢেউয়ের মাধ্যমে। আব্বা আর মাঝি একটু পর পর ধ্বনি দিচ্ছেন—‘আল্লাহ আল্লাহ রাসুল বলো-লা-ইলাহা ইল্লালাহ’। এই যুদ্ধ কতক্ষণ চলেছিল তা সৃষ্টিকর্তাই জানে। অবশেষে একসময় আমরা পাড়ে পৌঁছালাম। সেদিন গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর আব্বা বেশ বকা খেয়েছিলেন দাদির কাছে। দাদির ঘুরেফিরে একই কথা এই ঝড়ের মধ্যে কেউ বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বের হয়। আর আমাদের জড়িয়ে ধরে সে কী আদর!

শহরে আসার পর ঝড়ের ব্যাপারটা ভালো লাগতে শুরু করল। ঝড় এলেই পাশের কাকিমাদের বাড়িতে চলে যেতাম আম কুড়াতে। সে এক অন্যরকমের প্রতিযোগিতা। একেবারে গেদা বাচ্চা থেকে শুরু করে কর্তা (দাদি) সবাই একসঙ্গে আম কুড়াতাম। ছোটাছুটি-ধাক্কাধাক্কি-হাসাহাসি সবই চলত একসঙ্গে। আর যদি গভীর রাতে ঝড় হতো, তাহলে সকালে কে কার আগে উঠে গাছতলায় যাবে তার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতাও চলত। বরাবরের মতো আমি আর মেজো সবার আগে গাছের তলায় হাজির হয়ে যেতাম। কারণ ঝড় হওয়ার পর আর ভালো করে ঘুম আসত না। কখন সকাল হবে কখন সবার আগে গিয়ে আম কুড়াব সেই চিন্তাই কাজ করত সারা রাত মাথার মধ্যে। এমনকি সামান্য ঘুম এলেও স্বপ্নের মধ্যেও আম কুড়ানোর স্বপ্নই দেখতাম।

এমনই এক রাতে ঝড় হয়ে গিয়েছে। আমি আর মেজো মনে মনে যথারীতি পরিকল্পনা করে রেখেছি। তারপর একসময় ঘুম ভাঙার পর মনে হলো সকাল হয়ে গেছে। যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুত চলে গেলাম গাছতলায়। তারপর অনেকক্ষণ ধরে আম কুড়ানোর পর বুঝতে পারলাম আসলে ভোর হয়নি, তখনো অনেক দেরি ভোর হতে। আমরাতো ততক্ষণে ভূতের ভয় পাওয়া শুরু করেছি। দ্রুত বাড়ি এসে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে ঘুম ভাঙল অনেক পরে। ঘুম ভেঙে শুনি এত বড় একটা ঝড় হয়ে গেল, কিন্তু আম সেভাবে পড়ে নাই। আম পড়বে কীভাবে, আমতো আসলে পড়েছিল। মাঝরাতে আমি আর মেজো গিয়ে যে সব কুড়িয়ে এনেছি। তাই সবার আফসোস শুনি আর আমরা দুজন মনে মনে হাসি। অবশ্য ভূতের ভয়টা পেয়েছিলাম অনেক।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঝড় নিয়ে সর্বশেষ যে স্মৃতিটা আমার মনে আছে। সেটা খুবই মজার। ঘটনাটা বুয়েটে হল লাইফের। আমার রুমমেটরা সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমি যেহেতু না ঘুমানোর দলের সদস্য ছিলাম, তাই যথারীতি ঘুমাতে যেতাম দেরিতে। সামান্য ঘুম কেবল মনে হয় এসেছে, হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। আর ঝড় শুরু হলেই বাতাসের তোড়ে দরজা-জানালা সশব্দে খুলতে আর লাগতে থাকে। আমি বিছানা থেকে উঠব উঠব করছি। হঠাৎ আমার রুমমেট তৌহিদ ঘুম থেকে উঠে চিৎকার শুরু করে দিল, এই ইয়াকুব ভূমিকম্প হচ্ছে। তাড়াতাড়ি পালা। আমিতো বুঝতে পারলাম, বেচারা পড়াশোনার টেনশনে ঝড়কে ভূমিকম্প জ্ঞান করছে। আমি উঠে ওকে ধরতে ধরতে ততক্ষণে সে বারান্দায় চলে গেছে। আমি ওকে বারান্দায় গিয়ে ধরলাম। আর বললাম ঝড় হচ্ছে। সে তবুও বিশ্বাস করে না। তারপর ওকে ধরে অনেক জোরে এক ঝাঁকি দিলাম আর আবারও বললাম, ঝড় হচ্ছে, ভূমিকম্প না।

তৌহিদ তখন পুরোপুরি আত্মস্থ হয়েছে। পরে বুঝতে পেরে দ্রুত রুমে এসে আমাকে আবার বলেছিল ব্যাপারটা কাউকে বলিস না, জানলে সবাই হাসাহাসি করবে। আমি ওর কাছে অনেকভাবে ঋণী। সে ঘুম ভেঙেই কিন্তু আমার নাম নিয়েছিল, অন্য দুজনের নাম নেয়নি। আর ওর চাটগাঁইয়া ভাষায় বলা কথা শোনা আমার কাছে ছিল সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। ওপরওয়ালাকে আমি এখনো ধন্যবাদ দিই ওর মতো একজন রসিক, নিষ্পাপ ও ধার্মিক মানুষের সঙ্গে আমাকে বুয়েট লাইফের সাতটা বছর কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলে। আর ওকে নিয়ে যে কত স্মৃতি। সব যদি লিখি তাহলে কয়েকটা উপন্যাস হয়ে যাবে। দোয়া করি ও যেখানেই থাকুক না কেন, সব সময় সুস্থ ও ভালো থাকুক। আর আমাদের যে আনন্দের ভাগীদার সে করেছিল, সেই আনন্দ শত সহস্র গুণ বর্ধিত হয়ে ওর জীবনে ফিরে আসুক।

একদিন অফিস থেকে বের হয়ে বাসে ওঠার পর দেখি আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বুঝলাম আজও ঝড় বৃষ্ট হওয়ার চান্স আছে। মনে মনে ওপরওয়ালার কাছে বলছিলাম, আমি বাসায় পৌঁছানোর পর যেন ঝড় শুরু হয়। তাহলে বৃষ্টিতে ভিজতে পারব। কারণ, এর আগের বৃষ্টিটা মিস করেছিলাম। এবার আর কোনোভাবেই মিস করতে মন চাইছিল না। বাস থেকে নেমে অটোতে ওঠার পর বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তার মধ্যেই কোনোরকমে অটো থেকে নামলাম। অটো থেকে নামার পর আরও প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে আসতে হয়। আসতে আসতে দেখি একজন একটা টর্চ হাতে নিয়ে রাস্তার ধারের এক আম গাছের নিচে আম কুড়াচ্ছেন। আমি লজ্জায় তার সঙ্গে যোগ দিতে পারলাম না। আর একটু এগিয়ে আসার পর আরেকটা গাছ পড়ল মসজিদের সামনে। ওখানে আলোও আছে আর আমি ছাড়া আর কেউ নেইও। আমি দ্রুতই কুজো হয়ে টপাটপ তিনটা ছোট আমি কুড়িয়ে নিলাম। পাছে কেউ দেখে ফেলে তাই দ্রুতই বাসার দিকে পা বাড়ালাম।

বাসায় এসে তাহিয়াকে আমগুলো দিলাম। যথারীতি ওর মা বলল এই আমের কস খুবই খারাপ জিনিস, এর দাগ শরীরে লাগলে আর ওঠে না, অমুকের মুখে লেগেছিল দাগ এখনো আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কাপড়-চোপড় ছেড়ে তৈরি হতে থাকলাম, ঝড় এলেই আজ আর মিস করছি না। কিন্তু ওর মায়ের ভয়ে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নিলাম। তার একটু পর আবার শুরু হলো ঝড়, সঙ্গে শিলাবৃষ্টি। আমাকে আর পায় কে? খালি পায়ে নেমে পড়লাম বৃষ্টিতে। তাহিয়াও নামবে কারণ বাবা যা করছে, তাকেও তাই করতে হবে। আমি খুবই ভাগ্যবান যে আমার মতো এই অধমকে দেখাশোনা করার জন্য একজন ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

তবে সেদিন ওকে নিরস্ত্র করলাম এই বলে যে, রাতেরবেলা বৃষ্টিতে ছোটদের ভিজেতে নেই। আর আমি তোমার জন্য শিল কুড়ায়ে আনছি, তুমি একটা গ্লাস নিয়ে আসো। আমি সারা ছাদ ঘুরে ঘুরে ওর জন্য শিল নিয়ে আসি আর ও টপাটপ সেগুলো মুখে পুরে দিচ্ছিল। শিল পড়া পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজলাম, তারপর ক্ষান্ত দিলাম। ছাদ থেকে নামার সময় আবার স্যান্ডেল পরে নিলাম আর সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে এমন একটা আছাড় খেলাম, ভাগ্যিস মাথায় বা অন্য কোথাও তেমন লাগেনি। শুধু কয়েক জায়গায় ছিলে গিয়েছিল। আমার মেয়েটা যে আনন্দ পেয়েছে এটা তার কাছে নস্যি। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম আর ওকে হাত দিয়ে ইশারা করলাম, আম্মুকে বলো না। তখন মনে হচ্ছিল শহরের পোশাকি সভ্যতা আমাদের শিশুদের কাছ থেকে তাদের সবচেয়ে মূল্যবান আনন্দের সময়টুকু চুরি করে নিচ্ছে?

অস্ট্রেলিয়াতে আসার পরও ঝড় বৃষ্টি নিয়ে আগের মতোই পাগলামি করি আমরা। আমাদের দলে এখন আরও একজন সদস্য ছোট্ট রায়ান যোগ হয়েছে। এখানে বৃষ্টি হয় শীতকালে সেই সঙ্গে ঝড়ও। বাংলাদেশে ঝড়বৃষ্টি কথাটা অনেক প্রচলিত। কারণ ঝড় শুরু হলেই আমরা বুঝি যে ঝড়ের পরে বৃষ্টি হবে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে এসে শুধু ঝড় হওয়া দেখলাম। শনশন শব্দে বাতাস প্রচণ্ড বেগে বাতাস বয়। বাতাসের শব্দ জানালা দরজাতে এক ধরনের শব্দের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। তখন আমরা তিনজন বারান্দায় এসে দাঁড়াই আর বাতাসের গতিতে নুয়ে পড়া ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। তাহিয়া রায়ানকে বারান্দায় ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যায় তখন। আমি শুধু মনে মনে ভাবি গাছগুলো ইউক্যালিপটাস না হয়ে আম গাছ হলে আমরা সবাই মিলে আম কুড়াতে পারতাম।
...

মো. ইয়াকুব আলী: মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>