জেনেভায় বাংলার শাকসবজি
বিদেশবিভুঁইয়ে বিশেষ করে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের শাকসবজি পাওয়া যায় না বললেই চলে। আর শীতপ্রধান দেশে সবজি চাষ চাট্টিখানি কথা নয়। তাও আবার বরফ ঠান্ডা শেষ হওয়ার পর সেই মাটি ফলনের জন্য তৈরি করা। এটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। জেনেভায় এই অসাধ্য সাধন করে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সাজিয়া রিমি ও কামাল হোসেন দম্পতি। এই দম্পতি সংসার ধর্ম ও চাকরির পাশাপাশি নিজেদের অবসর সময়টা জমিতে ভালো ফসল ফলানোর কাজে ব্যয় করেন। চাষাবাদ ও দেশের শাকসবজির প্রতি প্রবল মমত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজ শুরু করেন। শুধু ফসল ফলিয়েই এই দম্পতি ক্ষান্ত নন, জেনেভা জুড়ে তাদের এই সবজি খুবই জনপ্রিয়। অনেককেই ডেকে নিয়ে আবার অনেকের বাসায় গিয়েও তারা আন্তরিকভাবে দেশীয় এই সবজি পৌঁছে দিয়ে আসেন কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়া।
কিছুদিন আগে তারা প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে আয়োজন করেছিলেন সবজি উৎসব (ভোজন)। অর্থাৎ সবজিময় একটি দিন। অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এটা আবার উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয় হলো নাকি! কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, এই যে সবজিগুলো কত সহজে মনের তৃপ্তি আর ঢেকুর তুলে আমরা বিদেশের মাটিতে বসে উপভোগ করতে পারছি তার পেছনের গল্পটা কিন্তু বিশাল। কতজনেই বা পারেন এভাবে করতে বা সুচিন্তা করতে? তাও আবার বিদেশের মাটিতে একা একা।
এই সবজি চাষ নিয়ে আরও চমকপ্রদ কিছু তথ্য আমার গোচরে এল। বিষয়টি আমার কাছে ব্যতিক্রমধর্মী ও শিক্ষণীয় মনে হওয়ায় বিশদভাবে জেনেই আমার লেখনীতে তা তুলে ধরার ইচ্ছে হলো।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রবাসী নারীদের সংগঠন সেফাম (সিইএফএএম) । ইংরেজিতে এর নাম সেন্টার ফর মিটিং অ্যান্ড ট্রেনিং অব ওমেন। ফরাসি ভাষায় নাম centre de rencontre et de formation pour les femmes. সেফামের সঙ্গে জড়িত আছেন বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সোমালিয়া, আফগানিস্তান, ইরান, পর্তুগাল, আলজেরিয়া, ফ্রান্স ও ব্রাজিলসহ প্রভৃতি দেশের নাগরিকেরা। দেশটির বেশ কিছু ক্যান্টন বা এলাকায় প্রবাসী নারীদের মানসিক ও সামাজিকভাবে ব্যস্ত রাখার জন্য অর্থাৎ বিবাহিত অনেক নারী আছেন যাদের বাচ্চা ছোট ও সংসারের ব্যস্ততার কারণে বাইরে চাকরি করতে পারেন না, তারা যেন হীনমন্যতায় না ভোগেন ও ঘরে বসে অযথা সময় নষ্ট না করেন, মূলত তাদের কেন্দ্র করেই এই সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
এ সংগঠনের গৃহিণী নারীরা একে অন্যের সঙ্গে মতবিনিময়সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত রাখেন। যেমন বিভিন্ন দেশের নানা জাতীয়তার মানুষদের সঙ্গে ভাব বিনিময়, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি, আদান প্রদান, বিভিন্ন দেশের খাবার রান্না শেখানো বা বাস্তবে দেখানোর ব্যবস্থা করা, সেলাই বা হস্তশিল্প শেখানো, শিক্ষণীয় কোনো সিনেমা দেখানো আবার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান বা মিউজিয়াম পরিদর্শনের মাধ্যমে মহিলাদের চিন্তাশক্তির জগৎটাকে আরও শক্তিশালী করা। এ ছাড়া সদস্যদের কারও বাচ্চা ছোট। কোনো ব্যাপার নয়। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে বেবি সিটিংয়ের মাধ্যমে মায়েদের সেফাম আরও বেশি উৎসাহ দিয়ে থাকে।
সেফামের যেসব নারী সদস্য সকল কার্যক্রমে ভালো করেন ও যারা বেশি মনোযোগী থাকেন ক্লাসে, তাদের সেফামের মাধ্যমে সরকারি কিছু জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়, যেন সেই জমিতে তারা তাদের পছন্দমতো শাকসবজি রোপণ করতে পারেন ও উৎপাদনমুখী কাজে তারা যেন ব্যস্ত থাকেন। সেফাম শুধু জমি দিয়েই বসে থাকে না জমিতে চাষাবাদ সংক্রান্ত যাবতীয় আধুনিক সরঞ্জামাদি দিয়ে তারা সাহায্য করে থাকে। জমিতে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ। সংস্থা থেকেই প্রত্যেকের জন্য জৈব সার বরাদ্দ করা হয়, সেই সঙ্গে একজন উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ থাকেন যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককে নানাভাবে সাহায্য করেন। প্রতিটি গাছের রোগ বালাই, পোকা মাকড়সহ সমস্ত ব্যাপারে সহযোগিতা ও উপদেশ প্রদান করেন। এ ছাড়া সেফাম প্রধান প্রতি মাসে সবজি বাগানগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি দেখেন কোন দেশি মানুষেরা সবচেয়ে বেশি সুন্দরভাবে ফলনের কাজে পরিশ্রমী ও মনোযোগী।
গ্রীষ্মকালে নির্দিষ্ট এক দিন এক দেশের সবজির সঙ্গে অন্য দেশের সবজির পরিচিতি ঘটানো হয়। সেদিন জমি বরাদ্দপ্রাপ্ত সকলে নিজ জমির সবজি দিয়ে একটা করে তাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী ডিশ রান্না করে নিয়ে আসেন। এতে করে যে ভাব ভালোবাসার সম্মিলন ঘটে তা চোখে পড়ার মতো। প্রতি বছর যার কাজ সেফাম কর্তৃপক্ষের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে, তিনি পরবর্তী বছরের জন্য আবারও জমি পাওয়ার জন্য মনোনীত হন। এরই ধারাবাহিকতায় সেফামের মাধ্যমে বাংলাদেশি গৃহিণী সাজিয়া রিমি ও জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত কামাল হোসেন দম্পতি পর পর তিন বছর তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশের লাউ, শসা, মরিচ, টমেটো, করলা, বেগুন, কচুশাক, পুঁইশাক, লাল শাক, পালং শাক, শিম, বরবটি প্রভৃতি ফলিয়ে এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তারা বাংলাদেশের লাউ স্থানীয়সহ অন্য দেশের মানুষদের কাছে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছেন।
কামাল হোসেন জানালেন, অন্য দেশের মানুষেরা তার কাছ থেকে খাওয়ার জন্য প্রায়ই লাউ চেয়ে নেন।
আমি এই লেখার মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের শাইখ সিরাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুরোধ জানাচ্ছি, কামাল হোসেন দম্পতির এই প্রয়াসকে তার জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার করার জন্য। যেন প্রবাসী বাঙালিরা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হতে পারে। কৃষিপ্রধান বাংলা দেশের মাটি ও মানুষের সাফল্যের গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়, এটাই আমাদের সবার কামনা। প্রবাস জীবনেও দেশ, দেশের মাটি, ফলন বেঁচে থাকুক প্রতিটি বাঙালির মনন আর হ্রদয়ের মাঠ জুড়ে।
রাওদাতুল জান্নাত: জেনেভা, সুইজারল্যান্ড।