জোছনা রাতের গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রথম প্রথম লন্ডনের জোছনা রাতের চাঁদ দেখে মফিজ অবাক হয়ে যেত । এত বড় চাঁদ সে বাংলাদেশে কখনো দেখেনি। তবে তার কাছে এখানকার পূর্ণিমা রাতের চাঁদের আলো বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা মলিন মনে হতো। এখনো তার কাছে মলিন লাগে। চাঁদ বড় হলে আলো কমে যায় কিনা সে জানে না।

পড়ালেখার জন্য তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ঢাকা শহরে। সুযোগ পেলেই ভরা পূর্ণিমাতে সে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যেত এবং জোছনা উপভোগ করতে মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় গিয়ে বসত।

কিশোর বয়সে চাঁদ-টাদের আলো তাকে আবেগী করতে পারত না। যে দিন থেকে তার চাচাতো বোন নিশির বান্ধবী মিলির সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া শুরু হয়েছিল, তার কয়েক মাস পর থেকে জোছনা রাতকে তার ভালো লাগতে শুরু হলো। সে এক বিশাল ভালোবাসার কাহিনি। মফিজ ছিল খুব ভালো ছাত্র। বুয়েট থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ালেখা শেষ করার পর তার ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশকে আইটিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করা। কিন্তু তার জীবনের সব পরিকল্পনাই আজ ভেস্তে যেতে বসেছে। এখন সে জীবনের কোনো মানে খুঁজে পায় না। বলতে গেলে তার প্রেয়সী মিলির ওপর রাগ করেই মফিজের লন্ডনে আসা। স্বেচ্ছায় নির্বাসন বলা যেতে পারে। যখন মিলি মফিজকে ভালোবাসত তখন তারা দুজনে একরাতে জোছনা উপভোগ করেছিল। মফিজের এখনো রাতটির কথা মনে পড়ে। সে কখনো রাতটির কথা ভুলতে পারে না। সেটি ছিল তার চাচাতো বোন নিশির গায়েহলুদের রাত। নিশির গায়েহলুদে মিলি তাদের বাড়িতে এসেছিল। সে রাত ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক রাত।

তাদের গ্রামের নাম কদম মোবারক। ছোট একটি গ্রাম। মফিজের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়রাই শুধু এই গ্রামে বাস করে। সেটিকে গ্রাম না বলে বড় বাড়িও বলা যেতে পারে। ভাটি অঞ্চলে চারদিকে পানির মাঝখানে প্রায় এক শ বিঘা একখণ্ড উঁচু জমি। তার দাদার দাদারা এখানে এসে বসতি গড়েন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই বড় বাড়িটি কখনো প্লাবনে প্লাবিত হয়নি। এমনকি ছিয়াশির বন্যার সময়ও কদম মোবারক সাগরসম পানির মাঝখানে ভাসা চরের মতো ভেসে ছিল। তার দাদারাই জায়গাটিকে কদম মোবারক নাম দিয়েছিলেন এবং এখানে ছয় ভাই মিলে প্রথম বসবাস শুরু করেছিলেন। কেন তারা এখানে এসেছিলেন, কোন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন, মফিজ সে ইতিহাস জানে না। তবে সে জানে এখানে তাদের চার পুরুষের বসবাস। তাদের ঘরবাড়ি, একটি খেলার মাঠ ও ছোট একটি মসজিদ ছাড়া কদম মোবারকে তেমন কিছু নেই। তার চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাইবোনেরা সবাই দুই কিলোমিটার দূরে স্কুল-মাদ্রাসায় গিয়ে লেখাপড়া করেছে। তাদের বাড়ির সবাই শিক্ষিত। তার বাপ-দাদারাও নাকি সবাই মোল্লা-মুনশি ছিলেন। পূর্ব পুরুষ শিক্ষিত হওয়ার পরও কেন তারা অতীত ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন তা তার কখনো বোধগম্য হয় না। কদম মোবারক থেকে বাইরের যোগাযোগ একমাত্র পানি পথে। তাদের নৌযান সব সময় আধুনিক ছিল। মফিজ শুনেছে, তার দাদারা সব কাজেই খুব পারদর্শী ছিলেন। নিজেরাই নৌকা বানাতেন নিজেদের ব্যবহারের জন্য। এখন তারা ইঞ্জিন চালিত নৌকা ব্যবহার করেন। তবে তা নিজেদের তৈরি না। কদম মোবারকের সবাই এখন উচ্চশিক্ষিত ও ধনী। বয়স্করা এখনো তাদের গ্রাম নিয়ে পড়ে রয়েছেন। তার চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাইবোনেরা সবাই দেশে বিদেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সে নিজেও এখন পূর্ব লন্ডনের শ্যাডঊইলে থাকে।

আজ লন্ডনে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।পূর্ণিমা রাতের পরদিন সে কোনো কাজ রাখে না। প্রতি পূর্ণিমা রাতে সে ঘুমায় না। লন্ডনে চকচকে পূর্ণিমা খুব কম দেখা যায়।বেশির ভাগ পূর্ণিমা রাতগুলোতে এখানকার আকাশকে কাঁদতে দেখা যায়। যেদিন আকাশ পরিষ্কার থাকে মফিজ তার টয়োটা ইয়ারিস নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সারা রাত গাড়ি চালিয়ে জোছনা রাত উপভোগ করে বেড়ায়। স্মৃতি রোমন্থন বলা যেতে পারে। যখন ব্রিটেনে খুব ঠান্ডা শুরু হয় মূলত সে সময় জোছনার দেখা মেলে। তখন লন্ডনের এ–৪০ হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পশ্চিম দিকে যাওয়ার সময় মনে হয় চাঁদ বুঝি গাড়ির ওয়াইড স্ক্রিনের ওপরে এসে বসে থাকে। এমন দিনে মফিজের তার প্রেয়সী মিলির সঙ্গে প্রথম জোছনা স্নানের কথা মনে পড়ে। তাদের গ্রামের মধ্যখানে একটি মাত্র খেলার মাঠ। মাঠটির পূর্ব-দক্ষিণ কোণটিতে বিশাল বিশাল কড়াই গাছ। সেদিন চাঁদের আলো যেন ভর দুপুরের আলোর মতো ছিল। মিলিকে মফিজ কায়দা করে গায়েহলুদের অনুষ্ঠান থেকে নিয়ে গিয়েছিল মাঠের কোণে, কড়াই গাছগুলোর নিচে। সেদিন জোছনার আলোতে দুজনে প্রতিজ্ঞা করেছিল তারা কখনো একে অন্যকে ছেড়ে যাবে না। মিলি তো মফিজকে ছেড়ে সেই কবে আমেরিকায় অন্যের হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছে! কিন্তু মফিজ এখনো ভার্চুয়াল মিলিকে নিয়ে বেঁচে আছে। কারণ মিলিকে ছাড়া সে ন্যানো সেকেন্ডের জন্যও অন্য কাউকে ভাবতে পারে না।

এখন গ্রিনিচ মান সময় বাইশটা। লন্ডনে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। ফ্রস্টি নাইটের পূর্ণিমা। মফিজ তার পুরোনো টয়োটা ইয়ারিস নিয়ে সেন্ট্রাল লন্ডন দিয়ে মাদাম তুসো জাদুঘর পার হয়ে মার্লিবন ফ্লাইওভার দিয়ে সোজা এ–৪০ হাইওয়েতে উঠে গাড়িটি পঞ্চাশ মাইল স্পিডে টান দিল। ঝলমলে চাঁদ তার গাড়ির ওয়াইড স্ক্রিনে এসে বসে পড়ল। আজ চাঁদটি একেবারেই নড়াচড়া করছে না! তার মনে হচ্ছে প্রেয়সী মিলি তার পাশের সিটে বসে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছে। তবে আজ প্রেয়সীর হাসি তাচ্ছিল্যের হাসির মতো লাগছে কেন! সে পরাজিত হওয়ার কারণে এমন লাগছে হয়তো। পরের রাঊন্ড ওভারে গিয়ে সে গাড়িটি এ–৪০–এর পূর্ব দিকে ঘুরিয়ে নিল। খুব স্পিডে টান দিয়ে স্যাডঊইলের দিকে রওনা হলো। চাঁদটি গাড়ির পেছনে পড়ে গেল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর কখনো জোছনার প্রেমে সে পড়বে না।
...

মোহাম্মদ আবদুল মালেক: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।