এটা তোমার জন্য

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শপিং করছি একটি শপিং মল। এটা জার্মানির বড় শপিং মল। নাম Kaufhof। এখানে মুড়ি থেকে আরম্ভ করে সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে দামি ঘড়িও পাওয়া যায়। বেশ বড় শপিং মল এটা। হাঁটতে হাঁটতে বাচ্চাদের খেলনার সেকশনে এসে পড়লাম। হঠাৎ পাশ থেকে শুনলাম একটি ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠস্বর, মা, মা, এই খেলনাটি আমায় কিনে দাও না!

মা বললেন, না, না এটার অনেক দাম। এটা আমরা কিনতে পারব না।

: মা, তুমি না বলেছিলে আমি ফার্স্ট হলে তুমি আমাকে কিনে দেবে?

: হুম, কিন্তু এটা এত দামি...এটা কেনার টাকা এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই।

যা হোক ক্যাশে এসে পে করলাম। ক্যাশ থেকে বেরোতেই হঠাৎ মাইক্রোফোনে শুনলাম, সম্মানিত গ্রাহক, আমাদের এখানে আজ লটারি হচ্ছে। যাদের ক্যাশ মেমোর নম্বরে দুটো দুই বা দুটো চার থাকবে পাঁচ নম্বর কাউন্টারে আসুন। ১০০ ইউরো আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি লটারিতে বিশ্বাস করি না। কারণ আমার হাতে কোনো ভাগ্যরেখা নেই। ভাগ্যরেখা? শুনেছি, সম্রাট নেপোলিয়ন যখন জ্যোতিষীকে হাত দেখাচ্ছিলেন, জ্যোতিষী বললেন, সম্রাট, আপনার হাতে কোনো ভাগ্যরেখা নেই।

নেপোলিয়ন জিজ্ঞেস করলেন, হাতের কোথায় ভাগ্যরেখা থাকে?

: মাঝখানে সম্রাট।

নেপোলিয়ন তার তরবারি নিলেন, ঘ্যাঁচ করে হাতের মাঝখানে একটি রেখা কাটলেন। দরদর করে রক্ত পড়ল। বললেন, এই যে দেখ ভাগ্যরেখা।

নেপোলিয়নের কথা মনে করে ক্যাশ মেমোটি দেখলাম। নিজের চোখ দুটিকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমারটিতে সত্যি দুটো ২ রয়েছে। পাঁচ নম্বর কাউন্টারে গেলাম হাসিমুখে। জীবনে প্রথম লটারিতে জেতা! এই আনন্দ কোথায় রাখব? আমার সামনে আরও দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। আমি লাইনে তিন নম্বর।

হঠাৎ পেছন থেকে সেই বাচ্চাটির গলা শুনতে পেলাম। মা, মা আমরা তো লটারিতে জিতেছি। এবার আমাকে খেলনাটি কিনে দেবে? মা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ দেব। মেয়েটির মুখের হাসি দেখে মনে হলে স্বর্গের আলো যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার মেমোটি ক্যাশের ভদ্রলোককে দেওয়ার মুহূর্তে শুনলাম মাইক্রোফোনে নতুন ঘোষণা—‘আমরা সত্যি দুঃখিত, লটারিতে প্রথম তিনজনকে শুধু প্রাইজ দেওয়া হবে।’

আমার পেছন থেকে যে দীর্ঘনিশ্বাস শুনলাম তাতে অনেক ব্যথা জড়িয়ে ছিল। শুনলাম, মা মেয়েকে বলছেন, চলো মা, আমাদের ভাগ্যে নেই।

: কেন মা?

মা মেয়েটিকে বোঝালেন। ছোট্ট মেয়েটির চোখের দিকে তাকালাম। আকাশ ভরা মেঘ যেন ওর ছোট্ট দুটো নয়নে ঠাঁই নিয়েছে। বিষাদে ভরে গেছে ওর নিষ্পাপ বদন।

আমি দেরি না করে আমার ক্যাশ মেমোটি ওকে দিয়ে বললাম, এটি তোমার জন্য। ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না, না এটা হয় না, আপনি আগে এসেছেন, এটা আপনারই প্রাপ্য। আমি কোনো কথা না বলে বেরিয়ে এলাম। গাড়ির দিকে গেলাম।

গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে দেখলাম ভদ্রমহিলা আর ছোট্ট মেয়েটি শপিং মল থেকে বেরিয়ে এল। হাতে মস্ত বড় একটি খেলনা। শপিং মলের সামনে যেখানে আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে সেখানে গেল দুজনে। আমি গাড়ি স্টার্ট দিলাম। হঠাৎ জানালার কাচ দিয়ে দেখলাম, ছোট্ট মেয়েটি দৌড়ে আসছে আমার গাড়ির দিকে।

গাড়ি থামিয়ে দরজা খুললাম। ছোট্ট মেয়েটির হাতে একটি আইসক্রিম। পাখির মতো মিঠে সুরে পরিটি হাত বাড়িয়ে আমাকে বলল, ‘তুমি খুব ভালো, এটা তোমার জন্য।’
...

তারিক হক: জার্মানি। ইমেইল: <[email protected]>