আদুরে চাঁদ কুয়াশায় ঢেকে যায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়ত চুল, চোখ আর গাল বেয়ে। মা–মণির ভেজা হাত কপালে পড়তেই গুটিসুঁটি হয়ে তাঁতের শাড়ির রাঙা আঁচলে আমি ভিজে ভিজে তুলতুল আর নরম হতাম। মা সারা রাত পাশে বসে থাকতেন। পদ্মপুকুর ঘিরে বৈষ্ণবী লীলাকীর্তন, ঝিঁঝিদের বসন্ত বাসর, বাঁশঝাড়ের ভেতর ফকফকে জ্যোৎস্নার গুনগুনানি, কানে কানে ভয়হীন জীবনের গল্প শোনাতেন। আর আমি তো সারা বছর অপেক্ষায়। আমার আবার জ্বর আসুক। আদর পাওয়ার নতুন বাহানায় আহ্লাদী মুখ শিকেয় লুকাক। বাড়ি ভর্তি মেহমান, বিষয়—মিঠির জ্বর! ফলমূল দিয়ে টেবিল ভর্তি। চোখ কথা বলতে শিখে যায়—‘আমার তো আদর পেলেই চলে!’ ঘন দুধের পায়েস, ছোট আলু দিয়ে কচি মুরগির ঝোল, কখনো শিং মাছের তরকারি আরও কত কী! আমার মন পড়ে থাকত আনন্দ বেকারীর পেস্ট্রি, নানান ডিজাইনের কেক আর বাহারি মিঠাইয়ের প্রতি। কিছুই খেতে না পারার কারণে জ্বর নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা ভেস্তে যেত।

আমার আবার জ্বর আসুক! ভয়াল রাতে নেমে আসুক গ্রহণকালের ওপার থেকে মেঘ ধোঁয়া গন্ধ। আবার ছুটোছুটি, জ্বর ভালো হলেই পুতুলের বিয়েটা ঘটা করেই হবে। অনিন্দ্যদের ছাদে ঘুড়ি উড়াতে যেতেও বাধা নেই। শুধু প্রতিরাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস দুধ; মাকে লুকিয়ে আধ গ্লাস ফেলে দেওয়া যাবে না। গলায় ঝুলে ঝুলে চুমো খেতে খেতে শুরু হতো নয়া বায়না। চলো না, চলো না! অনিন্দ্যদের বাড়ি। চাচি সব সময়ই গুড়ের শিরায় নকশি পিঠা ভিজিয়ে রাখেন আর কাচের বয়াম ভর্তি নারকেলের নাড়ু।

খেলাঘর আঁকিবুঁকি করতে গিয়ে গল্পের ছলে হারাতে থাকে খেয়া পাতার নৌকো, তালপাতার বুনো ঘর, চড়ুইপাখির মাতামাতি। এ দেয়াল, ও দেয়াল টপকানোর প্র্যাকটিস। সামনে যে জীবন পড়ে আছে তা তো দেয়াল থেকে দেয়াল, ছেঁড়া বৃষ্টি থেকে হারিকেন, কাল থেকে মহাকাল অতিক্রমের—‘একাকী ধ্যানমাত্র!’

ঘুমঘোরে মেঘ রাতে জানলার ওপাশে ঝরাপাতার ফিসফিসানি, আদুরে চাঁদ কুয়াশায় ঢেকে যায়। সেই-ই কবে থেকে চাঁদকে মা ভেবে বসে আছি। টোল পড়া গালে জ্যোৎস্না ছুঁয়ে গেলেই মায়ের ঘ্রাণটুকু পাই! বিড়বিড় করে বলি, মা–আ–আ–আ–আ–আ...অফিস থেকে তিন দিনের নৈমিত্তিক ছুটি নাও না। জ্বর ভালো হলে আর তোমাকে ছুটি নিতে বলব না।

‘একদিন ছুটি হবে! অনেক দূরে যাব।’ অতলান্তিকের ওই পাড়ে ঝাড়বাতির আলোয় রং বদলের দেশে। কথা দিচ্ছি মা, তোমার মতনই থেকে যাব। আদিম, অকৃত্রিম, প্রকৃতির কাছাকাছি মোহহীন, সুন্দর।

তোমার দেওয়া গয়নার বাক্সটি বুকের গোপন তোরঙ্গে তুলে রেখেছি। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখি। দাদির সেই ঐতিহাসিক বালা আর বাজুবন্ধ পরে জমিদার গিন্নি সেজে সংসারী বুনো পাখিদের সঙ্গে গড়ে তুলে সহজ মিতালি আর কদমতলার বাঁশিতে মধ্যরাতে সুঁই ফোঁড়, নিভু নিভু লণ্ঠনে গোলাপ গাছের পাশেই দখিন ঘরের খিলে হু–হু আহাজারি।

ময়নার ঠোঁটে বিড়বিড়ানি—‘ললিতা কয় যাব আমি যাব চান্দের দেশে।’

জ্বরে পুড়ে যেতে যেতে ভাসান মেঘের মিছিলে মিশে যেতে থাকি। পার্কের সবুজ ঘাসে ঘুমিয়ে পড়ি। পাশেই চলছে ইয়োগা, মেডিটেশন, পরজনম সার্থক করার আধ্যাত্মিক চর্চা। লাল খয়েরি আর সদ্য ঝরে যাওয়া ম্যাপলের দলও ব্যবচ্ছেদ করে কপোতীর দহন, না বলা প্রাচীন কষ্টবোধ। পাশ কেটে বহুদূর চলে গেছে যে পথ...তার শেষ কোথায়? ঠিকানা না জানা বজরায় বসে থাকা যাত্রী উপভোগ করে জলে ভাসা কাজলরেখার গোপন সৌন্দর্য অথবা শাপলা শালুকে টাপুরটুপুর জলতরঙ্গ। মৃত্যুর মতন সবুজ আর কী আছে? শুধু ওই পাড়ের ভ্রমনটুকুতে ঈশ্বরের সঙ্গে অনন্তযাত্রায় মিশে যেতে হয়। গহিন থেকে আরও গহিনে!

জীবনের কাছে ফিরব না জেনেও
বকুল ফুল কোঁচড়ে ভরি
রং করা কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিই ঝিলের জলে,
রোজ বিকেলে কপালে পরি লাল টিপ
বউ দিবসে ‘বউ কথা কও’ ভাবনায় থাকি
আমার এতটুকুও মৃত্যুর প্রস্তুতি নেই!
ও গো মায়াবী তরুর দল
তোমরা কী বোঝো?
জীবনের রূপ, রস গন্ধ চেখে দেখার জন্যও
একটু সময়ের প্রয়োজন।
এতটুকু না হেসে, জ্যোৎস্নায় স্নান না সেরে
এ কেমন বিদায়!
...


মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।