লন্ডনে বাংলা সংগীত উৎসবের উদ্বোধন

উৎসবের একটি দৃশ্য
উৎসবের একটি দৃশ্য

লন্ডনের রিচমিক্সে হয়ে গেল সৌধ আয়োজিত ষষ্ঠ বাংলা সংগীত উৎসবের উদ্বোধনী অধিবেশন। গত ছয় বছরে, কী সংগীতের মান বা কী দর্শক উপস্থিতি, যেকোনো বিচারেই এই উৎসব এখন ভারত উপমহাদেশের বাইরে বাংলা গানের অন্যতম প্রধান আসর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্রিটেনে শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম শীর্ষ সংস্থা সৌধ ২০১২ সাল থেকে এই উৎসবের আয়োজন করে আসছে।

গত রোববার (৩০ সেপ্টেম্বর) উদ্বোধনী অধিবেশনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল শিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তী পরিচালিত ও পরিবেশিত আখতারি বাঈ নামের এক বিশেষ সংগীত আলেখ্য। ঠুমরি সম্রাজ্ঞী বেগম আখতারের নাটকীয়তাপূর্ণ জীবন ও সংগীতকে উপজীব্য করে এই ব্যতিক্রমধর্মী আলেখ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চন্দ্রা চক্রবর্তীর শ্বাসরুদ্ধকর সংগীত পরিবেশনায়। এলাহাবাদ সম্মেলনে বেগম আখতারের অভিষেকের দৃশ্যে রাগ চারুকেশির দ্রুত খেয়াল, অপূর্ব সব তান-কর্তব; মোহময় মিড় আর গমকের মুক্ত ক্রীড়া বাড়ি ফেরার পথও ঘোরগ্রস্ত করে রেখেছিল। চন্দ্রা চক্রবর্তীর অভিনব গায়নে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’, ‘পিয়া ভোলো অভিমান’ ও ‘ফিরায়ে দিয়ো না মোরে শূন্য হাতে’—বেগম আখতারের গাওয়া এমন বিখ্যাত সব ঠুমরি। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মড়কির কাজ, শৃঙ্গার রসে আর্দ্র অপূর্ব স্বর-প্রক্ষেপণ কৌশল আর তাঁর সুরসিক্ত সুললিত কণ্ঠ মন্ত্র-মুগ্ধ করে রেখেছে হলভর্তি দর্শকদের শেষ মুহূর্ত অবধি।

উৎসবের একটি দৃশ্য
উৎসবের একটি দৃশ্য

সংগীতানুষ্ঠান দেখতে আসা ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব আফ্রিকান স্টাডিজের গবেষক তনিমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই মাপের গান ও পরিবেশনা আজকাল কলকাতাতেও হয় কিনা সন্দেহ। সৌধের উচিত এই সব জাদুময় পরিবেশনা নিয়ে ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়া।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত পিটার মুসগ্রেভ জানান, গানের অর্থ খুব একটা বুঝতে না পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি এটা স্বর্গীয় কিছু।

পুরো মিউজিক্যালে অন্য চরিত্রে ছিলেন শতরূপা ঘোষ, ড. প্রিয়া ভগবত, চান্দ্রেয়ী বসু, রুমা পাল, সমরজিৎ দাস ও ড. সিদ্ধার্থ করগুপ্ত।

চন্দ্রা চক্রবর্তী
চন্দ্রা চক্রবর্তী

বাচিক শিল্পী আফসানা সালাম ও গীতিকার জাহাঙ্গীর রানার পাঠে চর্যাপদ ও মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতার পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় এই উদ্বোধনী অধিবেশন। আফসানা চর্যাপদ থেকে শুরু করে একে একে পাঠ করেন চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞান দাস, আবদুল হাকিম ও আলাওলের প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা। জাহাঙ্গীর রানাও সংক্ষেপে পাঠ করেন বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের কিছু উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তি। আফসানার ইংরেজি অনুবাদ ও বাংলা গীতিকবিতার আদি কবিদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি অবাঙালি দর্শকদের জন্য তো বটেই, বাঙালি দর্শকদের কাছেও শিক্ষণীয় ছিল বলে জানান আশুতোষ শাস্ত্রী বলে একজন মুগ্ধ দর্শক।

পরিবেশনা শেষে চন্দ্রা চক্রবর্তী
পরিবেশনা শেষে চন্দ্রা চক্রবর্তী

পরে ভাটি বাংলার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী শফিকুন্নুর পুত্র জুবের আখতার সুহেলের পরিবেশনায় বুড়ুই চণ্ডীদাস ও সব্যসাচী শিল্পী গৌরী চৌধুরীর পরিবেশনায় লোচন দাসের কীর্তন পুরো পরিবেশকে ভক্তি-গম্ভীর করে তোলে। শফিকুল ইসলাম অপু বলে একজন দর্শক তার মন্তব্যে জানান, বাংলা গানের জাদুকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপনের জন্য এই অনুষ্ঠানটি একটি আদর্শ নমুনা। বাংলা গানের নানা পর্বের কী সম্মোহনী উপস্থাপন!

আখতারি বাঈয়ের ওপর গীতি-আলেখ্যের পর মঞ্চে আসেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। ইমতিয়াজ রবীন্দ্রনাথের উপস্থাপনায় বরাবরই খুব বিশ্বস্ত ও যুক্তরাজ্যে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এবারে রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি গেয়েছেন অতুল প্রাসাদ ও রজনীকান্ত থেকেও।

গৌরী চৌধুরী
গৌরী চৌধুরী

লিডস থেকে আসা জনপ্রিয় উপশাস্ত্রীয় শিল্পী সুমনা বসু পরিবেশন করেন দুটি অপূর্ব নজরুলসংগীত এবং মুকুল দত্ত ও সলিল চৌধুরীর দুটি আধুনিক গানও। মেধাবী তরুণ শিল্পী অমিত দে আধুনিক বাংলা গানের চমৎকার পরিবেশনা দিয়ে বিপুল সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছেন।

সৌধ পরিচালক টি এম আহমেদ কায়সার জানান, উৎসবের পরবর্তী সেশন অনুষ্ঠিত হবে ব্রিকলেনের কাজী নজরুল সেন্টারে আগামী ২১ অক্টোবর রোববার সন্ধ্যা সাতটায়। এতে পঞ্চকবির গান পরিবেশন করবেন রবীন্দ্র গবেষক অসীম দত্ত ও অনুসূয়া পাল। তবলায় থাকছেন পিয়াস বড়ুয়া ও কিবোর্ডে অমিত দে। একই ভেন্যুতে বিশ্বের অনন্য সংগীতের সঙ্গে বাংলা গানের নিরীক্ষামূলক পরিবেশনার বিশেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ২৭ অক্টোবর শনিবার সন্ধ্যা সাতটায়। গাইবেন তিন মেধাবী সংগীতশিল্পী লাবণি বড়ুয়া, সাঈদা তানি ও জেসি বড়ুয়া। তবলায় থাকছেন তানিম আহমেদ ও গিটারে পরাগ হাসান।

ইমতিয়াজ আহমেদ
ইমতিয়াজ আহমেদ

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সের পোর্টকলিস হাউসে অনুষ্ঠিত হবে উৎসবের বিশেষ আয়োজন শাস্ত্রীয় বাংলা গান ২৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পাঁচটায়। পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে বাংলা ধ্রুপদি গানের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে এই বিশেষ পর্বে সংগীত পরিবেশন করবেন চন্দ্রা চক্রবর্তী। তবলা সহযোগিতায় থাকছেন ব্রিটেনের প্রখ্যাত তবলা বাদক ইউসুফ আলী খান।

উৎসবের একটি দৃশ্য
উৎসবের একটি দৃশ্য

উৎসবের সমাপনী সেশনে বাংলা সেক্যুলার গান পরিবেশিত হবে রিচমিক্সে ২ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। এতে বাংলার অসাম্প্রদায়িক লোকায়ত ও নাগরিক সংগীত পরিবেশন করবেন শিল্পী গৌরী চৌধুরী ও তার সংগীত শিক্ষার্থীদের দল সুরালয়, ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ও তার সংগীত শিক্ষার্থীদের দল আনন্দধারা এবং অমিত দে। সংগীত সহযোগিতায় থাকছে লন্ডন ডিসি ব্যান্ড।

উৎসব সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে <saudha.org/news-events.php?view=event 41> লিংকে।