দিঘল মেঘের দেশে-ছাব্বিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ডেরেক স্টুয়ার্টের বাসা থেকে বেরিয়ে আবার পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পর তারা জানল, ডেরেক স্টুয়ার্ট এরই মধ্যে পুলিশ স্টেশনে ফোন করেছেন। সেই পুলিশ অফিসার হাসিমুখে বললেন, আপনারা মিস্টার আজমল হোসেনকে নিয়ে যেতে পারেন। তবে আগামীকাল বা পরশু তাকে নিয়ে আপনাদের আরেকবার আসতে হবে। কিছু কাগজপত্রে সাইন করতে হবে।

সাইদ আহমেদ উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, দারুণ, সত্যি দারুণ। আপনাকে যে কী বলব, আপনাকে এ জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ।

পুলিশ অফিসার বললেন, আমার দায়িত্ব মানুষজনকে সহযোগিতা করা। সেই দায়িত্বই আমি পালন করেছি। এর বেশি কিছু না। আমি যা করেছি সেটা ওই দায়িত্বের একটা অংশ ছিল।

সাইদ আহমেদ বললেন, তারপরও। আপনার সেই একটা পরামর্শে আজমল হোসেন অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলেন। তার অনেক টাকাপয়সাও বেঁচে গেল।

পুলিশ অফিসার স্মিত হাসলেন। কিছু বললেন না।

রাকিব ভাবল, ঘণ্টা তিনেক আগেও তারা কল্পনাও করতে পারেনি, ব্যাপারটা এত সহজে সমাধান হয়ে যাবে। আশাও করেনি। শুধু একটা ইতিবাচক মন-মানসিকতা নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

পুলিশ অফিসারের সেই বাক্যটা এখনো রাকিবের কানে বাজছে, ওয়ান এইট ইয়ার্স ওল্ড বয় হ্যাজ বিন অ্যাসাল্টেড বাই আজমল হোসেন...। কী জঘন্য কথা! অথচ ঘটনাটা কত সাধারণ একটা ঘটনা। তবে সাধারণ ঘটনা হলে ব্যাপারটা যে খুব কষ্টের ও যন্ত্রণার, তা বোঝা যাচ্ছে পুরো পরিস্থিতিটা ভেবে। একটা আট বছরের বালককে স্নেহ ও ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে একজন সম্মানী মানুষ কী অপদস্থই না হলেন!

রাকিব অবশ্য পুলিশকে মোটেও দোষ দিতে পারে না। ছেলেটার বাবা-মা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন বলেই না তারা আজমল স্যারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ কাস্টডিতে নিয়েছেন।

রাকিবের মনে পড়ল, বছর দুই আগে সে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে তার ছোট ফুফুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে একটা ঘটনা শুনেছিল। ঘটনাটা ছোট ফুফুর বাসার কাছাকাছি প্যারামাটা সাবার্বের ঘটে। এক বাঙালি ভদ্রলোক এক দুপুরে তার চার বছরের মেয়েকে নিয়ে কাছেই একটা পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলেন। পার্কে ঘুরতে ঘুরতে আদর ও সোহাগ করতে গিয়ে তিনি মেয়েকে কোলে তুলে তার গালে কয়েকবার চুমু খান। এই দৃশ্য পার্কে ঘুরতে এসে এক মহিলা পথচারী দেখেন। সেই মহিলা পথচারী আবার ইউরোপিয়ান সাদা মধ্য বয়স্কা নারী।

সেই মহিলা পথচারী ভেবে বসেন ব্যাপারটা মনে হয় অন্য কিছু। তিনি সরাসরি পুলিশকে ফোন করেন। খানিকক্ষণ পর সাঁই সাঁই করে সাইরেন বাজিয়ে প্যারামাটার সেই পার্কে পুলিশ চলে আসে। পুলিশ এসে সেই বাঙালি ভদ্রলোককে আটক করে এবং কোলের মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

এদিকে বাঙালি ভদ্রলোক তো হতভম্ব। তিনি পুলিশকে যত বোঝাতে যান মেয়েটা তার। তিনি মেয়েকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে এসেছেন। পুলিশ ততই বেঁকে বসে। পুলিশ উল্টো বলে, তার যা কিছু বলার তা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বলতে। কারণ, তাদের কাছে এক ভদ্রমহিলা ফোন করে অভিযোগ করেছেন, পার্কে একটা ছোট্ট বাচ্চার সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ জোর করে সেক্স অ্যাপিল করছে। মেয়েটাকে জোর করে চুমু খাচ্ছে...!

পরে পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পর যখন প্রমাণ হয় যে ভদ্রলোক মেয়েটার বাবা, তখন পুলিশ বিগ সরি বলতে বাধ্য হয়।

রাকিব জানে, নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়াতে কখনো কখনো কোনো ছোট ঘটনাকে অনেক বড় করে দেখা হয়। অনেক বড় ঘটনাকে তারা কিছুই মনে করে না। যেমন একটা বেড়াল মারলে কারও জেল হতে পারে। আবার বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে কাউকে মেরে ফেললে সেটা অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবেই দেখানো হয়। বেপরোয়া ড্রাইভার পরে সামান্য জরিমানা দিয়ে রেহাই পেয়ে যায়।

তারা আজমল হোসেনকে নিয়ে হেস্টিংস পুলিশ স্টেশন থেকে যখন বের হলো তখন বিকেলটা প্রায় পড়ে এসেছে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। যদিও সূর্য ডুবতে তখনো এক ঘণ্টার মতো বাকি।

ওদের গাড়িটা চলছে দিঘল হিরিটাঙ্গা রোড ধরে। সাইদ আহমেদই গাড়ি চালাচ্ছেন। রাকিব এবার সামনে বসেছে। জাহিদ ও আজমল হোসেন পেছনের সিটে বসেছেন।

রাকিব ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েকবার আজমল হোসেনকে দেখে নিল। এমনিই। পুলিশ স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় আজমল হোসেনকে দেখে তো রাকিবের চোখ কপালে ওঠে। আজমল স্যারের এ কী চেহারা! পাঁচ বছর আগে বে অব প্লেন্টির টিপুকি শহরে সে আজমল স্যারকে যেমন দেখেছিল, এখন তার বিন্দুমাত্র লেশ নেই। শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। ফরসা চেহারায় আগের সেই দ্যুতি নেই। মাথার চুল পেকে ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। চেহারা পুড়ে গিয়ে কেমন ফ্যাকাশে রং ধরেছে। ক্লান্তিতে যেন মুখ ও চোয়াল প্রায় ঝুলে গেছে।

আজমল হোসেনের সঙ্গে রাকিবের আক্ষরিক অর্থ তেমন কথা হয়নি। পুলিশ স্টেশনের ভেতর দেখা হওয়ার পর সে তাকে সালাম দিয়েছিল। কিন্তু আজমল হোসেন সালামের উত্তর না দিয়ে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। রাকিব একবার জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার, আমাকে কি চিনতে পেরেছেন? আজমল হোসেন জবাব দেননি।

বিকেলের সূর্যের রশ্মি গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ও জানালা গলে ভেতরে এসে পড়েছে। জানালার কাচ নামানো বলে হিনহিন নরম বাতাস গাড়ির ভেতর ঢুকছে। পড়ন্ত বিকেল বলে রাস্তায় গাড়ি চলাচল খুব কম।

গাড়িতে সবার মধ্যে পাথর চাপা নিস্তব্ধতা। আজমল হোসেনকে এত সহজে ছাড়িয়ে আনতে পেরে সবার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু এ মুহূর্তে কারও চেহারায় কোনো কোনো খুশির ভাব নেই। বরং সবার মধ্যে একধরনের বিষণ্নতা জেঁকে বসে আছে। সাইদ আহমেদ গম্ভীর মনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছেন। পেছনে জাহিদ তার পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আজমল হোসেন গাড়িতে উঠে সেই যে ঘাড় নামিয়ে বসে আছেন, এরপর আর ঘাড় তুলে তাকাননি। রাকিব কখনো সবাইকে দেখছে, কখনো বাইরে তাকাচ্ছে।

গাড়িটা পার্ক রোডে এসে জাহিদের বাসার ড্রাইভওয়েতে থামতেই রাকিব বলল, আমি আর বাসায় ঢুকব না। এখনই রওনা হয়ে গেলে আমার জন্য সুবিধা।

জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে বলল, আরেকদিন সময় নিয়ে এসো। আমিও দেখি একবার হ্যামিল্টন ঘুরে আসতে পারি কিনা।

রাকিব বলল, হ্যাঁ, হ্যামিল্টন আস। আমি খুব খুশি হব। উইকএন্ডে আসলে তো সমস্যা নেই। উইক ডেতে আসলে একটু আগে থেকে জানিয়ে রেখ। আমি ছুটি নিয়ে রাখব।

সাইদ আহমেদ বললেন, ভালোভাবে যেও। সাবধানে যেও। রাত করে যাচ্ছ। পাহাড়ি পথ।

রাকিব বলল, গাড়িঘোড়া কম থাকবে। আস্তে আস্তে চালিয়ে যাব। অসুবিধা হবে না।

সাইদ আহমেদ বললেন, তাই কর। আর মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ো। তুমি তো যোগাযোগ বন্ধই করে দিয়েছিলে।

রাকিব সায় দিয়ে হাসল। কিছু বলল না। সে আজমল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আসি।

আজমল হোসেন এবারও কোনো জবাব দিলেন না। এমনকি দৃষ্টি তুলে তাকালেনও না। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: