জীবন এক নীরব প্রশ্ন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সকাল দশটার মতো বাজে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতি ট্রেনটি তখন পাঘাচং স্টেশন অতিক্রম করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন থেকে ওঠা কয়েকজন যাত্রী দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে নানা গল্প মেতে আছে। আশপাশে বেশ কিছু আসন খালি। আলমের পাশের আসনও খালি। তাই সে মনে মনে বলে, আরে! ওরা এখানে এসে বসলেই তো পারে। খামাখা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার দরকার কী?

এই ভেবে বসা থেকে উঠে দরজার দিকে উঁকি দিতেই আলম বাক্যহারা।

এ কী, স্বপ্না তুমি?

: আলম ভাই তুমি!

দুজনেই নীরব দৃষ্টি বিনিময়। সময়ের শক্তি মাঝে মাঝে মানুষের অভিভূত হওয়ার শক্তিকেও কেড়ে নেয়। স্বপ্না আলমের ওপর দিকে জানালার পাশের সিটে এসে বসে।

আলম তখন আখাউড়া রেলওয়ে সরকারি হাইস্কুলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। স্বপ্নার বাবা মঞ্জুর সাহেব সহকারী স্টেশন মাস্টার হিসেবে হঠাৎ করেই বদলি হয়ে এলেন আখাউড়া স্টেশনে। আলমের বাবা মজুমদার সাহেব ছিলেন সিনিয়র স্টেশন মাস্টার। মঞ্জুর সাহেব আখাউড়া এসে জয়েন করার সপ্তাখানেক পর একদিন মজুমদার সাহেবের পুরো পরিবারকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। খুব সকালে তার যেতে হবে। সারা দিন থেকে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরতে হবে।

আলমের পরীক্ষা সামনে। যেতে না চাইলেও এই নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার উপায় ছিল না। অবশেষে মায়ের অনুরোধে তাকে যেতেই হলো। সারা দিনের জন্য যাওয়া। এ সময়ে একটা দিন এভাবে নষ্ট করা ঠিক না। তাই আলম সঙ্গে করে বই খাতা নিয়ে আসে। স্বপ্নার মায়ের সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষে একটা রুমের বারান্দায় রাখা চেয়ার টেবিলে বসে পড়াশোনায় মন দেয়।

এক সময় স্বপ্নার মা মেয়েকে নিয়ে এসে আলমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, বাবা আমার বড় মেয়ে স্বপ্না। নাসরীন নবী গার্লসে ভর্তি করেছি। এবার ক্লাস লাইনে পড়ছে। বদলি হওয়া কী যে সংগ্রামরে বাবা। এক স্কুল থেকে আরেক স্কুল। ঝামেলার শেষ নেই। এই স্বপ্না, আলম তোর ভাই। যে যে বিষয়গুলো বুঝতে অসুবিধা হয় আলমকে দেখিয়ে বুঝে নে।

স্বপ্নাও এই অচেনা ছোট্ট শহরটিতে অথই সাগরে ভেলা পাওয়ার মতো আলমকে পেয়ে বসে। ইংলিশে দুর্বল স্বপ্না সঙ্গে সঙ্গেই ইংলিশ বই দুটো নিয়ে এসে আলমের কাছে পড়তে শুরু করে। নিজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলম স্বপ্নাকে পাঁচ দশ মিনিট করে গ্রামারের বিভিন্ন জটিল দিকগুলো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয় একটা প্রশ্নের উত্তর কত দ্রুত ও সহজে বের করে লেখা যায়। এভাবে বহুদিন জ্যাম হয়ে থাকা বিষয়গুলো কোথায় যেন উবে যেতে থাকে। স্বপ্নার মাথাটাও হালকা হয়ে এল যেন।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় স্বপ্না ওর বাবা–মাকে অনুরোধ করে, স্কুল ছুটির পর সপ্তাহে অন্তত যেন দু তিন দিন আলম স্বপ্নাকে একটু পড়িয়ে যায়। নইলে সে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। আগের স্কুলটাতে ভালো কোনো টিচার পাওয়া যায়নি। এদিকে বদলি হওয়ার ঝামেলায় বেশ কিছুদিন নষ্টও হয়ে গেছে। মজুমদার সাহেব ও তার স্ত্রীকে স্বপ্নার বাবা–মা দুজনে মিলে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন।

সামনে পরীক্ষা। এখন এভাবে কাউকে এসে পড়ানো। অসম্ভব! আলমের হাতজোড় অনুরোধ শেষ পর্যন্ত কোনো কাজেই এল না।

অবশেষে আলম সপ্তাহে তিন দিন কোচিং শেষে স্বপ্নাকে এক ঘণ্টা করে পড়াবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

ওই দিন বাসা থেকে বের হওয়ার পথে স্বপ্নার মা আলমের পকেটে বেশ কিছু টাকা জোর করে গুঁজে দিয়ে বলেন, খরচ করো বাবা। লেখাপড়া করো, কত খরচ তোমার...।

প্রথম সপ্তাহ গেল। দ্বিতীয় সপ্তাহেই আলম টের পেল মনটা যেন তার কেমন করছে। স্বপ্নার দিকে চোখ তুলে তাকাতে কষ্ট হয়। মনটাকে মসৃণ কুয়াশার মতো কী এক ব্যথা যেন আবদ্ধ করে দিচ্ছে। চুম্বকের মতো পড়ালেখায় ডুবে থাকা আলমকে এখন জোর করে মনটাকে ধরে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে তাও হয়ে ওঠে না।

স্বপ্না কী তার মন কেড়ে নিতে কোনো কৌশল করছে? না তো। সে কী মায়াবী চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে? না মোটেই না। চোখ নিচু করে মুচকি হাসে? সে কী সময় সুযোগে তার গায়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয়? না, কখনো না।

অথচ স্বপ্নাকে দেখলেই কষ্টটা বাড়ে। এই কষ্টের ভেতরও আবার কেমন এক মন কেড়ে নেওয়া অদম্য ব্যাকুলতা। তৃতীয় সপ্তাহ শেষে অবস্থা এমন হলো—আবার চার দিন পর স্বপ্নাকে দেখতে পাব। কী করে সম্ভব। এই চার দিন কী এক শীতল ঔদাস্যে আলম পড়ার ঘরে শুয়ে রইল শুধু। পড়াশোনায় মন একেবারেই উঠে গেছে। ছোট জানালাটি দিয়ে বাইরে ওই দক্ষিণ আকাশের দিকে চেয়ে থাকা। বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে আড্ডা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কারও সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে হয় না। এভাবে চার দিন গত হয়ে গেলে সেদিন স্বপ্নাকে পড়াতে এসে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে হঠাৎ আলম উঠে দাঁড়ায়। শরীরটা তার থরথর করে কাঁপছে।

: স্বপ্না, আমি আর আসব না...।

হঠাৎ এ কথা শুনে বজ্রাহত স্বপ্না শুধু বলল, আলম ভাই, ইয়ে আলম ভাই! কী হয়েছে? কেন আর আসবেন না। আমি কী কোনো...।

স্বপ্নার কথা শেষ না হতেই আলম উত্তর দেয়, জানি না।

বলেই আলম দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে গেল। পেছনে পেছনে দৌড়ে আঙিনায় এসে স্বপ্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, মাকে একটু বলেও যাবেন না? মা যদি জিজ্ঞেস করে? আমি কী জবাব দেব...।

শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে স্বপ্নার গলা জড়িয়ে আসছিল। আলম স্পষ্টই টের পেল।

এরপর আর তাদের দেখা নেই। মনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করে শেষ হলো এসএসসি। তারপর নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়ে আলম স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসে। ছয় মাস যেতে না যেতেই মজুমদার সাহেবও বদলি হয়ে আসেন তেজগাঁও স্টেশনে। এইচএসসি শেষ করে স্টুডেন্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায় যেতে আলম উন্মাদ হয়ে পড়ে। খুব ভালো স্কোর করে আইইএলটিএস পাস করলে ভিসা পেতে আর বেগ পেতে হয়নি।

হসপিটালিটির ওপর একটা শর্ট কোর্স করে মাইগ্রেশনও হয়ে যায়। পাবলিক হেলথে পড়ার প্রবল আগ্রহ আলমের। তাই তিন মাসের এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে দেশে আসা। বাবা–মা ও বন্ধু–বান্ধবদের সঙ্গে এই সময়টুকু কাটিয়ে নিউ ক্যাসল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। এই তার ইচ্ছে। আজ সে মহানগর প্রভাতি এক্সপ্রেসে আখাউড়া যাচ্ছে এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে তার ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে।

: স্বপ্না কী করছ এখন?

: ঢাকা মেডিকেলে এমবিবিএস ফার্স্ট ইয়ারে। তুমি!

: এই তো গত মাসে মাইগ্রেশন হলো। পাবলিক হেলথে পড়ব ভাবছি।

: ভালো। আখাউড়া যাচ্ছ বুঝি।

: আর বলো না, আমার ফ্রেন্ড নাহিদের ছোট বোনের বিয়ে।

: ও আচ্ছা, চিনতে পারছি। আমাদের বাসায় তো আর আসবে না। তাই না?

খোলা জানালায় বাইরের দিকে চেয়ে আলম নীরব।

বাইরে চোখ জুড়ানো শীতল সবুজ। বাংলার বিচিত্র রূপময় প্রকৃতির তুলনা বাংলা নিজেই। যত দূর চোখ যায়, দুই দিকেই বিস্তীর্ণ সবুজ ধানখেত, ঘাস, পানাঢাকা খাল। টলটলে জল, কখনো মৃদু ঢেউ। শীতল বাতাসে কচি ধানের ঘ্রাণ।

স্বপ্না বলে, আলম ভাই।

: হ্যাঁ বলো।

: সেদিন ওভাবে চলে গিয়েছিলে কেন? কী ছিল আমার অপরাধ?

কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে আলম জবাব দেয়, অপরাধ? স্বপ্না কার অপরাধ? কী সেই অপরাধ? নিজেই কী জানি?

: আমরা দুটোমাত্র বোন। একটা ভাই নেই। আখাউড়া এসে এই সম্পূর্ণ অচেনায় তোমাকেই প্রথম কাছে থেকে দেখি। আমি একটা মেয়ে বলেই কী এত অবহেলা?

অনেক দিন ধরে অতি কষ্টে চেপে রাখা বুকের ব্যথাটা আবার উঁকি দেয়। আলমের স্থির চোখ আরও নীরব। খোলা জানালায় ধেয়ে আসে কচি ধানের ঘ্রাণমাখা বাতাস।

ট্রেন তখন ভাতশালা স্টেশন পার হয়। পার হয় বাসুদেব গ্রামের শেষ প্রান্ত নিবিড় গাছে ঘেরা এক ঈদগাহ। পাশাপাশি শীতল ছায়ায় গোরস্থান। কতিপয় মাটির হিমঘরে কিছু না বলা কথা। অব্যক্ত কষ্ট জড়ানো নিশ্বাস গোপন করে আলম বলে, মেয়ে বলে অবহেলা? আমার মনটা কী এমন? এমনই কি ভাব আমাকে স্বপ্না?

: না।

: তবে, কেন কষ্ট দাও। পরবাসের ধূসর দিনগুলো। খেয়ে না খেয়ে থাকা। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে কে আর মুখের দিকে তাকায়। কে আমার; আমিই বা কার? সে এক কঠিন বাস্তবতা। কী আর বলব তোমাকে। সারাক্ষণ মনে পড়েছে। অনেক। খালাম্মা কী যে আদর করতেন।

কণ্ঠ জড়িয়ে আলমের চোখদুটো ভিজে এল।

: তুমি যখন হঠাৎ করে কিছু না বলেই চলে যাও, তোমার এ চলে যাওয়ায় কী যেন আবার থেকেও যায়। নিজেকে যতই বোঝাতে চেষ্টা করি, না এ হয় না। যে চলে যায়, চলেই যায়। আর ফেরে না। মনটা কিছুতেই বুঝতে চায় না। কী এক প্রতীক্ষা, হয়তো কেউ একজন আসবে। যার কাছে আমার অনেক শান্তি।

: স্বপ্না, আমার অবস্থাটা হয়তো তোমাকে বোঝাতে পারব না। ওই চলে যাওয়া; খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার।

: কষ্ট হচ্ছিল বলেই খুব বড় এক কষ্টের বোঝা আমার ওপর ছুড়ে ফেলে সরে পড় তুমি।

: কষ্ট বুঝি আর কারও হয় না, না?

: জীবনে যদি কোনো একটা ভালো অবস্থা তৈরি করতে না পারি; তবে কী বলে দেব নিজেকে সান্ত্বনা? এমনই এক ভয় আর সতর্কতায় নিজেকে কষ্ট দেওয়াই যে সার হলো। তবে স্বপ্না, একটা বিষয় খুব গভীরভাবে অনুধাবন করেছি, জীবনকে নিষ্ঠার সঙ্গে ভালোবাসলে জীবন একদিন সুন্দর সময় উপহার দেয়।

: হ্যাঁ, ঠিক তাই। গভীর এক বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছি, তাই হয়তোবা। নইলে তোমার কাছে পড়তে আসা ইংলিশে দুর্বল স্বপ্না আবার ঢাকা মেডিকেলে চান্স পায় কী করে? নিজেই অবাক হই।

এবার দুজনেই হাসতে লাগল।

: আলম ভাই, বিয়ে? হয়ে গেছে?

কোমল হাসিতে আলম বলল, স্বপ্না! ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কেউ যখন মেয়ে সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আমাকে ইঙ্গিত করে, আমি রেগে যাই। এই অদ্ভুত আচরণে আমার অনেক বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেছে। আজ জিজ্ঞেস করলে তুমি। না, আজ আর রাগ করব না।

মহানগর প্রভাতি টেনটা তখনই মাত্র আখাউড়া স্টেশনে এসে থেমেছে।
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>