নীল কুমুদিনীর নৃত্য-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভালোবাসা! ভালোবাসা! নদী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভালোবাসার সংজ্ঞাটাই সে এখনো বুঝতে শেখেনি। কে কোথায় কীভাবে যে ভালোবাসা খোঁজে। একেকজনের ভালোবাসার সুখ একেক রকম। অনাবিল হয়তো এভাবেই ভালোবাসার সুখ খুঁজে পাচ্ছে। সে এ দেশি একজন গার্লফ্রেন্ড নিয়েছে। এ দেশিদের মতো লিভ টুগেদার করছে। গত মাসে তাদের ভালোবাসার ধন ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে হয়েছে। কী অদ্ভুত সুন্দর বাচ্চা মেয়েটা। মনে হচ্ছে কাপড়ের তুলতুলে একটা পুতুলের মতো। কিন্তু অনাবিল বিয়ে করবে না। বাবা-মার শত অনুরোধেও সে বিয়ে করবে না। সে জীবনটাকে আগে উপভোগ করতে চায়। আপাতত সাত-আট বছর তার কোনো বিয়ের চিন্তা নেই।

অনাবিলের মুখে এ দেশিদের মতো কথা, ত্রিশের আগে কীসের বিয়ে?

নদীর একটা বিষয় মাথায় ঢুকছে না। অনাবিল এ দেশি সাদা পাকিহা মেয়েটার সঙ্গে একই ছাদের নিচে বসবাস করছে। স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবনযাপন করছে। গত মাসে একটা বাচ্চা মেয়েও হয়েছে। কিন্তু সে বিয়ে করবে না কেন?

অনাবিলের এই বিয়ে না করার যুক্তি শুনে নদীর বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। অনাবিল যতবারই কথা বলছে, নদী ততবারই তার দিকে চোখ ছোট করে তাকাচ্ছে। কিন্তু নদী যখনই মোহনা ভাবির দিকে তাকাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মোহনা ভাবি কিছুক্ষণ পরপর এতগুলো মানুষের সামনে আঁচল চেপে কাঁদছেন। ছেলে হারানোর কান্নার চেয়ে কী একটা লজ্জার কান্না যেন!

আরেকটা ব্যাপার নদীকে অবাক করে, ভারত উপমহাদেশের যেকোনো দেশ থেকে অভিবাসী হয়ে আসা অনেক পরিবারই প্রথমে কয়েক বছর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বসবাস করেন। নিজেদের গাড়ি হাঁকান। নিজেদের বিশাল বাড়িতে বসবাস করেন। ব্যাংকে মুঠো মুঠো ডলার জমা করেন। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বড় হতেই তারা আবার গাড়ি-বাড়ির কথা ভুলে গিয়ে আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যান। তাদের মধ্যে সব সময় একটা ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়, এই বুঝি তাদের ছেলেমেয়েরা ঘরের বাইরে বের হলো...! আর তাদের ছেলেমেয়েরাও আঠারো পেরোতেই কেমন স্বাধীনতা চায়। তারা ঘরে থাকতে চায় না। বাবা-মাকে মনে করে বিরক্তিকর কেউ।

নদী জানে, নিউজিল্যান্ডের আইনে আঠারো বছর হলে ছেলেমেয়েরা বাবা-মার অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। তারা ইচ্ছে করলে চাকরি করতে পারে। লেখাপড়া করতে পারে। আবার ইচ্ছে করলে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে স্টেট বেনিফিট বা স্টুডেন্ট অ্যালাউন্স নিয়ে আলাদা বাসায় বসবাস করতে পারে। কিন্তু ইউরোপিয়ান সাদা বা আদিবাসী মাউরি ছেলেমেয়েরা এ দেশে জন্ম। এ দেশের সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠছে। ওদের আঠারো বছর হলে ওদের বাবা-মা ইচ্ছে করেই আলাদা করে দেয়। এদের বন্ধনটা এ রকমই। কিন্তু ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষজনদের তো আলাদা একটা সংস্কৃতি আছে। বাবা-মার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বন্ধনটা খুবই অন্যরকম। আঠারো বছর হলেই ছেলেমেয়েদের চলে যাওয়াটা বাবা-মা কোনো দিনই মেনে নিতে পারেন না।

নদী শুনেছে, অনাবিল আঠারো পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই ঘর ছেড়ে চলে যায়। ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োলজি বিষয় নিয়ে ভর্তি হয়েও লেখাপড়া আর এগিয়ে নিয়ে যায়নি। ফার্স্ট ফুডের দোকান ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করতে গিয়ে এক সহকর্মীকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে নেয়। সেই গার্লফ্রেন্ড বেশি দিন সম্পর্ক ধরে রাখেনি। পরে তার চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের বড় আরেকটা গার্লফ্রেন্ড নেয়। সেই গার্লফ্রেন্ড নিয়েই প্রায় তিন বছর ধরে লিভ টুগেদার করছে। ডা. শাহ আমিন ও মোহনা ভাবি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ছেলেকে ঘরে ফেরাতে। পরে ক্ষোভ, লজ্জা ও দুঃখে নিউজিল্যান্ড ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে চলে যান।

ব্রিসবেন গিয়েও শাহ আমিন ও মোহনা ভাবি ছেলেকে ঘরে ফেরাতে প্রচুর চেষ্টা করেন। একটা মাত্র ছেলে অনাবিল। প্রথম সন্তান। অনাবিলের জন্মের প্রায় পনেরো বছর পর আনমনার জন্ম। ছেলে তো তাদের নাড়ি ছেঁড়ার ধন!

অনাবিলের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় যে গার্লফ্রেন্ড। ছেলেকে ঘরে ফেরাতে শাহ আমিন ও মোহনা ভাবি তাকেও হাতেপায়ে ধরেন। তাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পুরোপুরি রাজি হন। কিন্তু শাহ আমিন ও মোহনা ভাবির একটাই মাত্র অনুরোধ ছিল, তাদের বিয়ে করতে হবে। মেয়েটা তো এ দেশি। বয়সেও বড়। মেয়েটার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু যত আপত্তি ছিল অনাবিলের। অনাবিল তার বাবা-মার সামনে যুক্তি দেখিয়েছিল, সে তার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করলে তার গার্লফ্রেন্ড কি নতুন মানুষ হয়ে যাবে? একই তো মানুষ থাকবে। তাহলে বিয়ে কেন?

নদী এ মুহূর্তে অনাবিলের দিকে তাকিয়ে ভাবল, আজও অনাবিল সেই অকাট্য যুক্তি দেখাচ্ছে। যে যুক্তি খণ্ডানোর চেয়ে সবার মধ্যে লজ্জাই এসে ভিড় করছে।

ডা. শাহ আমীনের সঙ্গে গতকাল থেকে নদীর তেমন কথাবার্তা না হলেও মোহনা ভাবি মানুষটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ভেতরে কোনো প্যাঁচগোছ নেই। একদম সহজ সরল। আজ সকাল থেকে সারাটা দিন নদীর কাছে শুধু ছেলের ওসব কথাই বলে বেড়িয়েছেন। ছেলের ঘরে নাতনি হয়েছে শুনে তারা সেই অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন থেকে হ্যামিল্টনে এসেছেন। সকাল থেকে মোহনা ভাবির নাতনি দেখার সে কী উদ্‌গ্রীব আকাঙ্ক্ষা!

এখন অবশ্য শাহ আমিন নাতনি দেখার পর কাঠ হয়ে বসে আছেন। মোহনা ভাবি কিছুক্ষণ পরপর ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছেন। অনাবিল নির্বিকার বসে আছে। অনাবিলের গার্লফ্রেন্ড জেনি কিছু না বুঝে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। তাদের বাচ্চা মেয়েটা জেনির কোলে ঘুমাচ্ছে। নাজমুল আহসান ও শিমুল ভাবি প্রথম থেকেই কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছেন।

নদী বিকেল থেকে নিজের রুমে ছিল। ভেবেছিল, শাহ আমিন ও মোহনা ভাবির ছেলের সঙ্গে নিজেদের ব্যাপার আলাপ আলোচনা হবে। মাঝখান থেকে সে এসে কেন ওদেরকে এসে বিব্রত করবে? তাই নদী বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের রুম ছেড়ে একবারও আসেনি। কিন্তু সন্ধ্যার পর কিচেনে কফি বানাতে এসে মোহনা ভাবির ডাকে সেই যে বসেছে, আর উঠতে পারেনি। এখনো সে মোহনা ভাবির একপাশে বসে আছে। শিমুল ভাবি বসেছেন মোহনা ভাবির অন্যপাশে।

অনাবিল সামনের সোফায় বসে কিছুক্ষণ পরপর উসখুস করে নড়েচড়ে উঠছে। বোঝা যাচ্ছে, সে উঠে যেতে পারলে বাঁচে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক সে উঠতে পারছে না।

নদীর কিছুক্ষণ পরপর জেনির কোলের ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটাকে দেখছে। অনাবিলের সঙ্গে মেয়েটার চেহারার কী মিল! মনে হচ্ছে একদম ফটোকপি।

আর অনাবিলও দেখতে খুব সুন্দর। শুধু ফরসা বলেই নয়, মোহনা ভাবির মতো একটা মায়া মায়া চেহারাও পেয়েছে। মাত্রই তো বাইশ বছরের যুবক। কিন্তু বয়সের তুলনায় তাকে দেখতে অনেক ছোট মনে হয়। হঠাৎ করে দেখলে যে কেউ মনে করবে অনাবিল যেন পনেরো-ষোলো বছরের বালক। বরং তার পাশে তার গার্লফ্রেন্ড জেনিকে মনে হচ্ছে দ্বিগুণ বয়সী। যদিও জেনি অনাবিলের চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের বড়।

নদী জানে, বয়স বড় বা ছোট এ দেশে কোনো বিষয় নয়। পশ্চিমা বিশ্বে পাত্র বড় নাকি পাত্রী বড় এ নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। কিছুদিন আগেই তো ব্রিটিশ রাজপরিবারের সন্তান প্রিন্স হ্যারি তাঁর চেয়ে চার বছরের বড় মেগান মার্কেলকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু নদীর ভেতরের কষ্টটা মোহনা ভাবির জন্য। এই সহজ সরল মানুষটাকে কে বোঝাবে, একমাত্র ছেলে হলেই এই পরবাসে কোনো মায়ের আহাজারি করতে নেই। এই পরবাস বড্ড মায়ার স্থান। দূর থেকে শুধু হাতছানি দিয়ে ডাকে। কাছে এলে কুহেলিকার মতো হাওয়া হয়ে যায়!

অনাবিল অনেকক্ষণ পর কথা বলে উঠল, আমরা তাহলে উঠি। ড্যাড, আমি আগামীকাল সম্ভব হলে একবার ফোন দেব। আমরা আপাতত ব্রিসবেন যেতে পারব না। বেবিটা অনেক ছোট। বেবিটা আরেকটু বড় হোক। তারপর একবার ঘুরে আসব।

ডা. শাহ আমিন আগের মতোই কাঠ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।

মোহনা ভাবি নাকি-কান্না করে বলে উঠলেন, হায় হায়, ক্যান আমরা বিদেশ আসলাম। কার জন্য আসলাম। অনাবিল, তোর মন কি একবারও বুঝতে চায় না? আমি তোর মা। তুই আমার নাড়ি ছেঁড়ার ধন!

অনাবিল আস্তে করে বিরক্ত হওয়ার গলায় বলল, মা, তুমি এসেছ বলে সেই টোকোরোয়া থেকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তোমার কোথায় হ্যাপি হওয়ার কথা, উল্টো আন-হ্যাপির মতো কাঁদছ। কেন তুমি কাঁদছ?

শিমুল ভাবি পাশ থেকে বললেন, বাবা অনাবিল, তুমি সেটা বুঝবে না। তোমার বয়স হোক, তারপর বুঝবে।

অনাবিল দৃঢ় গলায় বলল, না আন্টি, তুমি ভুল বলছ। আই অ্যাম টুয়েন্টি টু ইয়ার্স ওল্ড। আই অ্যাম কোয়াইট অ্যাডাল্ড এনাফ।

শিমুল ভাবি চুপ হয়ে গেলেন।

অনাবিল জেনির দিকে তাকিয়ে বলল, জেনি চল। বেবিটা এখন ঘুমাচ্ছে। ঘুমে থাকতে থাকতে চলে যাই। তাকে আস্তে করে গাড়িতে তোলো। জেগে গেলে আবার বিরক্ত করবে। বলেই সে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

জেনি বাচ্চা মেয়েটাকে আলগোছে কোলে ধরে রেখেই উঠে দাঁড়াল।

নাজমুল আহসান ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, আহা অনাবিল, কী করছ। তুমি খাবে বলে তোমার মা তোমার জন্য আজ সারা দিন কত কিছু রান্না করেছে। তোমার আন্টিও রান্না করেছে। তুমি না খেয়ে চলে যাবে?

অনাবিল বলল, জি আংকেল। আমার এখন এই আন-হ্যাপি পরিবেশটা একদম ভালো লাগছে না।

মোহনা ভাবি সোফা ছেড়ে উঠে অনাবিলের হাত ধরে বললেন, বাবা, আমি হ্যাপি। আই অ্যাম রিয়েলি হ্যাপি। দেখ, আমি আন-হ্যাপি না। আমি হাসছি হি–হি! তুই খেয়ে যা বাবা। তুই না খেয়ে যাস নে...। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন