হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-চার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছিপছিপে গড়নের আর সামান্য কুঁজো ষাট ছুঁই ছুঁই মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া আপাত গম্ভীর ডাক্তার হেইস কিন্তু আসলে আমুদে এক ভদ্রলোক। সঙ্গে প্রকাণ্ড টাক। তাকে দেখলেই সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর কথা মনে পড়ে। তো, দাঁত দেখে দুঃখে হেইস আমার মাথার ওপর থেকে দুশ্চিন্তার মেঘ সরিয়ে জানালেন, ‘সামান্য একটু ভেঙেছে। এটা একটা মিহানিহাল ড্যামেজ, ব্যাপার না।’ আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, মিহানিহাল কী বস্তু আবার? হেইস সজোরে মাথা নেড়ে অতি কষ্টে উচ্চারণ করলেন, আরে মিহানিহাল বোঝ না, কী বল তুমি? মিখ-খা-নিখ-খাল! আমি বুঝলাম। তিনি আসলে বলার চেষ্টা করছেন ‘মেকানিক্যাল’। একে ইংরেজি কম জানা ঘোড়ার ডাক্তার, তার ওপর কথায় এক ধরনের আঞ্চলিক জার্মান টান আছে। কোন অঞ্চলের, সেটা জানা বা বোঝা এই অধমের জ্ঞানের বাইরে।

ডাক্তার হেইস বলেই চলছেন, ‘কী চিবোতে গিয়েছিলে, বলত?’ উত্তরে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘কী আবার, তোমাদের পাথুরে রুটি আর কী?’ আমার অভিযোগ শুনে হেইস তার দাঁত দেখার যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে উঠলেন, ‘এই পাথুরে রুটি খেতে খেতে এক সময়ে এমন অভ্যস্ত হয়ে যাবে যে আর কিছু তখন মুখেই রুচবে না। জার্মান রুটির এমন গুন, বুঝলে।’ আমি এতক্ষণে কিছুটা অধৈর্য। তবুও মন দিয়ে হেইসের কথা শুনে যাচ্ছি কোনো একটা সমাধান শোনার আশায়। ডাক্তার বুড়োটা বলেই চলছেন, ‘যা হোক, এমন নাটকীয় কিছু হয়নি। দাঁতটা তোমার এভাবেই থাকুক না। নাকি দেব ঘষে সমান করে?’ বলেই টুথপেস্টে বিজ্ঞাপনের মতো চওড়া একগাল হাসি দিলেন ভদ্রলোক। সোনা দিয়ে বাঁধানো তার বাম পাশের ক্যানাইন দাঁতের সোনালি ঝিলিকে পলকের জন্য আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। তার ওপর দাঁত ঘষে সমান করে দেওয়ার প্রস্তাবে আঁতকে উঠলাম। ‘ঘষে সমান করে দেব’ শুনতেই কী মারাত্মক শোনাচ্ছে! সজোরে মাথা নেড়ে আপত্তি জানালাম, ‘না, না, ঘষতে হবে না। দাঁতের ওপর কিছুদিন জিভ বুলিয়ে দেখি যদি কোনো গতি হয়। আর কাজ না হলে তুমি তো আছই।’ হেইস ডাক্তার কিছুটা হতাশ হয়ে সেদিনের মতো কেস ডিসমিস করে আমাকে ছেড়ে দিলেন।

লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘড়ি ধরে ঠিক মিনিট বারোর মাথায় পৌঁছে গেলাম লতার দেখানো ক্যাফেটায়। ঢুকতেই ভাজা মাংসে স্বর্গীয় ঘ্রাণ নাকে নির্মম ঘাঁই দিয়ে গেল। সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ভাজার তেল ফোটার শব্দ। সেই সকালে অতি তিতকুটে রং চা দিয়ে একটুকরো জেলি-পাউরুটি গিলে বেরোনো হয়েছে। ভাবছি, লতার অপেক্ষায় বসে থাকব নাকি এই ফাঁকে চটজলদি পেটে কিছু চালান দিয়ে ফেলব। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হওয়ার আগেই মনস্থির করা দরকার। সব দেখেশুনে আমাকে অবাক করে দিয়ে ধু ধু মরুভূমি পেটটা এবার তামাম ক্যাফে কাঁপিয়ে প্রচণ্ড ‘গ্রাউল–গ্রাউল’ ডাক ছেড়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এরপর আর কী দোটানায় থাকা যায়? সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো যে খাবই খাব।

বহু আকাঙ্ক্ষিত ডোনার কাবাব, বড় এক প্লেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কলিজা ঠান্ডা করা এক বোতল কোক অর্ডার দিয়ে তীর্থের কাকের তৃষ্ণা নিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছি।

এ সময় হঠাৎ কানে একটা চিল চিৎকার ভেসে এল। কোণার টেবিলে মায়ের সঙ্গে বসা পুতুলের মতো শান্ত চেহারার বছর দেড়েকের বাচ্চাটা কেন যেন খুব ক্ষেপে গিয়ে তারস্বরে জগৎ সংসারের ওপর তার বীতশ্রদ্ধ জানান দিচ্ছে। সেই ক্ষ্যাপা গান শুনে উল্টো দিকের টেবিলে বসা বিরস বুড়োটা খিস্তিখেউড়ের বন্যা বইয়ে দিতে থাকলেন। তার গলাবাজি আর গালি বাজির সারমর্ম হলো, ফ্রাউ মার্কেল যে কোত্থেকে লাখ লাখ গেঁয়ো ভূত ধরে এনেছে। সামনে জার্মানির ভবিষ্যৎ অমাবস্যার মতো অন্ধকার। মার্কেলকে এর জন্য পস্তাতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ওদিকে বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা সিরিয়ান কিংবা আফগানি বাচ্চার মায়ের নির্বিকার মুখ দেখে বুঝলাম, বুড়োর এত সাধের জার্মান গালিগুলো একদম জলে গেছে। জার্মান ভাষাটা তার কাছে দুর্বোধ্য। খামাখা গালিগুলো তার বোরকায় লেগে বুমেরাং হয়ে ফিরে গেছে। বুড়োটার রুষ্ট আচরণে কষ্ট পেলাম। কারণ, লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার পেছনে এ দেশের নিজের তাগিদটাই বেশি। কারণ পানিশূন্যতার মতো জার্মানি এখন শিশু শূন্যতা আর অল্পবয়সী তরুণ-যুবকদের শূন্যতায় ভুগছে। বুড়োটাকে মিষ্টি মোলায়েম ভাষায় হালকার ওপর ঝাপসা একটু শাসিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালাম। আর অমনি বাচ্চাটা মায়ের কোল থেকে একটা ঝপাৎ ঝাঁপ দিয়ে পকাৎ করে দৌড়ে পালানো শুরু করল। ক্যাফেটা রাস্তার একদম পাশে। বেরোলেই সাঁই সাঁই গাড়ি। আমি পড়িমরি করে এক ছুটে বাচ্চাটার হাত ধরে ফেললাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ছেড়েও দিলাম। হাতে ভয়ংকর এক ক্যাঁক কামড় দিয়ে দিয়েছে বিচ্ছুটা। আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখছি এখন। ফুলের মাঝখানে আবার ছোট ছোট রঙিন পাখি গোল হয়ে পিকিপক স্বরে উড়ে বেড়াচ্ছে।

তবে স্বস্তির ব্যাপার, এর মাঝে বিচ্ছুটার মা দৌড়ে চলে এসেছে। আজকে এই পুঁচকে সিদ্ধার্থের আর গৃহত্যাগ করা হলো না তাহলে। কিন্তু বিস্ময়ে মুখ হা হওয়ার দশা হলো যখন ভদ্রমহিলা কোনোরকম জড়তা ছাড়া চোস্ত জার্মানে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাচ্চার ছটফটানির জন্য এক চোট দুঃখ প্রকাশ করে কাউন্টারে বিল চেয়ে টেবিলে ফিরে গেলেন। সেই সঙ্গে চিরকালের অধৈর্য আমাকে যেন ধৈর্যের একটা বড়ি গিলিয়ে দিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা।

ক্যাফের দরজার দিকে তাকালাম। লতা বা এ রকম কাউকে দেখা গেল না। ওদিকে আমার অতি সাধের ডোনার কাবাব তৈরি। ইশারায় আমাকে প্লেট নিয়ে যেতে ডাকা হলো। আমি হাতের কামড়ে দেওয়া লাল হয়ে যাওয়া জায়গাটা ডলতে ডলতে সামনে এগোলাম। ভালো কামড়ই দিয়েছে। পাঁচটা আর পাঁচটা, মোট দশটা দাঁত দিয়ে দুই দুইটা আধ খাওয়া চাঁদ এঁকে দিয়েছে এক চোটে।

চোট সামলানোর খুব বেশি সময় পেলাম না। পায়ের নিচের মাটি কেমন দুলে উঠল। ভূমিকম্প নাকি? নাকি একবারে কেয়ামত শুরু হয়ে গেল? একেবারেই অপ্রস্তুত আমি পা ওপরে দিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাচ্ছি। ক্যাফের ঝাড়বাতিটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর পড়েই যখন যাচ্ছি, তখন আর ঝাড়বাতির সৌন্দর্য দেখে কী হবে। চোখ বন্ধ করে ফেলে মাটি আছড়ে পড়ার অপেক্ষায় নিজেকে সঁপে দিতে দিতে চরম অবিশ্বাস নিয়ে দেখলাম সেই দেড় ফুটি দাঁতাল বিচ্ছু কোমরে হাত দিয়ে দস্যু বনহুরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মুখে দিগ্বিজয়ী হাসি। তাহলে যত দোষ এই খুদে নন্দ ঘোষের! আমার হাঁটু বরাবর তারই এক মোক্ষম ফ্রি কিকে এখন আমি ঘায়েল টালমাটাল হয়ে ফুটবলের মতো উড়ে পড়ে যাচ্ছি।

কিন্তু না। কী যে হলো বুঝলাম না। কে যেন খুব শক্ত হাতে খপ করে ধরে ফেলল। একেবারে মেঝেতে মাথা ঠুকে যাওয়ার আগ মুহূর্তে। বিস্ময়ে মূক আমি আস্তে আস্তে পিটপিট করে চোখ খুলে দেখি, একি! মাথার ওপর নীল আকাশ। আর সূর্যের তীব্র সোনালি ঝিলিক। আমি কই? পরাবাস্তব জগৎটা ঠুস করে মিলিয়ে গেল কানে আসতেই, ‘ভয় নেই, আমি তো আছি।’ এবার ভালো করে চোখ মেলে দেখি, নীল আকাশ কই, এ তো নীল টুপি। আর সূর্যের ঝিলিকই বা কই, এ তো সোনালি চুলের ঝাঁপি। চোখ পর্যন্ত এসে হানা দিয়ে অন্ধ করে দিচ্ছিল।

ঘোরটা কাটার সুযোগ না দিয়েই লতা আমাকে এক হাতে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিল। আরেক হাত তখনো ক্রাচে ভর দেওয়া। সে যে কখন, কোত্থেকে, কীভাবে ছুটে এল, কিছুই ভেবে পেলাম না। কিন্তু ঝাড়া ছয় ফুটের আশি কিলোর কাউকে হাতে ক্রাচ আর পায়ে প্লাস্টার নিয়েও যে অনায়াসে ধরে তুলে ফেলতে পারে, সে যেমন তেমন মেয়ে না। নাম লতা হলেও এই মেয়ে অন্য ধাতুতে গড়া। ঠোঁটের কোনো নরম আলতো একটা হাসি নিয়ে লতা এবার বলল, ‘কেমন দারুণ ধরে ফেললাম, বলেন তো?’ আমার ভূত দেখা ভয় পাওয়া চেহারা তখনো স্বাভাবিক হয়ে আসেনি। উত্তর না দিয়ে আমি তীব্র দৃষ্টিতে লতার গহিন সবুজ চোখের দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছি। (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন