সাইতামা বাংলা সোসাইটির বার্ষিক বনভোজন
ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে জাপানের সাইতামা বাংলা সোসাইটির উদ্যোগে কানাগাওয়া প্রিফেকচারের খিয়োগাওয়া রিভারল্যান্ডের পাহাড়ি প্রাকৃতিক অরণ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে বার্ষিক বনভোজন। সম্প্রতি এ বনভোজন আয়োজন করা হয়। দুটি বাস ও একটি প্রাইভেট কারে সর্বমোট ১১১ জন এতে অংশগ্রহণ করেন।
আড়াই ঘণ্টার যাত্রাপথে বনভোজন বহরটি হাইওয়ে ছেড়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সরু আঁকাবাঁকা পথে প্রবেশ করলে সবার মধ্যে বনভোজনের আমেজ ভর করে। মন্থর গতিতে চলতে থাকা বাসে বসে গভীর অরণ্যে ভরা সুউচ্চ পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছিল আকাশের মেঘমালাকে ছুঁয়ে গেছে। বাস থেকে নেমে প্রায় দশ-পনেরো মিনিট হেঁটে বহরটি বনভোজন স্থলে পৌঁছায়। চলার পথে পাহাড়ি পিচঢালা আঁকাবাঁকা পথ, সুউচ্চ পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা ও পিচঢালা রাস্তার পাশে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পাহাড়ি প্রাকৃতিক খরস্রোতা ছড়ায় প্রবাহিত পানির রিনিঝিনি শব্দ সবাইকে বিমোহিত করে।
বনভোজনের মূল স্পটটি করা হয়েছে পাশাপাশি তিনটি বিশাল পাহাড় ও খরস্রোতা পাহাড়ি পাথুরে ছড়ার সংযোগস্থলে কৃত্রিমভাবে সমতল ভূমি তৈরি করে। এই স্পটে রয়েছে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য জলাধার, উন্মুক্ত রান্নাঘর, বিশ্রামাগার ও বনভোজনে ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দোকান। অনেকে এই গভীর অরণ্যে ক্যাম্প করে রাতযাপন করেন।
আমাদের বনভোজন বহরটি এই স্পটে ভারী জিনিসপত্র রেখে সবাই গভীর অরণ্যে ভরা সুউচ্চ পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা ও খরস্রোতা ছড়াগুলোর সৌন্দর্য উপভোগে বেরিয়ে পড়েন। প্রকৃতির সৌন্দর্য পিয়াসি বন্ধুরা পাহাড়ি অরণ্যে দেখতে পান হিরোদের ব্যাপক উপস্থিতি। তবে কারওর মধ্যে হিরোদের সঙ্গে সেলফি তোলার আগ্রহ লক্ষণ করা যায়নি। বরং এড়িয়ে চলার মানসিকতাই ছিল স্পষ্ট। তারপরও বেশ কয়েকজন বন্ধু এই জাপানিজ হিরোদের কাছে আক্রান্ত হয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন। এই জাপানিজ হিরোরা গভীর অরণ্যে আমাদের উপস্থিতিকে ভিলেন ভেবেছিল কিনা জানি না! তবে রক্তাক্ত হলেও কেউ উল্টো আক্রমণ অথবা থানা-পুলিশ করার চিন্তাও করেনি। আসলে থানা-পুলিশ করার কথাও না, এরাতো নাটক-সিনেমা অথবা যাত্রা-থিয়েটারের মানব হিরো না। এরা হচ্ছে প্রকৃতির হিরো অর্থাৎ জোঁক। জোঁককে জাপানিজ ভাষায় হিরো বলে। আশ্চর্য হলেও সত্য, জাপানে জোঁক আছে আমাদের সহযাত্রীরা কেউ কল্পনাও করেননি। আমাদের বনভোজন বহরে থাকা দুজন ত্রিশোর্ধ্ব কালের প্রবীণ জাপানপ্রবাসীসহ নবীন বন্ধুরা কেউ জাপানে জোঁক আছে, এমন গল্পও শোনেননি। আমাদের জন্য এই বাস্তবতা ভীতিকর হলেও বিষয়টা ছিল রোমাঞ্চকর ও ব্যতিক্রম এক নতুন অভিজ্ঞতা।
এরই মাঝে দুপুর দুইটায় ক্ষুধার টানে সবাই পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সাময়িক বিরতি টেনে রান্নাস্থলে হাজির হয়ে বাঙালি খাবারের স্বাদ আস্বাদন করেন। খাবারের মেনুতে ছিল বাসমতি চালের ভাত, বিফ কারি, মাটন কারি, রুই মাছ ভাজা, লাউ-চিংড়ির মাষকলাইয়ের ঢাল, চিংড়ি ভর্তা ও সালাদ। পেটের ক্ষুধা মিটলেও চিত্তের ক্ষুধা মিটানোর জন্য অনেকই আবারও অদেখা স্পটগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়েন। তবে আয়োজকদের ঘোষিত সময় পাঁচটার মধ্যে সবাই ফিরতি প্রস্তুতির জন্য বনভোজন স্থলে ফিরে আসেন।
বাসের পার্কিং স্থল থেকে বনভোজন স্পটে পৌঁছার দশ-পনেরো মিনিটের হাঁটা পথে আসা-যাওয়ার সময় সবাই মিলে-মিশে লাকড়ি, বড়-বড় সাইজের হাঁড়ি-পাতিলগুলো এবং শতাধিক লোকের রান্না সামগ্রী বহনের দৃশ্য জাপানিজরা বিমুগ্ধ চিত্তে অবলোকন করেছেন। দু-চারজন এসে আমাদের সমন্বিত প্রয়াসকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন।
বনভোজন স্পটে সবাই কমবেশি আনন্দ করলেও অনেকের দৃষ্টিতে আসা-যাওয়ার পথে বাসে বসে সহযাত্রী বন্ধুদের গান, কৌতুক, আবৃতি ও চুটকিগুলো সুদীর্ঘ বাস জার্নির ক্লান্তি কাউকে স্পর্শ করতে দেয়নি। এটা ছিল সত্যিকার অর্থেই নিখাদ আনন্দ ভ্রমণ। এই বনভোজনে কাইকম সলিউশনস জাপান কোম্পানি লিমিটেডের গিফট কুপন লটারি ও মণিকা মাল্টি ট্রেডিং কোম্পানির বিংগো প্রতিযোগিতার পুরস্কার সবার মাঝে বাড়তি আনন্দের খোরাক জোগায়। তা ছাড়া, যাত্রাপথে সকালের নাশতা ও ফিরতি বাসে বিকেলের নাশতায় রহমান ভাইয়ের ভেজিটেবল শিঙাড়ার স্বাদ সর্বজন প্রশংসিত হয়।
যাত্রার প্রারম্ভে নিরাপদ ও আনন্দময় ভ্রমণের শুভকামনা করে যাত্রার উদ্বোধন করেন সংগঠনের উপদেষ্টা নুরুল হক ও নৌপ্রকৌশলী তাপস বড়ুয়া। সবশেষে বনভোজন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব বনভোজনে অংশগ্রহণকারীদের আন্তরিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তা ছাড়া সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রতিবারের মতো ভবিষ্যতেও সবার সহযোগিতায় বনভোজনসহ বাংলাদেশ ও জাপানের ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উৎসবগুলো পালনের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বনভোজনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
...
মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম: সভাপতি, সাইতামা বাংলা সোসাইটি, সাইতামা, জাপান।