প্রবাসে পুটুদের জীবন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পুটুর জন্মের আগে থেকেই জানতাম পুটু ছেলে হবে। তাই মনে মনে এই নামটা ঠিক করে রেখেছিলাম। এমন অদ্ভুত নামকরণের শানে নজুল বলে নেওয়া দরকার। আমাদের সময় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি প্রথম পত্রের মূল বইয়ের সঙ্গে বাড়তি একটা গল্পের বই পড়তে হতো। আমি মূল পাঠ্যবই না পড়ে ওই বইগুলাই আগে শেষ করতাম। সপ্তম অথবা অষ্টম শ্রেণির কোনো এক গল্পের বইয়ে একটা গল্প ছিল ‘পুটু’ নামে।

পুটু একটা ছাগল ছানা। বাড়ির সবার খুবই আদরের বিশেষ করে গল্পের মায়ের খুবই নেওটা। সারা দিন সেই ছাগল ছানা সারা বাড়িময় বিভিন্ন রকমের দস্যিপনা করে বেড়াত, কিন্তু মায়ের বকুনির ভয়ে তাকে কেউ কিছুই বলত না। মায়ের আদরে যত্নে পুটুর স্বাস্থ্য অন্য সব ছাগলের তুলনায় ভালো ছিল। একদিন গল্পের বাবা পুটুকে বিক্রি করার উদ্যোগ নেয় কিন্তু মায়ের কারণে সেই উদ্যোগ বিফলে যায় ও পুটু বেঁচে যায়। এরপর পুটু ধীরে ধীরে বড় হয়ে একসময় বার্ধক্যে উপনীত হয় ও মৃত্যুবরণ করে। মহেশ গল্পের পরে এই গল্পটা তখন আমার কিশোর মনে অনেক বড় রেখাপাত করেছিল। কারণ আমাদের বাড়িতেও পুটুরই আদলের একটা ছাগল ছানা ছিল। যদিও গল্পের পুটু আর বাস্তবের পুটুর শেষটা একভাবে শেষ হয়নি। সে গল্প অন্য কোনো দিন।

যা হোক, বিয়ের পর আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাদের যদি ছেলে সন্তান হয় তার নাম পুটু রাখব। কিন্তু প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় সেটা আর হয়নি। আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হবে শুনে স্ত্রীকে বললাম ইতিহাসটা। তার তেমন কোনো আপত্তি দেখলাম না। যদিও কালে কালে বাংলা ভাষার বিবর্তনে এখন পুটু আর কোনো নাম না। তারপর পুটু অর্থাৎ আমাদের ছেলের জন্ম হলো। পুটুর জন্মের পর তার গায়ের রং দেখেতো আমার ভিরমি খাবার জোগাড়। যথেষ্ট ফরসা। এই রং আমার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ তৈরি করেছিল এবং সেটা নিয়ে এখনো আমি পুটুর মায়ের সঙ্গে মশকরা করি। পুটু খুব সামান্য সময়েই বুঝিয়ে দিল আব্বা—‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি, আমি তোমারই ছেলে’।

ঘটনাটা খোলাসা করি। হাসপাতালের নার্স ওকে গোসল করানোর জন্য ছোট বাথটবে নামিয়েছে। শুরুতে একটু গাঁইগুঁই করলেও শেষে দেখি সে ব্যাপারটা উপভোগই করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সে হাসপাতালের নার্সের হাতের ওপরেই সেই বাথটবের পানির ওপরে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম এ আমার ছেলে না হয়ে যায়ই না। কারণ আমি পৃথিবীর এমন সব স্থানে এমন সব ভঙ্গিতে ঘুমের রেকর্ড করেছি সেটা নিয়ে লিখলে সৈয়দ মুজতবা আলীর রম্য রচনাও হার মানবে।

এরপর পুটু প্রকৃতির নিয়মেই বড় হতে থাকল। আমি একজন অপদার্থ বাবা হিসেবে ওর জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না। মানুষজন সন্তান হওয়ার বছর খানিক আগে থেকেই কেনাকাটা শুরু করে। সন্তান হওয়ার পর বিভিন্ন অছিলায় অনুষ্ঠান করে। এসব থেকে বাচ্চার প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের জোগাড় হয়ে যায়। আমরা নিজেরাতো তেমন কিছু কিনতে পারলাম না আর অনুষ্ঠান করার মতো পুঁজি বা পরিবেশ কোনোটাই আমার নেই। ক্যানবেরাতে রাজীবের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সানডে মার্কেট থেকে খুব সস্তায় একটা পৃথিবী (গ্লোব) আর একটা গাড়ি সেইসঙ্গে গাড়ির আরোহী দুটি জিরাফ, একটা গেরিলা, একটা মা হাতি আর তার বাচ্চা কিনে আনলাম। কিনতে গিয়ে দেখি পকেটে টাকা নেই। মামুন ভাইয়ের কাছ থেকে অফেরতযোগ্য ধার নিলাম। পুটুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খেলনাগুলো ওর খুবই প্রিয় হয়ে উঠল বিশেষ করে গ্লোবটা। সে সারা দিন সেটা নিয়ে মনের আনন্দে খেলে বেড়ায়। আমি মনে মনে চাই ও ঠিক এভাবেই একদিন পুরো পৃথিবী চষে বেড়াবে আর কপালে থাকলে হয়তো মহাবিশ্বের অন্য কোথাও যেতে পারে।

পুটুর চরিত্রের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে লক্ষণীয় বস্তু হচ্ছে ওর হাসি। এই বয়সেই পুটু বিভিন্ন রকমের হাসি রপ্ত করে ফেলেছে। যেমন; মায়ের কোলে উঠতে চাইলে এক রকমের হাসি। কোনো ব্যাপারে খুবই খুশি, সেটার হাসি আবার অন্য রকম। যখন কোনো কিছু পছন্দ হচ্ছে না, তখন মলিন হাসি। সবাই বলে বাবার হাসি পেয়েছে। যার হাসিই পাক কারণে অকারণে হাসতে পারা পৃথিবীর বুকে আমার চোখে সবচেয়ে বড় গুণ। এরা হাসতে হাসতেই পৃথিবীর যেকোনো বাধা অবলীলায় পার হয়ে যায়। আশা করি আমাদের পুটু একদিন সব বাধা ডিঙিয়ে পরিপূর্ণ মানবিকতা সমৃদ্ধ মানুষ হয়ে উঠবে।

একসময় পুটু হামাগুড়ি দিতে শিখে গেল এবং সারা ঘরময় তার অবাধ বিচরণ শুরু করে দিল। কিন্তু আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম কখন না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। কারণ দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার মতো অনেক কিছুই সারা ঘরময় ছড়ানো। টুনটুনির বাপের বাসা এর চেয়ে আর কত ভালো হবে। আদর করে আমরা আমাদের মেয়ে তাহিয়াকে টুনটুনি বলে ডাকি। আমি অফিস থেকে ফিরে দরজায় নক করলেই ঘরের মধ্যে সে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিত আর এখন চাইল্ড কেয়ারের বাসার দরজায় নক করলেই একই রকমভাবে লাফালাফি শুরু করে। আমি কোলে না নেওয়া পর্যন্ত ঘরে শান্তি ফিরে আসে না। কারণ সে জানে এখন আব্বা এসেছে। একবারের জন্য হলেও দরজা খোলা হবে আর সে তার ঔৎসুক্য চোখ দিয়ে রাস্তা দিয়ে কে বা কারা চলাফেরা করছে সেটা দেখবে।

পুটুকে কখনো ঘুম পাড়ানোর দরকার হলে কাঁধের ওপর ওর মাথা রেখে পিট চাপড়াই আর একে একে আমার হেঁড়ে গলায় আবৃতি করতে থাকি— হাট্টিমা টিম, মামার বাড়ি, খোকন খোকন ডাক পাড়ি, আম পাতা জোড়া জোড়া, আমি হব সকাল বেলার পাখি। ছোট নদী, আমাদের গ্রাম আরও অনেক ছড়া। সেগুলো শুনতে শুনতে একসময় পুটু কাঁধের ওপরই ঘুমিয়ে পড়ে। ইদানীং একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি আমি যখন ওকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ওর পিঠ চাপড়াই একইভাবে সেও আমার পিঠে চাপড় দেয়। একেই বোধ হয় বলে বাপকা ব্যাটা? অফিস বা বাইরে থেকে কখনো ফোনে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বললে সে নাকি খুবই মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনার চেষ্টা করে। আমি তখন ফোনের অপর পাশ থেকে হাট্টিমা টিম আবৃতি করে শোনাই। এতে নাকি সে অনেক খুশি হয়। এইভাবে হাট্টিমা টিম আমাদের জাতীয় ছড়ায় পরিণত হয়েছে।

এখনকার প্রজন্ম বেড়ে উঠবে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ধ্যানধারণা নিয়ে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে বাবা-মাকে খুব বেশি একটা কিছু করতে হয় না। তারপরও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি সুকুমার মানবিক গুণগুলো এই ছোট বয়স থেকেই ওদের মধ্যে তৈরি করে দেওয়ার জন্য। সে ইতিমধ্যেই মাঠ-ঘাট চষে এক করে ফেলেছে। যেটা সাধারণত অন্য বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঘটে না। এই কম বয়সেই বেশকবার বাংলাদেশ থেকেও ঘুরে এসেছে। এখন তার সবচেয়ে পছন্দের খেলনা হচ্ছে ল্যাপটপ। কারণ ল্যাপটপের স্ক্রিনের রঙের খেলাটা ওর খুবই পছন্দ। আমি যদি বুদ্ধি করে লগ আউট করে দিই তাহলে আর সে ল্যাপটপের কাছে আসে না। কারণ তখন আর রং বদলায় না।

এক অধম বাবা হিসেবে আমি ছেলেকে একটা স্বাভাবিক জীবন দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যে জীবনে থাকবে হাসি, কান্না, সুখ, আনন্দবেদনার এক অপূর্ব মিশ্রণ। আর অবশ্যই থাকবে অভাব। কারণ অভাব মানুষকে বিনয়ী করে। ওর মধ্যে যেন কোনোভাবেই অহংকার আর গোঁড়ামি বাসা না বাঁধে। পুটু সময়ের পরিক্রমায় একেকটি বছর পার করছে এই ধরনীর বুকে। এ উপলক্ষে আমরা কোনো আয়োজন করি না। আর পুটুর কাছে আমরা সব সময়ই ক্ষমা প্রার্থনা করি ওকে দাদা–দাদি, নানা–নানি, চাচা–চাচি, মামা–খালাদের আদর থেকে বঞ্চিত করার জন্য। ছোট বয়সে বাংলাদেশের বাচ্চারা যখন আত্মীয়স্বজনদের কোলে কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ায় পুটু তখন এক চাইল্ড কেয়ার থেকে অন্য চাইল্ড কেয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে করে ওর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধির কোনো তারতম্য না হলেও ও এখন পর্যন্ত কোনো ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি।

আমার ধারণা ওর মস্তিষ্ক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আমরা বাসায় বাংলাতে কথা বলি। কিন্তু টিভি বা ল্যাপটপের কার্টুনের ভাষা ইংরেজি। সব মিলিয়ে ও অর্থহীন কিছু শব্দ করে আমাদের জানান দেয় ওর কিছু একটা লাগবে। আমরা না বুঝলে সে আমাদের হাত ধরে সেই প্রয়োজনীয় বস্তুর কাছে নিয়ে যায়। প্রবাসী প্রায় সকল বাচ্চারই বেড়ে ওঠাতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে একেকটা একক পরিবার তৈরি হচ্ছে আর বাচ্চাগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে একেবারে আত্মীয়স্বজনহীন পরিবেশে বাচ্চাদের বৃদ্ধি কোনোভাবেই স্বাভাবিক হয় না। বিদেশ হয়তোবা তাদের সামাজিক আর্থিক নিরাপত্তা দিচ্ছে কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার উপাদানগুলোর অভাব থেকেই যাচ্ছে। এটা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।
...

ইয়াকুব আলী: সিডনিপ্রবাসী। ইমেইল: <[email protected]>