নীল কুমুদিনীর নৃত্য-পাঁচ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিব সাধারণত সারা সপ্তাহের জন্য রোববারে রান্না করে রাখে। রান্না করে ছোট ছোট কন্টেইনারে করে ফ্রিজে রেখে দেয়। অফিস থাকলে রাকিব সব সময় দুপুরের খাবার বাইরেই খায়। অফিসের পাশেই ম্যাকডোনাল্ডস বা বার্গার কিং ফার্স্ট ফুডের রেস্টুরেন্ট আছে। এ ছাড়া অফিসের ঠিক নিচেই একটা বেকারি আছে। ওখানে বেশ ভালো স্যান্ডউইচ পাওয়া যায়। দুপুরের খাবার নিয়ে সে কখনোই চিন্তা করে না। সকালেও রাকিব মাঝেমধ্যে ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল খেয়ে যায়। কখনো আবার শুধু এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে অফিসে চলে যায়। অফিসের ফাঁকে এক সময় একটা স্যান্ডউইচ বা পাই দিয়ে নাশতাটা সেরে নেয়। কখনো বা সকালের নাশতা না করে একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়।

রাকিব রাতের খাবারের ব্যাপারে একটু বাছ-বিচার করে। রাতে সে বাসায় খেলে বেশ আয়াস করে খায়। রেস্টুরেন্টে খেলেও ওসব ফার্স্ট ফুডের রেস্টুরেন্টে না খেয়ে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে খায়। কখনো কুক বার অ্যান্ড গ্রিলে চলে যায়। কখনো আবার কারি পট সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। তবে রাতে বাসায় নিজের রান্না করা খাবার খেতেই বেশি পছন্দ করে।

কিন্তু রাকিব আজ শনিবারেই রান্না করতে বসেছে। এর পেছনে অবশ্য কোনো কারণ নেই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দিনে বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না বলেই আজ রান্নাটা করে ফেলছে। নদী আসলে অবশ্য অন্য কথা ছিল।

রাকিব আজ আলু দিয়ে ঝুল ঝুল করে গরুর মাংস, ক্যাসোবার ডাল ও বাঁধাকপির ভাজি করছে। যদিও সকাল থেকে তার খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু রাকিব রাইস কুকারে সাদা ভাত বসিয়েছে। এদিকে তার এক চুলায় বাঁধাকপি ভাজি প্রায় হয়ে এসেছে। অন্য চুলায় ক্যাসোবার ডালটা লো-হিট দিয়ে বসিয়েছে। বড় চুলাটায় বসিয়েছে আলু দিয়ে ঝুল ঝুল করা গরুর মাংস। গরুর মাংসও প্রায় হয়ে এসেছে। ঠিক তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইলটা কিচেনের বেঞ্চটপের ওপর রাখা।

রাকিব ভাবল, নদীর ফোন নয় তো? তার ভেতরটা একটু নড়ে উঠল। কিন্তু মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল ছোট ফুফু আবার ফোন দিয়েছেন। রাকিব মনে মনে একটু হতাশই হলো। তবে ছোট ফুফু আবার ফোন দেওয়াতে রাকিব এবার একটু অবাক হলো। সকালেই তার সঙ্গে দুবার কথা হয়েছে। আবার কেন?

রাকিব সরাসরি জিজ্ঞেস করল, হ্যালো ছোট ফুফু, তুমি আবার ফোন দিয়েছ কেন?

ছোট ফুফু জিজ্ঞেস করলেন, কেন, অসুবিধা আছে নাকি?

: না, অসুবিধা নেই। সকালেই না দুবার ফোন দিলে?

: একটা দরকারেই ফোন দিয়েছি। তুই কি ব্যস্ত?

: হ্যাঁ, ব্যস্ত। তুমি কিছু বললে তাড়াতাড়ি বলতে হবে।

: কেন, কী করছিস?

: রান্না করছি।

: কী রান্না করছিস?

: আলু দিয়ে গরুর মাংস, ক্যাসবার ডাল ও বাঁধাকপির ভাজি।

: ক্যাসবার ডাল?

: হ্যাঁ, ফিজি ক্যাসবার ডাল।

: আমি জানি। আমাদের এখানেও পাওয়া যায়। ক্যাসবাটা কি জানিস?

: না, ঠিক জানি না।

: আমাদের বাংলাদেশে যেটাকে পেস্তা আলু বলে। মাটির নিচে যেটা হয়।

: ও, আচ্ছা। বাংলাদেশে তো পেস্তা আলু শক্ত হয়। মাংস দিয়েও রান্না করে। এখানে এত নরম কেন?

: ফ্রোজেন কিনিস বলে। পানি ঢুকে যায়। তাই রান্না করার সময় ছেড়ে দেয়।

: হুম, মনে হয় তাই।

: আচ্ছা, বাদ দে ওসব কথা। আসল কথা বলি। তোর মা দুবাই থেকে ফোন দিয়েছিল।

: মাতো সকালেই আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। এখন আবার তোমাকে কেন?

: কেন, ফোন কী শুধু তোকেই দেবে?

: ছোট ফুফু, ওসব কথা বলো না তো! মা কেন ফোন দিয়েছিলেন?

: তোর বিয়ের জন্য।

: আমার বিয়ে!

: হ্যাঁ, তোর বিয়ে। তোর হাফ ব্রাদার নয়নকে বিয়ে করাবে। অলরেডি পাত্রী পছন্দ করা আছে। মেয়ে অস্ট্রেলিয়াতেই লেখাপড়া করে। তবে বিয়ে দেশে হবে। কিন্তু এর আগে তোর মা তোকে বিয়ে করাতে চাচ্ছে।

রাকিব চুপ হয়ে গিয়ে বলল, হুম।

ছোট ফুফু বললেন, তোর মা নাকি তোকে বলার সাহস পাচ্ছে না।

: আমাকে বলার সাহস পাচ্ছেন না, কেন?

: আমি জানব কীভাবে? তবে আমার মনে হচ্ছে, তোর মা তোকে বলার সাহস পাচ্ছে না, ওটা সে ভুল বলছে। আসলে সে লজ্জা পাচ্ছে।

রাকিব বলল, তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু বললে তুমি মাকে বলবে আমার সঙ্গে যেন সরাসরি কথা বলেন। আর তুমি নিজ থেকে যদি কিছু বলতে চাও তাহলে বলো, আমি এখন বিয়ে করার কথা মোটেও চিন্তাভাবনা করছি না।

ছোট ফুফু জোর দিয়ে বললেন, কেন রে? তোর কি বিয়ের বয়স হয়নি?

: এটা বিয়ের বয়স নিয়ে কথা নয়। আমি তো একবার বিয়ে করেছিই।

: দেখ, তোর আগে তোর হাফ ব্রাদার বিয়ে করে ফেলবে। সে তোর চেয়ে কত ছোট? দুই দিন পর আমার পুত্রধনও বিয়ে করবে।

: ওরা মনে করছে, ওদের সময় হয়েছে। আমি মনে করছি, আমার সময় হয়নি। এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

: তোর মা যেহেতু আছে, তাকেও একটা ডিসিশন নিতে দে।

রাকিব গম্ভীর গলায় বলল, ছোট ফুফু, আমি এখন রাখি। আমার তরকারি পুড়ে যাচ্ছে।

ছোট ফুফু বললেন, তুই আসলেই একটা গাধা।

রাকিব কিছু না বলে ফোন কেটে দিল। ফোন কেটে দিয়েই সে ক্যাসবার ডালের পাত্রে কাঠি দিয়ে নাড়ল। গরুর মাংসের পাত্রে ঝোল টইটম্বুর হয়ে উঠেছে বলে সে আর সেটাতে নাড়া দিল না। বাঁধাকপির ভাজি আগেই রান্না হয়ে গেছে।

রাকিব মাংসের চুলাটা একেবারে কমিয়ে দিল। ক্যাসবার ডালও হয়ে এসেছে। ক্যাসবা এত নরম যে এক বলকেই হয়ে যায়। রাকিব ডালের চুলাটা একেবারেই বন্ধ করে দিয়ে ঘড়ি দেখল। প্রায় একটা বাজে।

রাকিব আবার ঘড়ি দেখতে দেখতে ভাবল, আপাতত সে গোসল করবে। রাকিব মাংসের পাতিল থেকে একটা মাংস নিয়ে চেখে দেখল। মাংস পুরোপুরি সেদ্ধ হয়েছে। রাকিব মাংসের চুলাটাও বন্ধ করে দিল। তারপর মোবাইল হাতে বাইরের বৃষ্টিটা ভালো করা দেখার জন্য লাউঞ্জে এল। জানালা গলে রাকিব বাইরে তাকাল। বাইরে তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে হালকা ঝোড়ো বাতাস। গাছপাতার জল পড়ছে বেশি টুপ টাপ, টুপ টাপ।

রাকিব জানালা থেকে সরে এল। কিন্তু সরে এসেই রাকিব হঠাৎ কী একটা দেখে আবার বাইরে তাকাল। বৃষ্টির ভেতর দিঘল ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটের দিঘল ফুটপাত ধরে ছাতা মাথায় একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ছাতা মাথায় বলে মেয়েটার চেহারাটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না।

রাকিবের হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটা নদী নয়তো? কিন্তু নদী হলে তো এভাবে ছাতা মাথায় নিজেকে আড়াল করে চলে যেত না। অভিমান করে তার বাসায় না আসুক, তার বাসার দিকে অন্তত তাকাত?

রাকিব দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেল। কিন্তু মেয়েটার হাঁটাচলা দেখে বোঝা যাচ্ছে নদীই। কিন্তু নদী কেন তার বাসার সামনে দিয়ে এভাবে হেঁটে চলে যাবে? এতটা অভিমানী নদী হয়েছে?

রাকিব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই মেয়েটা দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।

রাকিব দ্বিধা নিয়েই জানালা থেকে সরে এল। তারপর সরাসরি বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। শেভ করে মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে বেশ সময় নিয়ে গোসল করল। গোসল শেষে একটা টি শার্ট ও থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে রাকিব কিচেনে এল। নদী এলে বা আসার কথা থাকলে অবশ্য অন্য কথা ছিল। প্যান্ট-শার্ট পরে তৈরি হয়ে থাকত। আপাতত আজ রাকিব বের হবে না। অনেক দিন ধরে রাকিব দুপুরে ঘুমায় না। আজ দুপুরের খাবার খেয়ে রাকিব ঘুমাবে।

খাবার প্লেট নিতে নিতে রাকিব আবার ঘড়ি দেখল। ঠিক তখনই আবার মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাকিব দেখল, ছোট ফুফু আবার ফোন দিয়েছেন। ফোন না ধরে রাকিবের কেটে দিতে ইচ্ছে হলো। এ একটা সমস্যা ছোট ফুফুর। তিনি যখন ফোন দেন তখন কোনো কারণ ছাড়াই একদিনে তিন-চারবার ফোন দেন। আবার যখন ফোন দেন না, তখন দুই-তিন মাসেও একবারও ফোন দেন না। তার আরেকটা সমস্যা, তাকে প্রয়োজনের সময় খুঁজেও পাওয়া যায় না। না মোবাইলে, না ল্যান্ড নম্বরে। তিনি তখন ইচ্ছে করেই ফোন ধরেন না।

রাকিব ফোন ধরবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে কী ভেবে ফোন ধরল। একটু গম্ভীর গলায় বলল, আবার ফোন দিয়েছ কেন?

ছোট ফুফু ফোনের ওপাশে একটু তাচ্ছিল্যের গলা করে বললেন, ও, আমি আরেকজনকে ফোন দিতে গিয়ে ভুল করে তোকে ফোন দিয়ে ফেলেছি। কে তোর মতো গাধাকে ফোন দিতে যায়? বলেই তিনি লাইনটা কেটে দিলেন।

রাকিব ছোট ফুফুর এই ফোন কেটে দেওয়ায় অবাক হলো না। বরং মনে মনে হাসল। রাকিব জানে, কতক্ষণ আগে সে ফোনের লাইনটা কেটে দিয়েছিল বলে ছোট ফুফু এখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফোন দিয়ে লাইনটা কেটে দিয়েছেন। ছোট ফুফুর এসব ছোট মন দেখতে দেখতেই রাকিব বড় হয়েছে।

মোবাইলটা আবার বেঞ্চটপের ওপর রেখে রাকিব প্লেটে পরিমাণ মতো ভাত ও ঝোলসহ গরুর মাংস নিল। সঙ্গে একটু বাঁধাকপির ভাজিও নিল। ডাইনিং টেবিলে বসে রাকিব বেশ আয়াস করে খেতে শুরু করল। নিজের রান্না বলে কথা নয়, তার রান্নাটা আজ বেশ ভালোই হয়েছে। রাকিব খাবারের প্লেটে আরেকটু ভাত নিয়ে ক্যাসবার ডালও নিল। খাওয়া যখন প্রায় শেষ ঠিক তখনই রাকিব দরজায় কারও কড়া নাড়ার শব্দ পেল। তার হঠাৎ মনে হলো, নদী এসেছে। একটু ব্যস্ত হয়েই গিয়ে দরজা খুলল। আর দরজা খুলেই রাকিব দেখল, প্রফেসর নিকোলাস রজারসন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

প্রফেসর রজারসনকে দেখে রাকিব বেশ অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি! আমার বাসায়?

প্রফেসর রজারসন বললেন, হ্যাঁ, আমাকে একটা প্রয়োজনে আসতে হলো।

রাকিব বলল, জি, আগে ভেতরে আসুন স্যার।

প্রফেসর রজারসন ভেতরে ঢুকে বললেন, তুমি মনে হয় খাচ্ছিলে। তুমি আগে খেয়ে নেও। তারপর আমি তোমার সঙ্গে জরুরি আলাপটা করব।

রাকিব বলল, আমার খাওয়া শেষ স্যার। আপনি বসুন। আমি হাতটা ধুয়ে আসি।

প্রফেসর রজারসন সায় দিয়ে সোফায় বসলেন। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1561206