নীল কুমুদিনীর নৃত্য-ছয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রফেসর রজারজন যে এভাবে ভাত খেতে রাজি হয়ে যাবেন, রাকিব প্রথমে ভাবতে পারেনি। এমনই সৌজন্যের খাতিরে রাকিব তাঁকে দুবার অনুরোধ করেছিল। প্রথম তিনি গররাজি হলেও দ্বিতীয়বার তিনি একবাক্যেই রাজি হয়ে গেলেন। খেতে বসে বললেন, বুঝেছ রাকিব, নদীকে নিয়ে আর পারা গেল না। সে আমাকে রেঁধে খাইয়ে তোমাদের খাবারের প্রতি আসক্তির সৃষ্টি করে ফেলেছে। আই অ্যাম রিয়েলি স্পয়েলড নাউ। তোমাদের খাবার দেখলে আমার নেশা পেয়ে যায়।

রাকিব প্রফেসর রজারসনের পাশের চেয়ারে বসে তাঁর খাওয়া দেখছে। তিনি হাত দিয়ে খাচ্ছেন না। চামচ দিয়েই তরকারিগুলো ভাতের সঙ্গে মিলিয়ে খাচ্ছেন। তারপরও তাঁর খাওয়ার মধ্যে একধরনের মুগ্ধতা আছে। তিনি গরুর মাংস চাবাচ্ছেন শব্দ করে, দাঁতে দাঁত ঘষে। দাঁতে দাঁত ঘষার একধরনের শব্দ হচ্ছে—খয়চ-খয়চ, খয়চ-খয়চ।

প্রফেসর রজারসন মুখে ভাত রেখেই বললেন, তোমার রান্নাতো দারুণ।

রাকিব লজ্জা পেয়ে বললেন, কী যে বলেন স্যার!

: না না, আমি সত্যি বলছি। আমি বহু ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়েছি। লন্ডনে সেমিনারে গিয়ে ইস্ট লন্ডনে বাঙালি রেস্টুরেন্টগুলোতেও খেয়েছি। কিন্তু তোমার রান্নাটা একটু অন্যরকম।

: আসলে এ দেশি কাস্টমার ধরার জন্য রেস্টুরেন্টগুলোতে স্পাইসি বেশি দেয়। বিভিন্ন সস দিয়ে ভরে রাখে। ওগুলো রিয়েল ইন্ডিয়ান খাবার না।

: তুমি রান্না কোথায় থেকে শিখেছ?

: দীর্ঘদিন ব্যাচেলর থাকলে রান্না এমনিতেই শেখা হয়ে যায়।

: নদীকে একটু শিখিয়ে দিয়ো।

: কেন, সে কি ভালো রান্না করে না?

: চেষ্টা করে। মনে প্রাণেই চেষ্টা করে। তবে একটা মজার কথা বলি। তুমি কিন্তু নদীকে বলে দিয়ো না।

: কী কথা স্যার?

: সে রান্না করতে করতে আমার অর্ধেক ক্ষুধা মিটে যায়। হা হা হা!

রাকিবও শব্দ করে হাসল। বললে, নদী খুব স্লো রান্না করে। আপনার বাসায় সেদিন যা দেখলাম। কিমা দিয়ে নুডলস ও সসেচ ভাঁজতেই দুই ঘণ্টা লাগিয়ে দিয়েছে।

প্রফেসর রজারসন হাসি ধরে রেখেই বললেন, তুমি একদিনই বুঝে গেছ। আমি তো গত দুই বছর ধরে দেখছি। তবে একটা কথা কী, নদী খুব ভালো মেয়ে। আমি গডের কাছে মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করি, সে আমার আপন মেয়ে হয়ে জন্মাল না কেন?

: আপনি গডের কাছে জিজ্ঞেস করেন?

: ঠিক জিজ্ঞেস করি না। প্রার্থনা করি আর কী!

রাকিব প্রফেসর রজারসনের কথায় হাসল। রাকিব হাসলেও তার ভেতর লজ্জা এসে ভিড় করল। এই লজ্জাটা কীসের, তা রাকিব জানে। সে নদীকে ভুল বুঝেছিল।

প্রফেসর রজারসন ডালের বাটি থেকে ডাল নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কীসের ডাল?

রাকিব বলল, ক্যাসবার ডাল।

: ফিজি ক্যাসবা?

: জি স্যার।

: এটা দিয়ে ডালও রান্না করা যায়?

: শুধু ডাল নয় স্যার। মাংস দিয়েও রান্না করা যায়।

: আমরা তো শুধু সিদ্ধ করে খাই।

: আমি জানি স্যার।

প্রফেসর রজারজন চামচে ডাল আর ভাত মিশিয়ে মুখে দিয়েই বললেন, আরে বাব্বা, তোমার গুণের সীমা নেই। আই অ্যাম ইমপ্রেসড। রিয়েলি ইমপ্রেসড। ক্যাসবা দিয়ে এত চমৎকার ডাল রান্না করা যায়?

রাকিব কোনো জবাব না দিয়ে হাসল শুধু। খানিকটা লজ্জার হাসি। খানিকটা ভালো লাগার হাসি।

: তবে তোমার ক্যাসবার ডালটা বাকি দুটো তরকারির চেয়ে একটু ঝাল হয়েছে।

: জি স্যার। আমিও খেতে গিয়ে টের পেয়েছি। ডালে কাঁচা মরিচ দিয়েছি। কাঁচা মরিচটা ঝাল একটু বেশি ছিল।

: এ জন্যই তো ডালটা সবচেয়ে বেশি মজা হয়েছে।

: তাই স্যার!

: হ্যাঁ। বলেই প্রফেসর রজারসন একটু থামলেন। চামচে আরেকটু ডাল নিলেন। তারপর কী ভেবে বললেন, রাকিব, আমি কিন্তু খুব ঝাল খেতে পারি। আমি ঝাল খাওয়ার একটা গল্প বলি।

রাকিব আগ্রহ নিয়ে বলল, জি বলুন।

প্রফেসর রজারসন মুখের ভাত শেষ করে বলতে শুরু করলেন, আমি তখন ইস্ট লন্ডনে। একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করার জন্য গিয়েছিলাম। সেমিনার শেষে আমাকে একটা ভালো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার লন্ডনের দুই বন্ধুকে বলি। ওরা আমাকে ইস্ট লন্ডনে এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। বাঙালি রেস্টুরেন্ট বলতে তোমাদের বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট। ওখানে সব বাঙালিরাই তাদের রেস্টুরেন্টগুলো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নাম দিয়ে চালায়। সেই বাঙালি রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে আমি এত অভিভূত হই যে, পরদিন আমি ট্যাক্সি নিয়ে আবার সেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজির হই। কিন্তু রেস্টুরেন্টে হাজির হয়ে মাথায় একটা ভূত চাপে, আজ ঝাল খাবার খাব। ভূত চেপেছে তো আর কী! ওয়েটার কাছে আসতেই বলি, তোমাদের সবচেয়ে ঝাল খাবারটা নিয়ে আস।

ওয়েটার সাদা ভাতের সঙ্গে বিফ ভিন্ডালো নিয়ে আসে।

আমি বলি, এটা ঝাল না, আরও বেশি ঝাল।

ওয়েটার আরও ঝাল দিয়ে নিয়ে আসে।

আমি আবার খেয়ে বলি, এ আর কী ঝাল, বাটিটা নিয়ে যাও। আরও বেশি ঝাল করে নিয়ে আস।

ওয়েটার আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। সে বিফ ভিন্ডালোর বাটিটা ভেতরে নিয়ে যায়। লাল টকটকে মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে নিয়ে আসে।

আমি বলি, এবারও ঝাল হয়নি।

ওয়েটার পরে আর কোনো দিশা না পেয়ে ভেতরে গিয়ে রেস্টুরেন্টের মালিককে নিয়ে আসে।

রেস্টুরেন্টের মালিক আমার টেবিলের কাছে এসে বিনীত হয়ে বলেন, এর চেয়ে বেশি ঝাল আমি আর দিতে পারব না।

আমি বলি, এক শ পাউন্ড বেশি দেব, আপনি আরও ঝাল দিয়ে নিয়ে আসেন।

রেস্টুরেন্টের মালিক লোভে পড়ে আরও ঝাল দিয়ে নিয়ে আসে।

কিন্তু আমি তারপরও বলি, এবারও ঝাল হয়নি!

রেস্টুরেন্টের মালিক তখন বাধ্য হয়ে বলেন, আপনাকে আর এক শ পাউন্ড বকশিশ দিতে হবে না। আপনি আমার খাবারের বিলও দেওয়ারও দরকার নেই। আপনি দয়া করে আমার রেস্টুরেন্ট থেকে চলে গেলেই ভালো হয়...!

রাকিব জিজ্ঞেস করল, আপনি তারপর কী করলেন?

প্রফেসর রজারজন বললেন, আমি ভাব নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে চলে এলাম।

: খাবারের বিল না দিয়েই?

: হ্যাঁ, খাবারের বিল না দিয়েই।

: বলেন কী, আপনি পারলেন?

: হ্যাঁ, পেরেছি। আমাকে ঝাল খাবার খাওয়াতে পারেনি। আমি চলে আসব না কী করব?

: তবুও...বিলটা তো অন্তত দিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল।

: আসলে কী জানো, আমি মনে মনে বিল দেওয়ার চিন্তা করেছিলাম। সামান্য কয়টা পাউন্ডই তো। কিন্তু মজার ব্যাপার হয়েছিল, রেস্টুরেন্টের মালিক সেদিন আমার সঙ্গে এমন আচরণ শুরু করেছিলেন যেন তিনি আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারলে বাঁচেন। হা–হা–হা!

: হুম, আমি হয়তো পারতাম না।

: তুমি আমারটা পারলে তো তুমি হতে রজারসন আর আমি হতাম রাকিব।

: আমি অবশ্য ওটা মিন করে বলিনি।

: আমি জানি। আমি আরেকটা গল্প বলি। তুমি তো জানোই, আমাদের নিউজিল্যান্ডের মানুষের টিপস বা বকশিশ দেওয়ার মোটেও অভ্যাস নেই। আমি বছর কয়েক আগে সিডনি গিয়েছিলাম একটা কনফারেন্সে। কনফারেন্স শেষে এক সন্ধ্যায় আমি স্যুট-টাই পরে, ব্যাচটা ঝুলিয়েই রাতের খাবার খেতে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে যাই। সেটা অবশ্য রিয়েল ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টই ছিল। বাংলাদেশি না। সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। খাবার শেষে চুয়াল্লিশ ডলার নব্বই সেন্ট বিল আসে। আমি ওয়েটারকে পঞ্চাশ ডলারের একটা নোট দিই। নোটটা দিয়ে চেঞ্জের জন্য টেবিলেই বসে থাকি। কিন্তু ওয়েটার পাঁচ ডলার দশ সেন্ট আর নিয়ে আসে না। আসলে অস্ট্রেলিয়াতে রেস্টুরেন্টে টিপস বা বকশিশ দেওয়ার খুব রেওয়াজ আছে। তুমি হয়তো জানো যেটা।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জি।

প্রফেসর রজারসন বললেন, আমি কিউই। নিউজিল্যান্ডার। আমি বকশিশ দিতে যাব কোন দুঃখে? আমি ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, বসিয়ে রেখেছ কেন, আমার চেঞ্জ কোথায়?

ওয়েটার বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, কীসের চেঞ্জ?

আমি ওয়েটারকে বলি, তোমাকে তো পঞ্চাশ ডলার দিলাম। খাবারের বিল তো চুয়াল্লিশ ডলার নব্বই সেন্টস এসেছে। বাকি চেঞ্জ?

ওয়েটার অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, জি স্যার, আমি নিয়ে আসছি।

আমি একটু কঠিন গলায় বলি, হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি নিয়ে আস।

ওয়েটার কাউন্টারে চলে যায়। ওখানে গিয়ে সে কী বলে আমি অবশ্য তা শুনতে পাইনি। তবে আমি লক্ষ্য করে দেখি, কাউন্টারে বসা ম্যানেজার কয়েকবার ঘাড় উঁচিয়ে আমার দিকে তাকায়। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেও নির্বিঘ্ন। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার পাঁচ ডলার নিয়ে আসে। আমি পাঁচ ডলার হাতে নিয়ে বলি, আর দশ সেন্টস?

ওয়েটার যেন এবার আকাশ থেকে পড়ে। আমার পরনের স্যুট-কোট ও কনফারেন্সের ব্যাচ দেখে কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, আমি তার কাছে দশ সেন্টস চাচ্ছি।

আমি তাকে গম্ভীর গলায় বলি, গো অ্যান্ড হারি আপ। আমার দশ সেন্টস নিয়ে আস।

ওয়েটার দুই-তিন বার আমার দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে কাউন্টারে ম্যানেজারের সঙ্গে কী যেন আলাপ করে। কিছুক্ষণ পর দেখি ম্যানেজার স্বয়ং নিজে এসে আমার টেবিলের কাছে হাজির হয়। জিজ্ঞেস করে, স্যার কী কোনো সমস্যায় পড়েছেন?

আমি বলি, আমি কোনো সমস্যায় পড়িনি। আমি আমার দশ সেন্টস ফেরত চাচ্ছি।

ম্যানেজার চোখ ছোট করে বলে, আপনি দশ সেন্টস ফেরত চাচ্ছেন?

আমি ভাব নিয়ে বলি, হ্যাঁ।

ম্যানেজার তাচ্ছিল্যের গলায় আবার বলে, দশ সেন্টস?

আমি বলি, হ্যাঁ, দশ সেন্টস। কোনো অসুবিধা?

ম্যানেজার বিরক্তির গলায় বলে, জি না। কিন্তু!

আমি ম্যানেজারের কথা ভাব বুঝেই বলি, শোনেন, দশ সেন্টস হয়তো আপনার কাছে কিছু না। কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। আমি নয় শ নিরানব্বই ডলার নব্বই সেন্টসের সঙ্গে এই দশ সেন্টস মিলিয়ে এক হাজার ডলার করে আপনাদের দেশের গরিবদের জন্য পাঠাব।

রাকিব প্রফেসর রজারসনের কথাটা টেনে নিয়ে বলল, স্যার, ওটা অবশ্য একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল।

প্রফেসর রজারসন বললেন, আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হবে। তবে দৃষ্টিটা একটু গভীরে নাও। তাহলে আমার কথাটার যুক্তি খুঁজে পাবে।

রাকিব কিছু না বলে চুপ হয়ে গেল। সে আজ প্রফেসর রজারসনের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়ে অযথা কথা বাড়াতে চায় না।

প্রফেসর রজারসন কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই রাকিবের মোবাইলটা বেজে উঠল।

রাকিবের মোবাইলটা কিচেনের বেঞ্চটপের ওপর। রাকিব ভাবল, ছোট ফুফু আবার ফোন দেননি তো? ছোট ফুফুর এ একটা সমস্যা। কোনো কারণে রাগ হলে ঝাল না মিটানো পর্যন্ত বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করবেন।

রাকিব চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে প্রফেসর রজারসনের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার, আমি মোবাইলটা ধরতে যাচ্ছি।

প্রফেসর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ–হ্যাঁ।

রাকিব কিচেনের কাছে এসে বেঞ্চটপের ওপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়েই দেখল, নদীর ফোন।

রাকিবের ভেতরটা কেঁপে উঠল। নদীর ফোন! তার তৎক্ষণাৎ মনে হলো, নদী যেন কত দিন পর ফোন তাকে দিয়েছে! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1561340