জবাব দেওয়া যখন প্রয়োজন

লেখিকা
লেখিকা

উচ্চশিক্ষার জন্য সিডনি যাব। অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনে গিয়েছি ভিসা ফরম নিতে। এটা ২০১০ সালের কথা।

যে ভদ্রলোক ফরম দিচ্ছেন, তিনি প্রচণ্ড খারাপ ব্যবহার করলেন। মহাব্যস্ত ভদ্রলোক, আমাকে দেখে যেন তার বিরক্তি আর ব্যস্ততা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল। যেভাবে তিনি অতি দ্রুত আমাকে ফরম দিয়ে তার সঙ্গে আর কী–কী লাগবে জানালেন, তার অর্ধেকও আমি বুঝতে পারলাম না। খুবই বিনয়ের সঙ্গে তাকে বললাম, আরেকবার বলুন। এবার তিনি আগের চেয়েও দ্রুত কয়েকটা জিনিসের নাম বলে বললেন, বুঝেছেন? যান এইবার। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স কি লাগবে না? তিনি এবার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘আপনি কি বেশি বোঝেন? যেইগুলা বলছি সেইগুলা আনেন আগে। তারপর যদি মন চায় তাহলে একটা কবিতা লেইখ্যা ফাইলে ঢুকায় দিয়েন। যত্তসব!’

আমি আর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে এলাম। আমার চোখ ফেটে পানি বেরোচ্ছে। কোনো দিন কোনো অনাত্মীয় পুরুষ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি, এ রকম বিশ্রীভাবে ধমক দেয়নি। কেউ এ রকমভাবে কী করে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারল সেই অভিমানে ভাত খেলাম না। রাতে ঘুমাতেও পারলাম না। খুব বেশি গায়ে লেগেছিল দেখে ঘটনাটা আজও স্পষ্ট মনে আছে।

এর বহুদিন পরে গত বছর যখন ঢাকায় গেলাম তখন আরেকটি অভিজ্ঞতা হলো।

নিউমার্কেট গিয়েছি। একটা দোকানে চাদর কেনার জন্য ঢুকলাম। অনেকগুলো চাদর ছড়ানো ছিটানো ছিল। হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ এক দশাসই লোক পাশে এসে দাঁড়িয়ে দোকানিকে বাজখাই গলায় হুকুম দিলেন, তাকে যেন আগে দেওয়া হয়। আমি যে সামনে আছি, তিনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না এবং আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে নিজের হাত বাড়ালেন চাদরগুলোর দিকে।

আগের সেই আমি হলে চুপচাপ সরে দাঁড়াতাম, লোকটাকে জায়গা করে দিতাম। কিন্তু এবার আর তা করতে পারলাম না। খুবই শক্ত গলায় লোকটাকে বললাম, এই যে ভাই, আমি যে আগে এসে এখানে দাঁড়িয়ে জিনিস খুঁজছি আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না? আপনি কী মনে করে আমাকে ঠেলা দিয়ে দোকানে ঢুকে ধমকা-ধামকি করছেন?

ভেবেছিলাম লোকটা সরি বলে জায়গা করে দেবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। ঝগড়ার ভঙ্গিতে আমাকে বললেন, আপনার সঙ্গে তো আমি কোনো কথা বলিনি, আপনি কেন ফালতু কথা বলতে আসছেন ম্যানারলেসের মতো? এবার আমার মেজাজটা ভয়ংকর খারাপ হয়ে গেল। গলার আওয়াজ অনেকখানি বাড়িয়েই বললাম, ‘ম্যানার্স কী সেটা আপনি নিজে আগে শিখেন, আনকালচার্ড কোথাকার! মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, কী ব্যবহার করতে হয় জানেন না...আপনাদের মতো লোকের কারণে দেশের বদনাম হয়...আপনার ভাগ্য ভালো যে এ রকম অ্যাটিচুড নিয়ে এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা বিদেশ হলে এতক্ষণে পুলিশ ধরত।

দোকানি দেখল অবস্থা বেগতিক। তিনি বললেন, আপা বাদ দেন...থাক, যা হওয়ার হইসে। আমি আপনেরে খুঁইজা দিতেসি।

আমি বললাম, এটা বাদ দেওয়ার কিছু না ভাই...কিছু লোকের অভ্যাস এত খারাপ। তাদের চোখে আঙুল দিয়ে তাদের ভুল দেখিয়েই দেওয়া লাগে। তাতেও তাদের শিক্ষা হয় না। এদের সঙ্গে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব। আর এই যে আপনি, ম্যানার্স জিনিসটা আসলে কী সেটা বানানসহ শিখবেন, আর ভুল করে সরি বলার অভ্যাস করেন, না হলে একদিন রাস্তাঘাটে মাইর খেতে হবে...আজকে আমি ছেড়ে দিলাম, কিন্তু আরেকজন নাও ছাড়তে পারে।

এই বলে আমি দোকান থেকে বের হয়ে গেলাম। আর পেছনে তাকালাম না। লোকটা আমাকে গালি দিল না, কী করল সেটুকু দেখা বা জানার ইচ্ছা হয়নি আর। তার শিক্ষা হলো কিনা সেটাও অজানা রয়ে গেল, হয়তো হয়নি। কিন্তু আমার নিজের মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম এই ভেবে যে, মানুষের খারাপ ব্যবহার চুপচাপ সহ্য করার মানসিকতা আমি ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি।

আমার কাছে মনে হয়, আমাদের সবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে জবাব দেওয়া শিখতে হবে। আমরা ভদ্রতার খাতিরে বা ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেক কিছু চুপচাপ সয়ে যাই বা ইগনোর করি দেখেই একশ্রেণির লোক অকারণে দুর্ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
...

সারা বুশরা দ্যুতি: বেডফোর্ড, যুক্তরাজ্য।