ফিন্সলি স্ট্রিট থেকে বের হয়ে নটিংহ্যাম রোড ধরে ওল্ড ফার্ম রোডে উঠতেই নদীকে বেশিক্ষণ বসতে হলো না। বলা যায় দুই মিনিটের মধ্যেই নদী বাসটা পেয়ে গেল। বাসটা সময়ের একটু আগেই চলে এসেছিল।
বাসটা হ্যামিল্টন ইস্টে পৌঁছতেও বেশি সময় নিল না। শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ ছাড়া স্কুল কলেজ এখনো বন্ধ।
হ্যামিল্টন ইস্টের ওয়েলিংটন স্ট্রিটে বাসটা থামতেই নদী বাস থেকে নেমে বৃষ্টির চেয়ে হালকা ঝোড়ো বাতাসের সম্মুখীন হলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল বলে বাতাসের তোড়ে বৃষ্টিটা উড়ে এসে তার গায়ে পড়ছিল। ওয়েলিংটন স্ট্রিট ছেড়ে ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটে উঠতেই বৃষ্টিটা যেন তার বামপাশ থেকে উড়ে আসছিল বেশি। তাই নদী ছাতাটা বামপাশে হেলিয়ে রেখেছিল।
রাকিবের বাসাটা ফুটপাতের বামপাশে। রাকিবের বাসার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে নদী যে সেই বাসার দিকে তাকাল না, তা নয়। বরং বৃষ্টির তোড় সহ্য করে, খানিকটা ভেজা বাতাসের ঝাপটা খেয়েও নদী রাকিবের বাসার দিকে তাকাল। একবার তার ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে দোতলায় উঠে দরজায় নক করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু নদী সেদিকে গেল না। ইচ্ছেটা সঙ্গে সঙ্গেই দমন করে নিল। সে তো রাকিবের বাসার উদ্দেশেই বের হয়েছিল। কিন্তু নদী বাসে বসে সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করে নিয়েছে। এভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার একটাই কারণ, রাকিবের অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য।
এ ছাড়া নদী আরেকটা কারণে রাকিবের বাসায় ঢুকল না। সে আগে নিশ্চিত হতে চাচ্ছে, রাকিব কী কারণে তার ওপর রাগ করে আছে? সেদিন প্রফেসর রজারসনের বাসা যাওয়ার পর থেকেই সে রাকিবের রাগটা দেখে আসছে। নদী প্রফেসর রজারসনকে জিজ্ঞেস করবে বলেই সরাসরি স্যালারি স্ট্রিটে চলে এল।
স্যালারি স্ট্রিটে এসে নদী মন খারাপ করে রাকিবের বিষয়ে কয়েকটা কথা বলতেই প্রফেসর রজারসন কথাগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে নিলেন। প্রথমে তিনি রাকিবকে ফোন দেবেন বলে ভাবলেন। পরে কী ভেবে বললেন, ঠিক আছে নদী, রাকিবের বাসার ঠিকানাটা দাও। ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটে থাকে। কাছেই তো। আমি তাকে গিয়ে নিয়ে আসি।
প্রফেসর রজারসন এই বলেই তার ছোট্ট গাড়িটা বাসার গ্যারেজ থেকে বের করে রাকিবের বাসার উদ্দেশে গেলেন।
তারপর থেকে নদী প্রফেসর রজারসনের বাসা জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে আর ভাবছে। তার যেন সময়টা ফুরোতে চাচ্ছে না। স্যার তো আর আসার নাম নিচ্ছেন না?
নদী প্রথম ভেবেছিল, পাশেই তো ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট। যেতে বড় জোড় তিন মিনিট। ফিরে আসতে তিন মিনিট। মাঝখানে হয়তো তিনি রাকিব ভাইয়ের বাসায় পাঁচ-দশ মিনিট সময় নেবেন। প্রফেসর রজারসনও তাই বলে গেছেন।
কিন্তু প্রফেসর রজারসন প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পেরিয়ে গিয়ে এখনো যখন ফেরার নাম নিচ্ছেন না, তখন নদী সত্যি চিন্তিত না হয়ে পারল না। বৃষ্টি দেখতে দেখতে নদী প্রফেসর রজারসনের মোবাইলে প্রথমে ফোন দিল। কিন্তু ফোন দিতেই দেখল, তিনি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে মোবাইলটা সোফায় ফেলে গেছেন।
নদী ভাবল, বৃদ্ধ মানুষ! তাই বাধ্য হয়ে নদী রাকিবের মোবাইলে ফোন দিল। নদী নিশ্চিত ধরে নিয়েই ফোনটা দিল, সে আজও রাকিবের গম্ভীর গলাটাই শুনবে। কিন্তু ফোনের ওপাশে রাকিবের এমন উচ্ছ্বসিত গলা শুনে নদী সত্যি অবাক হলো। সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর একটা ভালো লাগা এসে ভিড় করল।
ফোনের ওপাশে রাকিবের প্রথম কথা, আরে নদী, কী খবর বলো?
নদী বলল, কোনো খবর নাই।
: খবর নাই কেন?
: খবর কেন নাই, এটা তো কোনো প্রশ্ন হলো না।
: তা অবশ্য ঠিক। বলেই রাকিব আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমার সঙ্গে রাগ করেছ?
নদী বলল, বাহ, অবাক কথা জিজ্ঞেস করছেন? আমি আপনার সঙ্গে রাগ করতে যাব কেন? রাগ তো আপনি করেছেন।
রাকিব বলল, নাহ, আমি তো কোনো রাগ করিনি। কেন রাগ করব?
: সেটা আমি জানব কীভাবে?
: তাহলে বললে যে?
: কী বলেছি?
: ওই যে বললে, আমি রাগ করে আছি?
: তাহলে ফোন দেননি কেন? আপনার তো হেস্টিংস-নেপিয়ার থেকে ফিরে এসে ফোন দেওয়ার কথা ছিল?
: তুমিও তো ফোন দাওনি?
: আমিই তো আগে ফোন দিলাম। এখন কে ফোন দিয়েছে?
রাকিব হেসে ফেলল। বলল, হ্যাঁ, আসলে তুমিই তো আগে ফোন দিয়েছ।
নদী বলল, হ্যাঁ, আমি ফোন দিয়েছি। কারণ আমি আপনার মতো এত অহংকারী না।
: আমি অহংকারী?
: হ্যাঁ, আপনি অহংকারী।
: নতুন কথা শোনালে।
: মানুষ যদি নিজেকে নিজে চিনতে পারত তাহলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হতো।
: বেশ তাত্ত্বিক কথা বলছ যে!
: তাত্ত্বিক না, সত্য কথা।
: কী সত্য কথা?
: আপনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন।
: হুম আচ্ছা, নিজেকেই জিজ্ঞেস করব। এখন না।
: এখন না কেন?
: এ ব্যাপারে সামনাসামনি হলেই কথা বলব। ডাইনিং টেবিলে স্যার একা বসে আছেন।
: আপনি কোথায়?
: আমি বেডরুমে।
: স্যার কি কিছু বলেছেন?
: না, তিনি কিছু বলেননি। তিনি এখন খাচ্ছেন।
: তিনি খাচ্ছেন মানে?
: হ্যাঁ, স্যার খাচ্ছেন। গরুর মাংস ও আলুর ঝোল দিয়ে ভাত। সঙ্গে ক্যাসবার ডাল।
: আমি যে এখানে স্যারের জন্য নুডলস রান্না করেছি?
: ওটা তুমি খেয়ে নাও।
: আমি না হয় খেলাম। কিন্তু স্যার হঠাৎ করে আপনার বাসায় খেতে বসে গেলেন যে?
: স্যার আজ তোমার নুডলস রান্না খাবেন না বলে। প্রতিদিন একই জিনিস রান্না কর।
নদী চুপ হয়ে গেল।
রাকিব বলল, আমি এমনিই তোমার সঙ্গে মজা করলাম। আচ্ছা, আমি এখন ফোন রাখি। স্যার ডাইনিং টেবিলে একা বসে আছেন।
নদী আস্তে করে বলল, আচ্ছা।
ফোন কেটে দেওয়ার পর নদী জানালার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। জানালার পাট খোলা। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও হালকা ঝোড়ো বাতাসের তোড়ে তার মুখে বৃষ্টিটা গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে পড়ছে। তার পরনের ফতুয়ার ওপরও বৃষ্টিটা হাওয়ায় ভেসে এসে গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে পড়ছে।
নদী জানালা থেকে না সরে বরং ডান হাতটা বৃষ্টির দিকে মেলে দিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা মুহূর্তেই তার ডান হাতটা ভিজিয়ে দিল। গ্রীষ্মের বৃষ্টি বলে বৃষ্টির জল খুব বেশি ঠান্ডা নয়। তারপরও বৃষ্টির জলের স্পর্শে তার ভেতর একধরনের শিহরণ দিল। তার শরীরটাও কেঁপে উঠল শিরশির করে।
নদী বৃষ্টির ভেতর ডান হাতটা মেলে ধরে হাতের তালুতে বৃষ্টির জল জমা করল। তারপর বৃষ্টির দিকেই জলটা ছুড়ে দিল। এভাবে সে বেশ কয়েকবার করল। তারপর হাতটা ভেতরে এনে ওড়নায় মুছতে মুছতে নদী মায়ের কথা মনে করল। বাংলাদেশ থাকতে মা ওকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেন। ভিজতে ভিজতে তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন। কখনো গুনগুন করে গানও ধরতেন। নদীকেও অনুরোধ করতেন গান ধরতে বা একটা কবিতা আবৃত্তি করতে।
মার কথা মনে পড়তেই নদী সঙ্গে সঙ্গে তার হ্যান্ডব্যাগটার দিকে এগিয়ে গেল। হ্যান্ডব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে সরাসরি মাকে ফোন দিল। ওপাশে চারবার রিং বাজতেই মা ফোন ধরলেন। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নদী, তুই এ সময় ফোন দিয়েছিস? গতকাল না তোর সঙ্গে দুই বার কথা হলো?
নদী অধিকারী গলায় বলল, দুই বার কথা হলেও দশ বার তো হয়নি।
: আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। তুই ভালো আছিস তো?
: হ্যাঁ মা, আমি ভালো আছি। অনেক ভালো আছি।
: কী ব্যাপার, আজ আমার নদী যে এত খুশি?
: হ্যাঁ মা, আমি অনেক খুশি।
: কারণটা জানতে পারি?
: মা, এখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
: তাই! তুই কি বৃষ্টিতে ভিজছিস?
: না মা, নিউজিল্যান্ডে ঝুম বৃষ্টি হয় নাতো। তাই বৃষ্টিতে ভিজে লাভ নেই।
: তাহলে এত খুশি কেন?
: বৃষ্টিতে হাত ভিজাচ্ছি।
: শরীরটাও একটু ভেজা। মন ভালো হবে।
: সত্যি বলছ।
: হ্যাঁ, এক শ ভাগ সত্য।
: না, আমি বৃষ্টিতে ভিজব না মা। এখানে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালে আমাকে দেখবে কে? বৃষ্টির পানি যা ঠান্ডা!
: তোদের ওখানে না এখন গ্রীষ্মকাল?
: গ্রীষ্ম-শীত দুই কালেই বৃষ্টির পানি ঠান্ডা থাকে।
: আচ্ছা, ঠিক আছে। তোকে আর বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না। আমাদের এখানে যা মরার শীত পড়েছে! গত সাত দিন ধরে কুয়াশাই কাটছে না।
: মা, আমাদের এখানেও একবার বৃষ্টি শুরু হলে সাত দিনে থামতে চায় না। তুমি তো সেটা জানোই।
: হ্যাঁ, জানি। ওটা তো তোদের ওখানে শীতকালে হয়।
: মাঝে মাঝে গ্রীষ্মকালেও হয়। তবে শীতকালে বেশি হয়।
: আচ্ছা নদী, তুই মেসেঞ্জারে ফোন না দিয়ে সরাসরি ফোন দিয়েছিস কেন?
: তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল বলে।
: শুধু শুধু বিল তুলছিস। তাহলে মেসেঞ্জারে ফোন দে?
: থাক মা। আমি রেখে দিই। আচ্ছা, তুমি এখন কী করছ?
নদীর মা ওপাশ থেকে আবেগ মেশানো গলায় বললেন, তোকে একটা সত্যি কথা বলি। আজ সকালে কোথাও বের হইনি। আজ ঢাকাতে খুব শীত পড়েছে। ঘুম থেকে উঠে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে আছি। লেপ মুড়ি দিয়ে জানালার পাশে বসে তোর কথাই ভাবছিলাম। এখন পর্যন্ত নাশতাটাও করিনি। ঠিক তখনই তুই ফোনটা দিলি!
নদী বলল, মা, তুমি না! আই লাভ ইউ মা! (ক্রমশ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>
ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: