সর্বজনীনতাতেই মঙ্গল উৎসবের সার্থকতা

ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য
ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য

“যুগে যুগে মহাপুরুষেরা ধর্ম-সম্প্রদায় স্থাপন করিয়া যান, কিন্তু আমরা সেখান হইতে শুধু ‘সম্প্রদায়’টা লই, ‘ধর্ম’টা লই না।”-রবীন্দ্রনাথ।

সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা এই লেখাটির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে সৃষ্ট এ ঘটনা দুটি এই উৎসবের সঙ্গে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দুটিই ঘটেছে ভারতে। প্রথমটি ২৫ আগস্ট (২০১৮), উত্তর প্রদেশের কানপুরে। এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই) জানিয়েছে, কানপুরের ড. এস আহমেদ তাঁর পরিবার ও প্রতিবেশীদের নিয়ে এ বছর শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালনের ৩০তম বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন করলেন।

ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য
ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য

ড. আহমেদের মতে সাগরই সব নদীর গন্তব্য, সেখান গিয়ে বিলীন হওয়া। কোনো নদী তো সাগরকে আলাদা করে দেখে না, বিভক্ত করে না। তাহলে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, শিখ সবাই ওই অভিন্ন ঈশ্বরে বিলীন হওয়ার কথা বলেও কেন আবার ওই ‘একোমেবাদ্বিতীয়ম্’-কে (এক+অহম্+অদ্বিতীয়ম্=আমি (অর্থাৎ, ঈশ্বর) এক এবং অদ্বিতীয়) বিভক্ত করছে? এভাবে ঈশ্বরকে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদুয়ারায় বন্দী করছে? মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করছে?

হয়তো এই আক্ষেপেই বিদ্রোহী কবি বলেছিলেন, ‘...তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,/ মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।...’ ড. আহমেদ শ্রীকৃষ্ণের কাছে শুধু তাঁর পরিবারের জন্য নয়, বরং সবার জন্য ভালোবাসা, শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের জন্য মঙ্গল কামনা করেই প্রার্থনা করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ড. আহমেদ সেখানে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য
ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে কেরালায়, ২৪ আগস্ট। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবর অনুযায়ী, বন্যার জলে কেরালার কচুকদাভু এলাকার মসজিদটি ডুবে যায়। ফলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোকজন ঈদুল আজহার নামাজ পড়তে পারছিলেন না। এ অবস্থায় ধর্মীয় পরিচয় ভুলে ত্রিশূর জেলার হিন্দু সম্প্রদায় একটি মন্দিরে তাদের ঈদের নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা করে দেয়। এই ব্যতিক্রমী উদারতা কেরালায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

এ লেখার নটে গাছটা এখানেই মুড়োনোর কথা ছিল। যদি এই উদাহরণগুলো মানুষের মুখে অনুরণিত হতো। ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে এর প্রশংসা হতো। মিডিয়া যদি এই উদারতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে এর মহত্ত্ব প্রচার করত; এবং এর সম্মিলিত ফলশ্রুতিস্বরূপ উপমহাদেশে ধর্মীয় উদারতা-সহনশীলতা আরও একটু বৃদ্ধি পেত। কিন্তু তা হয়নি। এই ক্ষণিক আলোর ঝলকানি পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল আঁধারে।

ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য
ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া পূজা অ্যাসোসিয়েশনের শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি দৃশ্য

দুর্ভাগ্যবশত এর উল্টোটা ঘটতে দেখি আরও বেশি। ধর্মের মর্মবাণী, শান্তি ও মিলনের যে অভিন্ন উদ্দেশ্য, তাকে না বুঝে নিছক প্রাণহীন আচার ও কুসংস্কারে বুঁদ হয়ে আছে মানুষ। আর এই অন্ধত্ব আর গোঁড়ামির ফলে মতবিরোধ আর আত্মকলহে বিভক্ত হয়ে, ক্ষুদ্র হতে হতে শক্তিহীন, দীপ্তিহীন, প্রাণ স্ফূর্তিহীন জীবন যাপন করছে অনেকে নিজের অজান্তেই। নিজ নিজ ধর্মীয়, সামাজিক গোষ্ঠীগুলো মিলনের বদলে বিভক্ত হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।

সিডনির দিকে তাকাই, যেখানে আগে দুই-তিনটি দুর্গাপুজো হতো। গত দুই দশকে কমিউনিটি বেড়েছে ঠিকই, তবে তা কোনোক্রমেই ষোলো-সতেরোটি পুজো হওয়ার মতো বড় হয়নি। অনৈক্য নিঃসন্দেহেই এই সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ। কেউ কেউ বলেন, ‘মন্দ কী? দূরে গিয়ে গাদাগাদি মানুষের ভিড়ে কষ্ট না করে নির্ঝঞ্ঝাট কয়েকটা পরিবার মিলে শান্তিতে পুজো করাই তো ভালো।’

অবাক হয়েছি এই পরিবারপন্থীদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায়! তারা বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে উইকএন্ড বারবিকিউ পার্টি আর বাৎসরিক সর্বজনীন পুজোর মধ্যে পার্থক্য বোঝেন বলে মনে হয় না। তবে ক্যানবেরাও যদি ওই কূপমণ্ডূকতার ফাঁদে পা দেয়, তবে তা হবে চরম দুর্ভাগ্যের ও বিস্ময়ের! কারণ, এই কমিউনিটি ছোট এবং এর বেশির ভাগ সদস্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে পেশাদারি কাজ করেন, অর্থাৎ শিক্ষাদীক্ষায় তারা প্রাগ্রসর।

শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ
শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ

সনাতন ধর্ম অপেক্ষাকৃতভাবে আচারিক বাধ্যবাধকতাহীন। কারণ, যুক্তিহীন-অর্থহীন আচারের প্রকোষ্ঠে একে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এর দর্শন ও উদ্দেশ্য উদার ও মহৎ। আত্মিক উৎকর্ষ ও সৌকুমার্য অর্জন। অর্থাৎ ‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মামৃতং গময়, আবিরাবীর্ম এধি।’ (আমাকে অসত্য হতে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হতে আলোতে লইয়া যাও, মৃত্যু হতে অমৃতে লইয়া যাও, আমার নিকট আবির্ভূত হও)। কিন্তু এই সত্যকে, আলোকে ও অমৃতলোককে নিরন্তর অনুসন্ধান করাই একজন প্রকৃত সনাতনীর বৈশিষ্ট্য।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ধর্মপ্রচার’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘...ধর্মকে যাহারা সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিয়া প্রচার করিতে চেষ্টা করে, তাহারা ক্রমশই ধর্মকে জীবন হইতে দূরে ঠেলিয়া দিতে থাকে। ইহারা ধর্মকে বিশেষ গণ্ডি আঁকিয়া একটা বিশেষ সীমানার মধ্যে বন্ধ করে। ধর্ম বিশেষ দিনের বিশেষ স্থানের বিশেষ প্রণালির ধর্ম হইয়া উঠে। তাহার কোথাও কিছু ব্যত্যয় হইলেই সম্প্রদায়ের মধ্য হুলুস্থুল পড়িয়া যায়।...’

(সম্ভবত সার্টিফিকেটধারী তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণ সম্বন্ধে) রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘...ধর্মকে যে আমরা শৌখিনের ধর্ম করিয়া তুলিব; আমরা যে মনে করিব, অজস্র ভোগবিলাসের একপার্শ্বে ধর্মকেও একটুখানি স্থান দেওয়া আবশ্যক, নতুবা ভব্যতারক্ষা হয় না, নতুবা ঘরের ছেলেমেয়েদের জীবনে যেটুকু ধর্মের সংস্রব রাখা শোভন, তাহা রাখিবার উপায় থাকে না, আমরা যে মনে করিব, আমাদের আদর্শভূত পাশ্চাত্যসমাজে ভদ্র পরিবারেরা ধর্মকে যেটুকু পরিমাণে স্বীকার করা ভদ্রতা রক্ষার অঙ্গ বলিয়া গণ্য করেন, আমরাও সর্ব বিষয়ে তাঁহাদের অনুবর্তন করিয়া অগত্যা সেইটুকু পরিমাণ ধর্মের ব্যবস্থা না রাখিলে লজ্জার কারণ হইবে, তবে আমাদের সেই পিতামহদের পবিত্রতম সাধনাকে চটুলতম পরিহাসে পরিণত করা হইবে।...’

শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ
শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ

বিস্মিত হই এই দেখে যে, প্রায় এক শ বছর আগের এই মূল্যায়ন এখনো কত প্রকট, কত প্রাসঙ্গিক!

যদি প্রশ্ন করি, আমরা ব্যক্তিগত জীবনে কিংবা পারিবারিক চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে কেন সামাজিকভাবে-সর্বজনীনভাবে মঙ্গল উৎসব করি? কারণটা হলো, ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্তিই কেবলমাত্র আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে ঈশ্বর সৃষ্ট জগতের সব মানুষের, সব সৃষ্টির সঙ্গে একাকার হয়ে সেই সর্ব মঙ্গল মাঙ্গল্যের মহিমা বর্ণনা করে জগতের সবার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করাই আমাদের কর্তব্য।

‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘...প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী-কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।...’

সুতরাং বিভাজিত-ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে মঙ্গল উৎসব পালন করার মধ্যে আত্মগ্লানি আর বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছুই নেই। সমষ্টির সঙ্গে, বৃহত্তর সম্মিলন ও সর্বজনীনতার মাধ্যমেই সম্ভব বৃহত্তর মঙ্গলবিধান করা, আনন্দলোক ও অমৃতলোকের সন্ধান লাভ করা। কারণ, সর্বজনীনতাকে সংকুচিত করলে এই মাঙ্গলিক উৎসবের মহৎ উদ্দেশ্যকেই সংকুচিত করা হবে। এমন উদার ও মানবিক আয়োজন সর্বজনীনতা থেকে বিশ্বজনীনতায় উত্তরণ ঘটুক, এই আশা করি।

শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ
শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ

শারদীয় দুর্গোৎসবে বিশ্বজনীনের মঙ্গল কামনা করি এই গানে: (শিল্পী: পূণ্যা জয়তী, সুর ও সংগীতায়োজন: রবিন গুডা, গিটার: রানা খান, ব্যান্ড: লস্ট টেপ্স্, ইউটিউব লিংক <www.youtube.com/watch?v=Xk 44 hOpt2 N0>)

আগমনী
তুষার রায়

চেয়ে দেখো ওই
জননী এসেছে দ্বারে,
ঘুচবে এবার দুঃখ-গ্লানি
জগৎ পারাবারে।
সাজাও আসন, করো আবাহন
মঙ্গল প্রদীপ-শঙ্খে,
জয়ধ্বনি বাজাও সবে
খোল-করতাল-মৃদঙ্গে।
আজ তাঁর বরণে
জানাই, প্রণতি চরণে
দূর করো বিঘ্ন-জরা সংসারে।
চেয়ে দেখো ওই
জননী এসেছে দ্বারে।
তুমি মা শক্তি, তুমি মা ভক্তি
তুমিই জগৎ-জননী,
তোমার অভয়ে কাটুক আঁধার
দূর হোক তপ্ত অশনি।
মঙ্গলালোকে করো মা দীপ্ত
শুভ শক্তিতে করো উদ্দীপ্ত,
আঁধার হেনে পৌঁছি যেন
আলোক পারাবারে।
চেয়ে দেখো ওই
জননী এসেছে দ্বারে।।