আমি আসলে কার জন্য কাঁদছি?

শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: প্রথম আলো
শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: প্রথম আলো

রাত তখন একটা কী দুইটা।

ঘুমানোর আগে সুন্দর সুন্দর কিছু ভাবা অভিধানে আছি। ভোরে উঠতে হবে যে। আমি সাধারণত রাতের এই সময়ে অশুভ বা বিষণ্ন কিছু থেকে মনের দিক থেকে শত হাত দূরে থাকি। সে জন্যই বোধ হয় সেকেন্ডের কাঁটা মিনিটে যেতেই চোখে ঘুম নামে। কাছের মানুষেরা আবার এই ঘুমের নাম দিয়েছে সুখী মানুষের ঘুম।

রাত তখন একটা কী দুইটা।

আমার প্রিয়তম মুখপঞ্জির বুকে হাঁটছিল। হঠাৎ কী যেন হলো। আলতো ছুঁয়ে বলে—দেখো সংবাদটি মিথ্যা। সে খুব আহত হয়ে বলল, আমাকে প্লিজ বলো এটা মিথ্যা। আমি বিমর্ষ হয়ে বলি; দাঁড়াও উইকিপিডিয়া খুলি। এই উইকিতে যারা মৃত্যু সংবাদ লেখে তারাই বোধ হয় পৃথিবীতে আজরাইলের পরেই জেনে যায় মানুষটা মারা গেল ঠিক তখন।

রাত তখন তিনটা।

এতক্ষণে আমি জানি, আজ রাতের ঘুম আমার বেদনার কাছে।

রাতভর কালো চশমার আড়ালের মানুষটাকে দেখলাম। ক্যাপের ভেতরে ডাকা চুলগুলো দেখলাম। এই আমার সর্বপ্রথম মনে হলো, তাঁকে দেখিনি কখনো! অথচ মানুষটা আমার কত পরিচিত। কাছের কেউ ছিল কী? তখনই সব মনে হলো, যখন তাঁর সৃষ্টিমুখর কণ্ঠ থেমে গেল এই ধাক্কা মন খেলো।

এদিকে প্রিয়তমও খুব ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে কোথা থেকে যেন স্মৃতিকাতর সব গল্প তুলে আনছে। শৈশবের খুনসুটির কথা বলছে। বলছিল, ভাইয়ের সঙ্গে জেমস আর আইয়ুব বাচ্চু নিয়ে দল করার কথা। ভাই নাকি জেমস ছিল, সে ছিল আইয়ুব বাচ্চু। ভাইয়ের অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে বলার পরে সে যখন জেমসের দলে গেল তখন দেখে ভাই তার আইয়ুব বাচ্চু! তখন তুমুলে আইয়ুব বাচ্চুর গান...।

আইয়ুব বাচ্চু। স্মৃতির জানালায় দাঁড়িয়ে আজ মনে হলো এই যে এই মানুষটা তিনি তো আমার বয়সী একজন। নাম ধরেই তো ডাকব! একজন মানুষ কতটা সবার হলে এতটাই নাম ধরা ডাক পান তা বুঝেছি একটু ছোটবেলায় একদিন।

আমার আম্মু সন্দ্বীপে পরিচিত মুখ হওয়ার কারণে অধিকাংশ মানুষ তাঁকে চেনেন। তো একদিন একটা ছোট্ট বাচ্চা জিজ্ঞেস করে আমাকে, আপু, আপনি কি মোহছেনার মেয়ে। আমি রাগ হলাম। এক শব্দে বললাম, হ্যাঁ। রাতে আম্মুকে আমার খারাপ লাগার কথা বলি। বলি যে, ছোট্ট একটা বাচ্চা আপনার নাম ধরে বলছে। কেন বলবে? আম্মু হাসলেন। তারপরে বললেন, আম্মু যারা সবার হয়ে কাজ করে, সমাজের জন্য কাজ করে, মানুষের জন্য কাজ করে তারা মূলত সবার। তারা এতই সবার যে একটা ছোট্ট বাচ্চাও মনে করে তারা তাদের একজন। আম্মুর ব্যাখ্যা করবার সেই দিন থেকেই জানি এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা সবার। সবার বয়সী।

ততক্ষণে রাত কেটে দিন। তন্দ্রামতো একটু লাগতেই দেখি সকাল।

কাজ আছে আজ। ভোরের অ্যালার্ম বন্ধ করতেই ফোনটা হাতে নিলাম। বুঝলাম আজ ফোন হাতে নেওয়া মানেই দুঃখগ্রাম ঘুরে আসা। আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য আজকে পুরো দেশটাই দুঃখ গ্রাম। বিধিবাম সেই দুঃখগ্রাম থেকে একটা ভিডিও এল। ভিডিও অন করে দেখলাম, দূর থেকে দেখা দূরদর্শী বুদ্ধিমান উপস্থাপকের বিচক্ষণতা, উপস্থাপন ও তার উপস্থাপনা। অতঃপর গানের প্রতিযোগিতার সেই ভিডিওতে যা হলো সেই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আমার চোখে। উপস্থাপক আর জড়িয়ে ধরা আইয়ুব বাচ্চু দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। ঝর ঝর করে কাঁদছি বহুদূরের বহু অচেনা আমিও। সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে আজকের শ্রদ্ধাবনত বাংলাদেশের মতো ছোট্ট বাংলাদেশ। বিচারক। দর্শক।

এদিকে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে হয়তো অন্য কিছু। চোখ মুছে রেডি হয়ে ক্লিনিকে গেলাম। সমস্ত দিন কান্না কান্না লাগছে। চোখ বেয়ে নামছে নোনা জল। আমি আসলে কার জন্য কাঁদছি? একটা শিল্পীর কী ক্ষমতা। একজন শিল্পীর কী মারাত্মক ক্ষমতা। আমি তাঁর জন্যই কাঁদছি কোনো জীবনেও যাকে দেখিনি আমি। আমার এই সব নোনা জলের আমিতে হঠাৎ আমাদের ক্লিনিকের ম্যানেজার আমেরিকান মেয়েটার চোখ। কাঁদছ কেন জাহান? Why are you crying Jahan?

কী বলব এই মেয়েটাকে আমি? আমি আসলে কার জন্য কাঁদছি? আমি একজন স্বরের স্রষ্টার জন্য কাঁদছি, যার সৃষ্টি আমাকে দিয়েছিল শৈশবের কিছু রং। আমি এমন একজন মানুষের জন্য কাঁদছি যাকে সামনাসামনি কখনো দেখিনি আমি।
...

জাহান রিমা: ইমার্জেন্সি ডেন্টাল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।