মেঘে মেঘে রংধনু-এক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিব আজকাল বেশ কবিতা লিখছে। যদিও সে কবিতাগুলো এলোমেলোভাবে ডায়েরিতে লিখে রাখছে, তবুও তো বেশ কবিতা লেখা হচ্ছে। আরও কিছু কবিতা লেখা হলে একদিন সে সবগুলো কবিতা নিয়ে বসবে। কবিতাগুলোর পরিবর্ধন-পরিমার্জন করবে। একটা কবিতার বই বের করবে। নদীও তা চায়।

রাকিব গত রাতেও একটা কবিতা লিখেছে। এখন সে এই মধ্য সকালে কফি কাপ হাতে সেই কবিতাটা নিয়ে বসেছে। সকালের নিস্তব্ধতা চারদিক। বাইরে শীতার্ত রোদ। নিউজিল্যান্ডের মানুষ যদিও বলে যে, এখন উঠতি শীত, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এখন এখানে শরৎকাল। চারদিকে ম্যাপল গাছ ওক গাছের পাতায় পাতায় সোনালি রং ধারণ করেছে। কোনো কোনো গাছ পাতা ঝরিয়ে প্রায় উদোম হতে বসেছে। আর মাত্র এক সপ্তাহ। তারপরই ডেলাইট সেভিংস শেষ। ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হবে। এখন যেমন আটটার দিকে সন্ধ্যা হয়, এক সপ্তাহ পরেই সন্ধ্যা হবে সাতটার সময়। তারপর দিন আস্তে আস্তে আরও ছোট হয়ে আসবে। একসময় দেখা যাবে পাঁচটা না বাজতেই হুট করে সন্ধ্যা নেমে গেছে।

প্রায় এগারো বছর নিউজিল্যান্ডের বসবাসের পর রাকিবের মধ্যে এসব ব্যাপারগুলো তেমন উৎসাহের সৃষ্টি না করলেও নদী বেশ করে। নদী দিনের এই এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া বা কমিয়ে দেওয়ার নাম দিয়েছে ঘড়ির কাঁটাকে ঘাড় ধাক্কা দেওয়া। নদী মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে বলে, এটা আবার কী রকম কথা? বলা নেই-কওয়া নেই দিনকে এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া বা কমিয়ে দেওয়া?

নদী নিউজিল্যান্ডের শীতকালকে বলে ছিঁচকাঁদুনে বুড়ি। সারাক্ষণ ছিঁচকাঁদুনে বুড়ির মতো ফ্যাচ ফ্যাচ বৃষ্টি আর বৃষ্টি। এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা নয়, এক দিন-দুই দিন নয়, কখনো কখনো এক সপ্তাহ পেরিয়েও বৃষ্টি হতে থাকে—ঝিরিঝিরি, ঝিরিঝিরি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বৃষ্টি বুঝি আর থামবে না।

আজ অবশ্য বৃষ্টি নেই। বৃষ্টি নামার কোনো লক্ষণও নেই। চারদিকে সকালের রোদটা শীতার্ত নরম হয়ে পড়েছে। বাইরে কোথাও একটা পাখি ডাকছে—টুইট-টুইট, টুইট-টুইট। এ ছাড়া ঝিঁঝি পোকার অনবরত ডাক—ঝিঁ-ই-ই, ঝিরিত ঝিরিত, ঝিঁ-ই-ই।

নদী আজ আসবে। আজ দুপুরের যেকোনো সময় নদী আসবে। দুপুরের যেকোনো সময় এ জন্য, নদী কোনো নির্দিষ্ট সময় বলেনি। শুধু দুপুরের কথা বলেছে। প্রায় চার সপ্তাহ পর নদী আজ বাসায় আসবে। আতিক বাংলাদেশ থেকে আসার পর নদী এ বাসায় আসা কমিয়ে দিয়েছে। এতে যে আতিকের কোনো দোষ আছে, তা নয়। নদীই আতিকের সামনে এ বাসায় তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।

আজ ওদের মাউন্ট পিরংগিয়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা। হ্যামিল্টন থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে মাউন্ট পিরংগিয়াতে রাকিব বছর তিনেক আগেও একবার গিয়েছিল। তখন সে গিয়েছিল একা। মন ভালো না থাকাতে কোনো এক বিকেলে একাকী সে সেখানে গিয়ে বসেছিল।

আজ রাকিব নদীর সঙ্গে ওখানে যাবে। আজকাল নদীকে নিয়ে সে আশপাশের স্থানগুলোতে ঘুরতে যায়। গত সপ্তাহেই ওরা কেমব্রিজ শহর ও কারাপিরো লেকে ঘুরে এসেছে। এর আগের সপ্তাহে টি-আওয়ামুটু রোজ গার্ডেন গিয়েছিল। হ্যামিল্টন গার্ডেনেও ওরা সপ্তাহ তিনেক আগে পুরো একটা দিন কাটিয়েছে।

রাকিব ভাবল, নদীকে সঙ্গে করে নিয়ে কোথাও যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। সারাক্ষণ মনের ভেতর কী এক মুগ্ধতা বসবাস করে।

আজকাল রাকিবের আর শনিবারে নদীর সঙ্গে ওয়াইকাটো নদীর তীরে হাঁটা হয় না। প্রায় প্রতিটা শনিবারেই অফিসে রাকিবের ওভারটাইম করতে হয়। শুধু রাকিবকেই নয়, অফিসের সবাইকেই এই ওভারটাইম কাজের চাপ বহন করতে হচ্ছে। হ্যামিল্টনের অদূরে কেমব্রিজ শহরের কাছাকাছি আটচল্লিশ মিলিয়ন ডলারের কাজটা হাতে আসার পর হঠাৎ করেই তাদের ফ্লিটচার কন্সট্রাকশন ফার্মের হ্যামিল্টন শাখা কাজের চাপটা বেড়ে যায়। তবে সবার মধ্যে একটা স্বস্তি, ওরা ওভারটাইমের জন্য টাইম অ্যান্ড হাফ বেতন পাচ্ছে।

অবশ্য এই কাজের চাপটা সপ্তাহ কয়েক পর আর থাকবে না। প্রজেক্টটা শুরু হয়ে গেলে অফিশিয়াল কাজ ও হিসাব-নিকাশ সব শেষ হয়ে যাবে। তবে রোববারে রাকিবের কোনো কাজ থাকে না। আজকাল নদীর সঙ্গে কোথাও যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা করলে সে রোববারেই করে।

আজও রোববার। রাকিব ঘড়ি দেখল। সকাল প্রায় নয়টা। কবিতাটিতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে সে বন্ধ জানালার কাচ গলে বাইরে তাকাল। বাইরের রোদটা বেশ স্পষ্ট। রোদের মধ্যে নিঃসীম ভাব। চারদিকের সোনালি রং ধরা ম্যাপল গাছ-ওক গাছের প্রতিটা পাতায় রোদটা যেন আরও সোনালি রং ধারণ করে থমকে রয়েছে। এ এক অদ্ভুত দেশ নিউজিল্যান্ড। প্রকৃতির রঙের সঙ্গে মানুষের মনের রং বদলায়। আর এখানকার প্রকৃতির রং মানুষকে যে কত আবেগপ্রবণ করে তোলে...!

রাকিব বাইরে থেকে দৃষ্টি এনে লাউঞ্জের এপাশ-ওপাশ দেখল। এমনিই। সে এরই মধ্যে সকালের নাশতা সেরে ফেলেছে। টোস্ট করা ব্রেড স্লাইস আর ডিম পোজ। কফির কাপটাও টি-টেবিলের একপাশে পড়ে আছে। কফির কাপের দিকে তাকাতেই সে আরেক কাপ কফির কথা ভাবল। কিন্তু সোফা ছেড়ে তার উঠতে ইচ্ছে হলো না।

রাকিব নিজের নাশতা করার সময় আতিকের নাশতার কথাও একবার ভেবেছিল। সে ভেবেছিল, আতিকের জন্য সে একটা ডিম পোজ ও দুই-তিন স্লাইস ব্রেড টোস্ট করে রাখবে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভেবেছে, আতিক কখন না কখন ঘুম থেকে ওঠে? সে সারা রাত ট্যাক্সি চালিয়েছে।

আতিক এখন হ্যামিল্টনে ভাড়ায় ট্যাক্সি চালায়। বাংলাদেশ যাওয়ার আগেই সে ট্যাক্সি লাইসেন্স নিয়ে গিয়েছিল। মাস দেড়েক আগে বাংলাদেশ থেকে ফিরে হ্যামিল্টনের এরিয়া নলেজ নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ট্যাক্সিতে নেমে যায়। হাত খালি ছিল, তাই ভাড়ায় চালানো শুরু করেছে। তবে সে খুব তাড়াতাড়ি কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে হ্যামিল্টন ট্যাক্সির শেয়ার কিনে নিজের ট্যাক্সি রাস্তায় নামাবে। ট্যাক্সিতে নামার আগে রাকিব আতিককে নাজমুল আহসানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। নাজমুল আহসান হ্যামিল্টনে বেশ কয়েক বছর ধরে নিজের ট্যাক্সি চালান।

নিজের ট্যাক্সি হলে আতিক যখন ইচ্ছে তখন কাজে নামতে পারবে। যখন ইচ্ছা তখন কাজ শেষ করে চলে আসতে পারবে। কিন্তু সে ভাড়ায় চালায় বলে তাকে একটা নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসরণ করে কাজ করতে হয়। বিকেল ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত তার কাজ। দিনে সেই ট্যাক্সিটা আবার আরেকজন ড্রাইভার চালান।

ড্রাইভার হিসেবে হোক, আর নিজের ট্যাক্সিই হোক ট্যাক্সিতে যে অনেক টাকা, তা আতিক প্রথম সপ্তাহে ট্যাক্সি চালানোর পরই বোঝা গেছে। প্রথম সপ্তাহে ট্যাক্সি চালানোর পর আতিকের সে কী দিঘল হাসি! এখন সে ট্যাক্সি নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে। এরই মধ্যে তার সবার ঋণগুলো দেওয়া শেষ। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আসার পর আতিকের মধ্যে বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সে আর আগের মতো বেফাঁস কথা বলে না। যখন-তখন রাকিবের কাছে উপদেশ নিতে আসে না। সব সময় নিজের ভেতর থাকার চেষ্টা করে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত বারো ঘণ্টা ট্যাক্সি চালানো। সকালে ফিরে লম্বা ঘুম। ঘুম থেকে উঠে কতক্ষণ টেলিফোনে বাংলাদেশে বউয়ের সঙ্গে কথা বলা। ফেসবুকে নতুন নতুন ছবি আপলোড করা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা ধরে চুল আঁচড়ানো। এখন আর আতিক লাউঞ্জে বসে টিভিও দেখে না। নিজের রুমে একটা ফিফটি ফাইভ ইঞ্চি টিভি কিনে নিয়েছে। ফোর কে অ্যান্ড্রয়েড টিভি। নেটে অনেক লেটেস্ট মুভি দেখা যায়।

আতিক তার বউয়ের জন্য নিউজিল্যান্ড ইমিগ্রেশনে কাগজপত্র জমা দিয়েছে। এখন বউ নিউজিল্যান্ডে আসা শুধু সময়ের ব্যাপার।

আতিকের এই পরিবর্তনে রাকিব যে অবাক হয়নি, তা নয়। তবে তার ভালোই লাগছে। আগের সেই অগোছালো আতিককে দেখে তার যেমন বিরক্ত লাগত, এখন আর লাগে না। মাঝে মধ্যে আতিক নিজ থেকে রান্নাবান্নাও করে। বাসা গোছগাছ করে। বলার আগেই সুপারমার্কেট থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো নিয়ে আসে।

অবশ্য আজকাল আতিকের সঙ্গে রাকিবের তেমন একটা দেখাও হয় না। রাকিব সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। আর আতিক বিকেলে ট্যাক্সিতে চলে যায়। আসে সকালে। একমাত্র উইকএন্ডে রোববারে ওদের মধ্যে টুকটাক বৈষয়িক কথাবার্তা হয়।

আতিকের কথা ভাবতে ভাবতে রাকিব আতিকের রুমের দিকে তাকাল। আতিকের রুমের দরজা বন্ধ। আরও তিন-চার ঘণ্টার আগে সে ঘুম থেকে উঠবে না। দরজা বন্ধ হলেও রুমের ভেতর থেকে তার নাক ডাকার শব্দ আসছে। নাক ডাকার শব্দটা মিহি, কিন্তু স্পষ্ট, খ-ড়-ড়-ত, ফি-স-স, খ-ড়-ড়-ত...!

রাকিব সোফায় পা দুটো আরও টান টান করে বসে, কবিতার খাতাটা পাশে রেখে রিমোটে টিভি ছাড়ল। চ্যানেল ওয়ানে এক দীর্ঘ বিজ্ঞাপন চলছে। স্টিম ভ্যাকিউম ক্লিনারের বিজ্ঞাপন। চ্যানেল টুতে চলছে থিন লিজি লেডিজ মেক আপের বিজ্ঞাপন। চ্যানেল থ্রিতে চলছে চার্চের ধর্মীয় বিষয়ক আলোচনা। প্রাইম চ্যানেল চাপতেই দেখল, সেখানে সামুদ্রিক মাছের একটা ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। রাকিব রিমোটটা পাশে রেখে ডকুমেন্টারিতে মনোযোগ দিল।

কিন্তু ডকুমেন্টারিটা কিছুক্ষণ দেখতেই শেষ হয়ে গেল। রাকিব অযথাই আরও কিছুক্ষণ টিভির দিকে দৃষ্টি দিয়ে টিভি বন্ধ করে দিল।

রাকিব আবার ঘড়ি দেখল। মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। সময়টা যেন যাচ্ছে না। রাকিব নিজে নিজেই মাথা নাড়ল। নদী যদি তার আসার সঠিক সময়টা বলে দিত, তাহলে সে কিছুটা স্বস্তি পেত। দুপুরে আগে সে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারত। নদী দুপুরের যেকোনো সময় আসবে। কিন্তু নদী যদি দুপুরের আগেই চলে আসে?

রাকিব এখনো অযথা নদীকে ফোন দেয় না। ফোনে কথা বলতে গেলেও জড়তা পেয়ে বসে। নদী অবশ্য হালকা রসিকতা করার ছলে মাঝেমধ্যে বলে, মানুষের অভ্যাস তো পরিবর্তন হয়। কখনো কখনো আস্ত মানুষটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। জনাব কবি সাহেব, আপনি আপনার অভ্যাসটা একটু পরিবর্তন করেন!

রাকিব ভাবল, হ্যাঁ, মানুষের অভ্যাস শুধুই না, আস্ত মানুষটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। সে তো তার ফ্ল্যাটমেট আতিককে দিয়েই দেখতে পাচ্ছে। আতিকের মধ্যে কী পরিবর্তন! মনে হচ্ছে এ এক অন্য আতিক...! কিন্তু রাকিব নিজে পরিবর্তন হতে পারল না। পরিবর্তনের চেষ্টা যে সে করেছে, এটা সে নিজে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে না। তবে কী সে পরিবর্তনে ভয় পায়?

রাকিব মাথা ঝাঁকাল। ভাবল, আসলে সে জানে না। নিজেকে সে কী পরিবর্তন করবে? সে তো নিজের মতোই নিজে আছে। নিজের দুঃখগুলো নিজের। নিজের সুখগুলো নিজের। নিজের সব আনন্দ-হাসি সবই নিজের। নদী তাকে যতই বলুক একটু পরিবর্তন হতে, ছোট ফুফু তাকে যতই তাকে ভেড়া ডাকুক, সে নিজের ভেতর কোনো পরিবর্তন চায় না। আর নদী তো বলে, তার এই চুপচাপ, গম্ভীর ও নির্মোহ চেহারাটাই নদীর ভালো লাগে। তাহলে?

রাকিব কোনো কিছু না ভেবেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে তার মাথায় কফির চিন্তাটা আবার নড়েচড়ে উঠল। ভাবল, হ্যাঁ, এক কাপ কফি নিয়ে সে ব্যালকনির রেলিং ঘেঁষে শরতের নরম রোদে গিয়ে দাঁড়ালে মন্দ হবে না। ভাবতে ভাবতেই সে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন