আইডেন্টিক্যাল টুইন ও জন্মদিন!

যমজ বোন জাহান রিমা ও জাহান রিপা
যমজ বোন জাহান রিমা ও জাহান রিপা

আজ আমাদের শুভ জন্মদিন। আজ বহু বছর পরে আমরা একটু একটু করে আমি বলতে শিখেছি। মায়ের গর্ভের প্লাসেন্টা ফুল যা পারেনি, দূরত্ব পেরেছে তা। আমরা আইডেন্টিক্যাল টুইন। বুঝতেই পারছেন, একজনের জ্বর হলে আরেকজনের হয় কিনা সেই ঘটনা!

আজ আমাদের শুভ জন্মদিন। আজ ২১ অক্টোবর।

আমরা দুজন রিমা–রিপা সেই ভাগ্যবতী মেয়ে, যারা জন্ম থেকেই আমরা হয়ে পৃথিবীতে এসেছি। জন্মেরও আগে আম্মুর পেটের ভেতরে টকশো করেছি! তারপর হরিহর আত্মা নামে ত্রিভুবনে নাম লিখিয়েছি। একজনে ব্যথা পেলে আরেকজন সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়েছি! জেনেছি দুজনে; দুজনেরই চোখের আঙিনা জানবার আগেই, একজনের নিশ্বাস কতটুকু দীর্ঘ হলে সেটা দীর্ঘশ্বাস হবে আর কয় সেকেন্ড গেলেই তা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়বে। ঝড়ের আভাস না পেলেও আমরা একে অপরের শব্দ শুনি ঝরঝর–ঝর। বুঝতেই পারছেন, টেলিপ্যাথি নামে একটা ব্যাপার আছে, সেই ব্যাপারখানা আজও বেকার না এই আমাদের জন্যই! এইজন্যই বাই লোকেশন আমাদের চির বাধ্য। অর্থাৎ একই সময় দুই জায়গায় অবস্থান করা তো আমাদের নিত্য পথ। অহর্নিশ যাত্রা সশরীরে কিংবা অশরীরে। রিমা–রিপা সখ্যতা পরিবহন আমেরিকা টু বাংলাদেশ! মনোজগৎ ভ্রমণ করে আমরা দুজন দূরে থেকেও এত যে কাছে থাকি। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় কিছু না বললেও আমরা বুঝতে পারি কী ব্যথায় বুক ভেসে যায়, কী সুখে ঢেউ টলমল।

আমরা আগে খুব অবাক হতাম, যখন কেউ বলত তাদের কেউ নেই মনের কথা বোঝার। কেউ নেই, যাকে সব বলা যায়। সব, এক্কেবারে সব। এখন আর অবাক হই না। শুধু ভাবি পৃথিবীতে দুই দেহের এক আত্মা পাওয়া তো সহজ না। সবাই পায় না...তাই ভেবে প্রতি একুশে অক্টোবর বিস্ময়ের ঘরে কৃতজ্ঞতা কড়া নাড়ে। কে গড়েছেন আমাদের দুই দেহকে এক মনের আদলে? কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের আব্বু–আম্মুকে। তাঁদের তো খুব কষ্ট হয়েছে। একসঙ্গে টুইন বাচ্চা বড় করা কী আর সহজ কথা!

সহজ। সহজ না হলেও এই অসহজের জন্যই আমাদের জীবনযাপনটা আজ সহজ সৌন্দর্যে পূর্ণ। হাতের কাছে হাত। বুকের কাছে মাথা, বৃষ্টি ভীষণ মাথার ওপর ছাতা। শোকে কাতর, মধ্যরাতে ঘুম জড়ানো কাঁথা। সুখ এল তো...খুশির তুমুলতা। আমরা দুজন। আমি না বলতে পারা আমরা—রিমা–রিপা।

তুলা রাশির মেয়ে আমি। আমরা। জন্মদিন নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনায় থাকি। জন্মদিনের সারা দিন ভীষণ কাজলে দিন টানি। কখন কে আবার শুভেচ্ছা জানাতে এসে যায় কে জানে! এই দিনে অভিমানেও থাকি চূড়ান্ত। মোহরময় এই বিষয়গুলো যখন থেকে ঘটে তখন বয়স ষোলো সতেরো। আমাদের ‘হাবিলাস’ ব্যারাম আছে। হাবিলাস সন্দ্বীপ অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দ। এর অর্থ মনের ভাবনা দলের কাছে উদাস সমর্পণ। যা মনে চায় তাই করা! তো ফাল্গুন চৈত্রের বাতাস পেলে হাবিলাস বেড়ে যায়। বর্ষা এলেও হয়। জন্মদিনে আরও বেশি হয়। তুমুল বাতাস। উথালপাতাল। আমি সম্পূর্ণ দরজা মেলে দিই। সবগুলো জানালার বাঁধন খুলে দিই। পর্দার সঙ্গে বাতাসের মাখামাখি দেখি। নিজের গায়ে সুগন্ধী মাখি, বন্য সে ঘ্রাণ!

চুলের বিনুনির বন্ধন খুলে দিই। তা কোমর ছুঁয়ে যায়, যেন নায়াগ্রা ফলস। আমেরিকা আর কানাডা দুই রাজকুমারের জলবিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে ওতে। যেন প্রস্তুত আরও কেউ কেউ অথবা সে পাড়ার আরও পাঁচটি হ্রদ। আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত সুপিরিয়র, মিশিগান, ইরি, হিউরন ও ওন্টেরিওর হ্রদ এই নায়গ্রাতেই!

আমাদের হাবিলাস বাড়তে থাকে। বিছানার চাদর পাল্টে ফেলি। ধবধবে সাদা চাদর বিছাই। দেখতে দেখায় সাদা থান্ডার। ভুলে যাই আমার ‘অ্যাস্ট্রাফোবিয়া' আছে অর্থাৎ বজ্রপাত-ভীতি। ভুলে যাই, মেঘে-মেঘে ঝগড়া বেঁধে গর্জন শুরু করলে কোথায় লুকাব আমি। কোথায় লুকাব আমরা।

হঠাৎ অন্য খেয়াল ওঠে। ঝুম বৃষ্টি নামার আগেই টুপ করে ঘরের পাশের জঙ্গল থেকে কিছু বন্য ফুলকে গ্রেপ্তার করে আনি। ওদের এনে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার মুখোমুখি করাই। ওরা মিথ্যা বলে এক থেকে দুই হয়ে যায়! শরৎ মেখে যায় হেমন্তে। কাশফুলের কোমলে কোল ভরে যায়। মন ভরে ওঠে লৌকিক উৎসবের মতো প্রাপ্তির নবান্নে। আমাদের ভীষণ ভালো লেগে যায়। মাতাল মাতাল অনুভব। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম কী হবে ভেবে এত্তসব! তাই পরক্ষণেই পরনের কাপড়টা খুলে ফেলি। আলমারির সব থেকে নতুন কিংবা কখনোই না পরা শাড়িটা গায়ে জড়াই। চোখে গভীর কালো করে কাজলের ক্যানেল টানি। কাচের চুরি জোর করে হাতে পরি। কখনো বা বেখেয়ালে চুরি ভেঙে হাত কাটে যা আমরা পাত্তা দিই না। জোরে জোরে গান শুনি। একলা ঘরে দুই কাপ চা বানাই। পরের দিন স্কুলে পড়া পারি না। কারণ গতকালকে আমাদের জন্মদিন ছিল! কারণ গতকালকে আমার জন্মদিন ছিল!
...

জাহান রিমা: ইমার্জেন্সি ডেন্টাল কেয়ার, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।