দেশে শরৎ মানেই কাশফুল আর বাতাসে নতুন এক শিহরণের বোল। শরৎ এলেই ঢাকের তালে মনেতে দোল! শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দে তাই সনাতনী ধর্মাবলম্বীই কেবল নয়; দেশের সর্বত্র আরও অনেকেই রঙে রঙিন হয় এ সময়। তা ছাড়া, বাঙালির উৎসব কী আর ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ করা যায়? আবদ্ধ করা যায় না বটে, তবু দূরত্বের কাছে কিছুটা হার মানতেই হয়।
তাইতো দশ বছর আগে যখন সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় মেলবোর্ন শহরের বাসিন্দা হয়েছি, তখন এখানকার এক পূজামণ্ডপকে একটি সাজানো পুতুল ঘরের বেশি কিছু ভাবতে পারিনি। সেদিনের সে পূজামণ্ডপে উৎসাহী ঢাক বাদকের দেখা নেই। মঞ্চে বাতির যথেষ্ট ঝলক থাকলেও, প্রাণখোলা হাসির সে দমক নেই। অফুরন্ত পুজোর প্রসাদ হিসেবে সেই সন্দেশ-নাড়ু-মুড়ি-মুড়কিই বা কই? ‘ফেল কড়ি, মাখো তেল’ মেনে নিয়ে কিছু পোলাও কোর্মা খেয়ে বিরস বদনে বিদায় নিই সে যাত্রায়! তবে হতাশাময় সে অভিজ্ঞতা আজ নিতান্তই অতীত। বাংলাদেশির সংখ্যা ইদানীং বেড়েছে; তারা এখন তাদের মতো করে মেলবোর্নের বিভিন্ন দিকে চমৎকার সব পুজোর আয়োজন করছেন। সম্পূর্ণ বাঙালি কায়দায়। আর এ সকল পুজোর মাঝে হইচই ফেলেছে যে পুজোটি তা নিতান্তই এক ঘরোয়া আয়োজনের পুজো। ‘কৃষ্ণা কুটির’-এর ঘরোয়া সে আয়োজনেই কমসে কম তিন-চার শ লোক হয় ফি বছর।
গত তিন বছর এটি ছিল মেল্টনে। এবার হলো মেলবোর্ন থেকে আরও একটু দূরে, ব্যাকাস মার্সে। মেলবোর্নের জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই অপেক্ষা করে থাকেন সানিদাদের এ পুজোর জন্য। কৃষ্ণা কুটিরের পুজোর জন্য। কেউবা এটিকে অভিহিত করেন ‘মাসির বাড়ির পুজো’ হিসেবেও।
যে যে নামেই ভাবুন না কেন; মাসিমা ও তার পুত্র সানিদাসহ কৃষ্ণা কুটিরের সকলের অমায়িক আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েই দূর দূরান্ত থেকে মানুষের ঢল নামে এখানে। মেলবোর্নের ‘কৃষ্ণা কুটির’ রূপান্তরিত হয় ছোট্ট এক বাংলাদেশে।
তাদের এ ‘বাড়ির পুজো’ সম্পর্কে জানতে চাই সানিদার কাছে। সঞ্জয় চক্রবর্তী ওরফে সানিদা বললেন, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়াতে উদ্যাপিত এটিই একমাত্র পূজা, যেটি বাংলাদেশের পঞ্জিকা অনুযায়ী দিনক্ষণ তিথি নক্ষত্র মেনে সম্পূর্ণ সাত্ত্বিকভাবে পরিচালিত ও উদ্যাপিত একটি পূজা।
পাঁচ দিনব্যাপী এই পূজা করতে বাংলাদেশ থেকে পুরোহিত আনা হয়। প্রতিদিনই পূজার প্রসাদ বিতরণ করা হয় আগত অতিথিদের মাঝে। রোজ সন্ধ্যায় ঢাক ঢোল বাজিয়ে ধুনুচি নাচের সঙ্গে করা হয় সন্ধ্যা আরতি। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত এই পূজা। পাশে দাঁড়ানো সানিদার ভগ্নী ও ভগ্নিপতি ইতুদি-চন্দনদাও আরও জানালেন, ‘শুধুমাত্র স্বেচ্ছায় আনীত অর্থাৎ প্রতিমাকে উদ্দেশ্য করে পূজার নৈবেদ্য সামগ্রী অর্থাৎ ফলমূল ফুল মিষ্টি আর পুরোহিতকে দান করা নিজ পূজার দক্ষিণা ব্যতীত আর কোনো ধরনের চাঁদা বা ডোনেশন নেওয়া হয় না পূজায় আগত কারও কাছ থেকেই। পূজা উপলক্ষে মাসব্যাপী আয়োজন চলে কচিকাঁচাদের অনুশীলন। বিভিন্ন রকমের গান নাচ ইত্যাদির এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য।’
পাঁচ পাঁচটি দিনের এ বিশাল যজ্ঞের পর, যখন দশমীতেও মাসিমার পান খাওয়া টুকু টুকে ঠোঁটের হাস্যোজ্জ্বলতায় আপ্যায়িত হলাম; তখন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘কেমন করে পারেন মাসিমা?...এত এত মানুষ, টানা পাঁচ দিন সকাল বিকেল সামলানো। সে কী চাট্টিখানি কথা?’ মাসিমা'র হাসি যেন আরও একগাল বিস্তৃত হলো। বললেন. ‘মায়েরা সব পারে রে মা, সন্তানের জন্য...জানো না? এই যে তোমরা আসো, আনন্দ কর। এটুকু দেখেই তো ফি বারের পুজোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে যায়। তোমাদের ভালোবাসার টানেই তো মেল্টন ছেড়ে এত দূরে এসেও বাড়ির পুজো ছাড়তে পারলাম না!
আগত অতিথিদের মাঝে আইরিন নাদিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, কেমন লাগছে? খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি জানালেন, গত কয়েক বছর অনেক শুনেছি এই বাড়ির পুজোর কথা। কিন্তু এবারই প্রথম এসেছি। বর, পুত্র, কন্যাসহ দারুণ এনজয় করছি। মনে হচ্ছে যেন সেই ছেলেবেলার পুজোর গন্ধ পাচ্ছি।
বাংলাদেশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তো আছেনই; আছেন অস্ট্রেলিয়ান, ইউরোপিয়ান ও ভারতীয় কমিউনিটির কিছু মানুষও। সাংস্কৃতিক এ আদানপ্রদান বহু সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ভীষণভাবে সমাদৃত।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর নৈশভোজ সেরে বাড়ি ফিরলাম। ফিরলাম এক বুক শৈশবের বাংলাদেশ বুকে নিয়ে।
শুভকামনা রইল কৃষ্ণা কুটিরের সকলের জন্যে—‘ধর্ম যার যার, উৎসব সকলের’ এ সত্য প্রমাণিত হোক বছরে বছরে!