মেঘে মেঘে রংধনু-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিবের কফি শেষ হয়ে গেছে সেই কখন। তবুও কফির কাপটা তার মধ্যমা আঙুলের থেকে ঝুলছে কেমন অনির্ভরতায়। কাপটা দোল খাচ্ছে। দোল খেতে খেতে একবার পেছনটা উজিয়ে তুলছে, একবার মুখটা উজিয়ে তুলছে।

বাইরের মৃদুমন্দ বাতাস রাকিবকে বেশ শীতল আবেশ দিচ্ছে। ম্যাপল গাছের শরতের সোনালি রং করা পাতাগুলো একের পর এক শরীর বুলিয়ে ফুটপাত, রাস্তা ও সবুজ লনের ওপর আশ্রয় নিচ্ছে। শরৎ শেষ হতে না হতেই শীতের শুরুতে ম্যাপল গাছ ও ওক গাছের সমস্ত পাতা ঝরে যাবে। তখন প্রতিটা গাছকে মনে হবে বস্ত্রহীন নারীর মতো। পাতাহীন গাছেরও যে একটা দারুণ সৌন্দর্য আছে, রাকিব নিউজিল্যান্ড না এলে বুঝতে পারত না।

রাকিব ভাবল, আচ্ছা, বাংলাদেশে এখন কোন ঋতু? সে নিজে নিজেই হিসাব করে বাংলাদেশের ঋতুর নামটা বের করল। কিছুদিন আগে একুশের বইমেলা গেছে। ফেব্রুয়ারি মাস ছিল। এখন মার্চ মাস। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ। এখন বাংলাদেশে বসন্তকাল। কী আজব পৃথিবী! এক স্থানে সূর্যাস্ত তো অন্য স্থানে সূর্যোদয় হয়। এক স্থানে শরৎকাল তো অন্য স্থানে বসন্তকাল...।

রাকিব তার দৃষ্টিটা দিঘল করল। এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওয়াইকাটো নদীটা না দেখা গেলেও নদীর পাড়ের গাছগাছালির ঘন শীতল রেখাটা বোঝা যায়। ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট, জেলিকো ড্রাইভ, প্ল্যাংকেট টেরেস। আর খানিকটা দূরই হায়াস প্যাডক। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শনিবারে তার সেই হায়াস প্যাডকে যাওয়া হয় না। শুধু শনিবার নয়, কোনো বারেই তার সেখানে যাওয়া হচ্ছে না। সেই পাঁচটা ওক গাছ। এলোমেলো কিছু পাইন গাছ। নদীর জলের অনেকটা অবধি নেমে যাওয়া কাঠের ডক। ওয়াইকাটো নদীর স্রোত-কল কল, কুল কুল, কল কল।

রাকিব আজ ইচ্ছে করলে নদীকে নিয়ে ওখানে গিয়ে বসতে পারে। আজকের সারাটা দিনই তো পড়ে আছে। মাউন্ট পিরংগিয়া আর কত দূর। মাত্রই তো ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। বিকেলের দিকে ওখানে গেলেই হতো। সন্ধ্যার দিকে নারোটা লেক।

নদীকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে নারোটো লেকে যাওয়ার কারণ, রাকিব গত সপ্তাহে অফিসে তার এক কলিগের কাছে শুনছে, সন্ধ্যায় সেই লেকে নাকি ব্যাঙ ডাকে। ব্যাঙের ডাক-ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, কটর কট, কট কট, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ!

নিউজিল্যান্ডে আজকাল আর কোথাও ব্যাঙের ডাক তেমন শোনা যায় না। রাকিব শুনেছে, এক সময় নাকি নিউজিল্যান্ডে প্রচুর ব্যাঙ ছিল। ছোট-বড় জলাশয়, আনাচকানাচে প্রচুর ব্যাঙ ডাকত। সেই সব ব্যাঙ আজ কোথায় যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া নদী কখনো গ্রামে থাকেনি। গ্রামের আবহে যে ব্যাঙের ডাক শোনা, সেটা নদীর কখনো হয়নি।

নদীর আসতে এখনো ঢের সময় বাকি। সে দুপুরে আসবে। রাকিব ভাবল, কিন্তু নদী দুপুরের কখন আসবে, সে কী ফোন করে একবার জিজ্ঞেস করবে?

রাকিব মাথা নাড়ল। নদীকে অবশ্য নারোটো লেকের কথা বলা হয়নি। শুধু মাউন্ট পিরংগিয়ার কথাই বলা হয়েছে। মাউন্ট পিরংগিয়া থেকে নারোটো লেক খুব বেশি দূরে নয়। হয়তো কান্ট্রি রোড ধরে গেলে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। কিন্তু কথা সেটা নয়। নদী সন্ধ্যার সময় নির্জনে তার পাশে বসে ব্যাঙের ডাক শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করবে তো?

নদী রাজি না হলে রাকিব আজ নারোটো লেকে যাবে না। সন্ধ্যার সময় নির্জনে লেকের পাড়ে তার পাশে বসে থাকতে নদী আপত্তি জানালে সে না হয় একাই যাবে। আহা, কত দিন সে ব্যাঙের ডাক শোনে না!

তবে রাকিব নিশ্চিত, নদী কোনো আপত্তি করবে না। আজ না যাক অন্যদিন অবশ্যই যাবে। নদী তো ঘুরতে পছন্দ করে। রাকিবের ইচ্ছে আছে নদীকে নিয়ে সে একদিন নারোওয়াহিয়ার দ্য পয়েন্টে নিয়ে যাবে। যেখানে ওয়াইকাটো ও ওয়াইপা নদী এসে মিলেছে। হাকুরিমাতা রেঞ্জ থেকে যে নদী দুটোকে দেখা যায় নারীর জোড়া সিঁথির মতো। যেন জোড়া সিঁথি নদী...! দ্য পয়েন্টের অদূরেই তো টুইন রিভার রেস্টুরেন্টে নদীর সঙ্গে রাকিবের প্রথম পরিচয় হয়েছিল।

রাকিব নদীর কথা ভাবতে ভাবতে কফির কাপটা মধ্যমা আঙুল থেকে ঘুরিয়ে শক্ত মুঠোতে ধরল। দরজা ঠেলে লাউঞ্জে ঢুকতেই বাসার টেলিফোনটা বেজে উঠল। টেলিফোনের আওয়াজ শুনে কেন জানি তার মনে হলো, অস্ট্রেলিয়া থেকে তার ছোট ফুফু ফোন দিয়েছেন।

ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে সত্যি ছোট ফুফুর গলা ভেসে এল। রাকিব নিজে নিজে মৃদু হেসে বলল, হ্যালো, বলো।

ছোট ফুফু ব্যস্ত গলায় বললেন, রাকিব, আমি তোর ছোট ফুফু বলছি।

রাকিব বলল, ছোট ফুফু, তোমাকে ঘটা করে পরিচয় দিতে হবে না। আমি তোমার গলা শুনলেই বুঝতে পারি। শুধু গলা শুনলেই না, টেলিফোনের আওয়াজ শুনলেই আমি এখন কেন জানি বুঝতে পারি যে তুমি ফোন দিয়েছ।

: তুই ফাজলামি করছিস?

: ফাজলামি না। আমি ঠিকই বলছি।

: দেখ রাগাবি না।

: এখানে রাগের কী আছে ছোট ফুফু?

: আমি তোর মোবাইলে ফোন দিইনি যে তুই আমার নাম আর নম্বর দেখে চিনে যাবি। আমি তোর ল্যান্ড নম্বরে ফোন দিয়েছি।

: ল্যান্ড নম্বরে কি নাম ও টেলিফোন নম্বর সেভ করা যায় না।

: করা যায়। তবে তোর মতো গাধা এ কাজটা কখনো করবি না। মান্ধাতার আমলের টেলিফোন সেটই ব্যবহার করবি। আর কলার আইডি নিতে হলে পাঁচ ডলার বেশি দিতে হয়। তুই ওই টাকা কী খরচ করবি?

: নিউজিল্যান্ডে বা অস্ট্রেলিয়ায় আমার মতো ব্যাচেলর শুধুমাত্র মোবাইল ফোন রাখে। ল্যান্ড ফোন রাখে না। কিন্তু আমি রেখেছি। আর তুমি আমাকে টাকা খরচের কথা বলছ? তুমি নিজেকে এই প্রশ্নটা কর তো?

: আমি কী প্রশ্ন করব?

: তোমাকে কোনো প্রশ্নই করতে হবে না। তুমি ফোন দিয়েছ কেন, ওটা বলো।

: ওটা বলার আগে একটা কথা বলে নেই, তুই কি আমাকে ফোন করার পর প্রশ্ন করিসনি যে, আপনি কে? কাকে চাচ্ছেন?

: হ্যাঁ, বলেছি। সিচুয়েশন ডিমান্ড। হয়তো আমি ঘুমের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে এ প্রশ্ন করেছি। হয়তো...! কিন্তু আমি তোমাকে কখন এই প্রশ্ন করেছি, আমার মোটেও মনে নেই।

: তাহলে কি আমি মিথ্যা কথা বলছি?

: ছোট ফুফু, থাম। এই ছোট্ট বিষয়টাকে এত গাঢ় করার দরকার নেই। আমি সরি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। ওকে?

ছোট ফুফু ফোনের ওপাশে একটু চুপ থেকে বললেন, ওকে। তবে আমি আজকাল তোর কাছে নিজেকে সেফ সাইডে রাখার জন্যই ফোনের শুরুতে ঘটা করে পরিচয় দিচ্ছি।

রাকিব বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কীসের সেফ সাইড?

: ওই যে, আরেকজন তোকে ফোন দেয়। তোর মা। আমার ফোন পেয়ে তুই যদি আবার আমাকে মা ডেকে বসিস?

: ছোট ফুফু, আসলেই তুমি দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছ।

ছোট ফুফু এবার টেলিফোনের ওপাশে হেসে ফেললেন, হি–হি, হি–হি।

রাকিব গম্ভীর গলায় বলল, এভাবে হাসবে না ছোট ফুফু। আমার রাগ ধরে যায়। এবার আসল কথা বলো। তুমি ফোন দিয়েছ কেন?

ছোট ফুফু হাসি ধরে রেখেই বললেন, তোকে একটা সুখবর দেওয়ার জন্য।

: কী সুখবর?

: তোর হাফ-ব্রাদার নয়ন বিয়ে করেছে।

: সে তো বিয়ে করতেই পারে। বাংলাদেশ গেছে বিয়ে করার জন্য। পাত্রী আগে থেকে জানাশোনা।

: পাত্রী আগে থেকেই জানাশোনা মানে?

: মেয়েটা অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটিতেই লেখাপড়া করত। নয়ন ও মেয়েটার মধ্যে আগে থেকে জানাশোনা ছিল।

: ওমা, তুই এত খবর জানিস কীভাবে?

: আফটার অল, নয়ন আমার হাফ-ব্রাদার। সে সবকিছু আমাকে জানাতেই পারে।

: আসলে আমিই যত গাধা।

: এই তো একটা সঠিক কথা বললে।

: দেখ আমাকে রাগাবি না।

: আচ্ছা, ঠিক আছে।

: আমি ভেবেছি, তোর মা সব খবরাখবর আমাকে দেয়। এখন দেখি, আমার ধারণা ভুল।

: তুমি সবকিছু পারসোনালি নেও কেন ছোট ফুফু?

: হ্যাঁ, পারসোনালি নিচ্ছি। কারণ, আমি না থাকলে সে কী তার ছেলেকে খুঁজে পেত?

: পেত না, তোমাকে ওটা কে বলেছে?

: তুই আমাকে বল, আমি সেদিন আলী ভাই ও শেলি ভাবির বাসায় দাওয়াত খেতে না গেলে সে তোর সন্ধান পেত কীভাবে?

: ওটা একটা কো-ইনসিডেন্ট ছিল।

: তোকে বলেছে...! আর তুই বলবিই তো, যেমন মা তেমন তার ছেলে!

রাকিব আবার গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ছোট ফুফু, তোমার কী আর কিছু বলার আছে?

ছোট ফুফু পাল্টা জিজ্ঞেস করল, তুই কি টেলিফোন রেখে দিতে চাচ্ছিস?

রাকিব আস্তে করে বলল, হ্যাঁ। কারণ তোমার সঙ্গে এ মুহূর্তে কথা বলতে কমফোর্টেবল বোধ করছি না।

ছোট ফুফু জোর গলায় বললেন, দেখ রাকিব, খবরদার বলছি, ফোন রাখবি না।

রাকিব কী ভেবে ফোনের এপাশে হেসে ফেলল। তবে শব্দ করে হাসি নয়। বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। টেলিফোন কাটব না। তবে তোমাকে সুন্দর করে কথা বলতে হবে।

ছোট ফুফু বললেন, হয়েছে, তুই আমাকে কথা বলা শেখাতে হবে না। আচ্ছা, একটা কথা বল তো, তোর মা নয়নের বিয়ের খবর তোকে না জানিয়ে আমাকে জানাতে গেল কেন?

: সেটা আমি জানব কীভাবে?

: তা অবশ্য ঠিক।

: আর আমাকে বিয়ের খবর জানাননি, ওটা তোমাকে কে বলেছে?

: আমি বললাম। তোর মা আমাকে বাংলাদেশ থেকে ফোন দিয়েছে।

: বাংলাদেশ থেকে ফোন দেওয়া এক সময় ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। কঠিনও ছিল। এখন তো অনেক সহজ।

: তারপরও তো তোকে ফোনে খবরটা না দিয়ে আমাকে ফোন দিল?

: তিনি তোমাকে কবে ফোন দিয়েছেন?

: গতরাতে।

: ওটা তো তোমাকে অনেক পরে দিয়েছে।

: পরে মানে?

: আমাকে ফোন দিয়েছেন গত সপ্তাহে। নয়ন যেদিন বিয়ে করল।

: নয়ন তো গতকাল বিয়ে করেছে?

: তোমাকে কে বলেছে?

: তোর মা বলল।

: নয়নের গতকাল বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। বিয়ে হয়েছে গত সপ্তাহেই। আর কিছু?

ছোট ফুফু একটু চুপ হয়ে গিয়ে বললেন, তোর মা দেখি একটা কালপ্রিট? সে একমুখে...!

রাকিব কথাটা টেনে নিয়ে বলল, ছোট ফুফু, কোনো ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে এভাবে মন্তব্য করতে নেই।

: ওরে বাব্বা! মার জন্য দেখি দরদ উথলে উঠছে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম সে তোর মা। যে তোকে চার-পাঁচ বছর বয়সে ফেলে লাং ধরে পালিয়ে গেছিল!

: তুমি এভাবে কথা বলছ কেন ছোট ফুফু? তুমি কিন্তু কথাবার্তার শালীনতা একদম হারিয়ে ফেলেছ।

: তোর কাছ থেকে আমাকে শালীনতা শিখতে হবে না। যেমন মা তেমন পোলা। মা লাং ধরে চলে যায়। এদিকে পোলার বউ আবার লাং ধরে চলে গেছে। খেতের ইটা খেতেই ভাঙে। আলে তুললে ভাঙে না...!

: ছোট ফুফু, তুমি এ রকম হলে আমাকে ফোন দেবে না। আর কক্ষনো ফোন দেবে না। তোমার কোনো প্রয়োজনেও ফোন দেওয়ার দরকার নেই। আমি তোমাকে কখনো বলিনি, আমাকে ফোন দিতে...!

ছোট ফুফু কোনো কিছু না বলেই কট করে টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন।

ছোট ফুফু টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়ার পর রাকিবের এবার খারাপ লাগার চেয়ে এক ধরনের হাঁপ ছাড়া স্বস্তিই এসে ভিড় করল। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। পরক্ষণই কেন জানি তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

রাকিব কর্ডলেস ফোন সেটটা হাতে নিয়েই সোফায় স্থির হয়ে বসে রইল।

আতিক তখনই তার রুম থেকে বেরিয়ে এল। তার ঘুম ঘুম চোখ। কর্ডলেসটা রাকিবের হাতে ধরা দেখে জিজ্ঞেস করল, কে ফোন দিয়েছে?

রাকিব বলল, ছোট ফুফু।

আতিক ছোট্ট করে বলল, ও।

রাকিব তাড়াতাড়ি বলল, আই অ্যাম সো সরি। আমার বেডরুমে গিয়ে কথা বলা উচিত ছিল। তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।

আতিক মৃদু হেসে বলল, অসুবিধা নেই। তোমার ফোন আসার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে। এতক্ষণ এমনিই শুয়ে ছিলাম। তুমি ফোনে কথা বলছ দেখে বের হইনি।

রাকিব একটা লজ্জার হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকাল। মুখ কিছু বলল না। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন