জীবন আসলে তুরুপের তাস

লেখিকা
লেখিকা

আজ সারাটা দিন থেকে থেকে বাড়ির কথা মনে পড়েছে। হৃৎপিণ্ডের ভেতর গেঁথে যাওয়া ছবির মতো বাড়ির কথা মনে পড়েছে। মনে পড়েছে, বাবার গোলার্ধীয় চোখগুলো, ভালোবাসার মানুষগুলোর স্ফটিক স্বচ্ছ কবিতার মতো হাসি। মনে পড়েছে, বেশুমার ভ্রাতৃত্ব। এ দেশ আমার স্বাধীনতা চুরি করে নিয়েছে, অথচ এই আমি এখানে পড়ে আছি! আশা-ভালোবাসার দোষে জীবনকে লাই দিয়ে মাথায় তোলার অপরাধে আমার আর ফেরার উপায় নেই। বহু দরজা উন্মোচিত হয়েছে, মগজের মাঝখানে ইংরেজি ভাষার ছোঁয়া লেগেছে। অস্বীকার করি না, এখন যেখানে আছি তার বিপুল দায়িত্বের ভার আমাকেও মাঝেমধ্যে নার্ভাস করে। পরদেশে নিজের আত্মসম্মানবোধ থাকল কী নেই পরখ করারও ফুরসত হয়নি। আমার সন্তানেরা বিদেশি শব্দের পুরিয়া ঠেসেছে মুখে। তারা ছবি আঁকার ব্রাশ দিয়ে কেবল ক্যাসল আর গোলাপ ফুল দাগায়। তারা জানেই না বাঁশের সাঁকো, সরু নদী, কবুতরের খোপের সুন্দর রূপ।

এমন করেই ভাবছি সারা দিন আর স্মৃতিগুলোকে ফালি ফালি করছি টকটকে লাল তরমুজের মতো। কন্যারা কাতর ঠান্ডায় আইসক্রিম-কোনের ওপর সিরাপ ঢেলে স্প্রিংকল মিশিয়ে হই হই করে হাসছে। আমি মোবাইলে অনুভূতি আঁকছি আর ভাবছি। ফেলে আসা বাড়ি, দুই ক্রোশ দূরের শালবন, নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, নদীর ওপারের সবুজ মাঠ—দেখে মনে হয়, একটা ছবির ফ্রেম বসানো আর তার ওপরে একটা আকাশ নীল হয়ে ঝুঁকে আছে। যেন ওই ফ্রেমের ভেতর দিয়ে যে কেউ-ই ওখানে যেতে পারে। বয়স গড়িয়ে গেলেও পারে!

বৃষ্টির জমা জলে অ্যাডিলেডের রাস্তাগুলো খুব চওড়া লাগছে। এমন বৃষ্টির দিনে আমি আর আমার ভাই বাড়ির পেছনের পুকুরে গিয়ে পোষা কুকুরছানা ধরে জলে ছুড়ে দিতাম। ওরা ঠিকঠাক সাঁতার কেটে ফিরে আসত। আবার ছুড়ে ফেলতাম। মরার ভয়ে ওরা সাঁতরাত। আমরা বুঝতাম না। আমাদের খেলা ছিল ওটা। অবাক হয়ে ভাবতাম, কী করে পারে ওরা এমন করে সাঁতরাতে—কেউ তো শেখায়নি। ‘প্রকৃতি শেখায় ওদের’—দাদু বলেছিলেন।

রায়া আমার বড় কন্যা। ছবি এঁকেছে আমাকে খুশি করার জন্য। বাবুই পাখির বাসা। পরের পাতায় সবুজ ধানখেত। তারপর একটি কুকুরছানা সাদা-কালো ছোপের। আমি দেখছি আর ভাবছি, এই বুঝি এক্ষুনি কোনো আলোকে প্রাণ-প্রদীপের মধ্যে উঠে আসবে কুকুরছানাটির আদুরে ডাক! দুই বেণি ঝুলিয়ে ফুলহাতা ফ্রক পরে কাঁপা হাতে হারমোনিয়ামের রিড সামলাবার চেষ্টা করছে আমার ছোট কন্যা। বেলো-টানার চোটে হারমোনিয়াম কোল ঘেঁষে সরে আসছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গান শুনে, লোকজন জানালা দিয়ে মুখ তুলে দেখছে, এক ঘর বাংলাদেশি মানুষের ঐতিহ্যের রিহার্সাল। এ দেশে আবর্জনা টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা জাম্বো সাইজ গাড়ি আসে নিয়ম করে—ঢং ঢং ঢং শব্দ করে। আর এই শব্দ শুনলে বুকের ভেতর হাঁসফাঁস করে ওঠে। কানে হাত দিয়ে বসে থাকি। সব সময় এমন হয় আমার। মনে হয় গাড়িটা বুকের ওপরে এসে দাঁড়াবে এবং আমাকেও ভরে নেবে ওর পেটে, আবর্জনা ভেবে।

হাঁটতে বেরিয়েছি সূর্য পাটে নামার একটু আগে। আকাশ থেকে কমলা রঙের রোদ সব দালান-কোঠা মোলায়েম করে দিচ্ছে। পশ্চিমে গলা সাধছে একটা কোকিল। সন্ধ্যা নামবে বলে গোটা বিকেল স্যুটার পার্কে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছে অন্নময়। ‘অন্নময়’ শব্দটা লিখতেই হঠাৎ একটা সাধুর কথা মনে পড়ল। বলেছিলেন, ‘অন্ন ভক্ষিত হয়ে ত্রিবিধরূপে পরিণত হয়। উহার যেটি স্থূলতম অংশ তাহা মলে, মধ্যম অংশ মাংসে ও সূক্ষ্মতম অংশ মনে পরিণত হয়।’ বিকেলের রোদটা মনে হচ্ছে আমার কাছে সূক্ষ্মতম। সাধু আমাকে আরও বলেছিলেন, ‘ওগো মা, দধি যখন মন্থন করা হয় তখন তাহার যেটি সূক্ষ্মাংশ তা ওপরে ওঠে এবং ঘৃতে পরিণত হয়। ঠিক এরূপেই ভক্ষমান অন্নের যেটি সূক্ষ্মাংশ তা ওপরে উঠে মনে পরিণত হয়।’ এই থেকে বুঝেছি মন, বাস্তব ও কল্পনা। হাঁটছি, ভেজা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছি আর ভাবছি, কত শর্তে-টর্তে জীবন বাঁধা মানুষের—প্রত্যেক ঘণ্টার কাছে, মিনিটের কাছে! হৃদয়ের সেফটিলকারে কত কথা-ই তো গোপনে সাজিয়ে রাখে মানুষ। আচ্ছা, চাবির ফুটো দিয়ে নেমে পড়লে পৃথিবীর এমন কোনো জায়গায় চলে যাওয়া যায় না যেখানে হাওয়া–বাতাস খুঁটে তুললে আনন্দ উথলে ওঠে?

পাশের বাড়ির স্কার্ট পরা পড়ন্ত বয়সী গ্রিক বৃদ্ধা তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। রাস্তা থেকে দেখছি ঘরের আলো নেভানো। ভূতের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এত কম কথা বলেন এখন! ইশারা করলেন, আমি যেতে পারব কিনা। হাত উঁচিয়ে বললাম, ‘না, আজ যাব না।’ চার রাস্তার মোড়ের কাছে দাঁড়াতেই কোথা থেকে একটা কাগজ পায়ের ওপর থেবড়ে পড়ল। তুলে নিয়ে দেখলাম, একটা ডিজিটাল প্রিন্ট করা ছবি—অনেক পরিচিত। এই যিশুর দেশে এমন ছবি পাওয়া দুর্লভ বটে। হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছি—ইস! এই ছবি কত দেখেছি অতুল চাচার বাড়ির দেয়ালে বাঁধানো। কালী নাগের মাথায় চড়ে নাচছে বালক শ্রীকৃষ্ণ। চারদিকে গোপী বালিকারা। ছবির নিচে ইংরেজি ও হিন্দিতে মোটা অক্ষরে লেখা:

কালীয় দমন
KALIYA DAMAN

তার নিচে বাঁ দিকে,

PUBLISHED BY
ৎROY BABAJEE & CO.

ছবিটা ভাঁজ করে উইন্ডি জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিলাম। দয়াবতী আন্টিকে দেব তারপর তার মুখভঙ্গি দেখব। কী করে বলেন, ‘হায়! ভগবান...কাঁহাসে মিলা বেটি আপকো এ কৃষ্ণ কানাইয়া কী পিকচার?’

ঠান্ডা হাওয়া কানের লতিকে অসার করে যাচ্ছে। সময় নিয়ে নাড়াচাড়া আমার ভালো লাগে। এই খেলা একদম অন্যরকম। জীবনকে খুঁচিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। জীবনের সমস্ত কোলাহল, হাসি-কান্না সব সাদামাঠা কথা তখন গল্পকথা হয়ে সামনে দাঁড়ায়। কখনো নিজের বাঁ হাতের ফুলে ওঠা নীল শিরার জলের ঢেউয়ে নিজের মুখের ভূগোল পাল্টে গিয়ে সেখানে চেনা গণ্ডির ম্যাপ ভেসে ওঠে। আজ হৃদয় কোণের ভটভটি নৌকায় অনেক স্মৃতি এসে উঠছে। হারিকেনের আলোয় দুলছে পরিচিত মুখগুলো, ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো! অথচ জীবন নৌকার দুলুনিতে আজ এ চোখ নদীতে কেবলই বিদেশ-বিভুঁই...।
...