জীবন যখন যেমন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রায় বছর তিনেক আগে আমার অত্যন্ত প্রিয় ও অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র ইনস্টিটিউটের মধ্যে রেকর্ড মার্কস পেয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে। ছাত্রটির নাম মার্ক ক্যাম্পোব্যাসো। মার্ক চাকরি খোঁজে না। ইচ্ছে পিএইচডি করবে। বড় গবেষক হবে। মার্ক একদিন আমার অফিসে ফোন করল, ‘সাদিক তুমি কি আমাকে একটু দেখতে আসবে? আমি অস্টিন হসপিটালের ব্লাড ক্যানসার ওয়ার্ডের আইসোলেশন কেবিনে আছি। আমার লিউকোমিয়া ধরা পড়েছে।’

মার্কের ফোন পাওয়ার পর আমি অফিসে এক সেকেন্ড দেরি না করে ড্রাইভ করে অস্টিন হসপিটালে মার্কের আইসোলেশন কেবিনে গেলাম। আমার বোধ হয় ওইভাবে সঙ্গে সঙ্গে একা ড্রাইভ করে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি কোন পথে, কীভাবে হসপিটালে পৌঁছেছি এখন মনে করতে পারছি না। মার্ককে দেখে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি না। তার বিছানার কাছে গিয়ে মৃদু হেসে বলি, ‘আজ কেমন আছ, মার্ক?’ মার্কও মৃদু হেসে বলে, ‘আজ অনেকটা ভালো।’

আমি মার্ককে তার অসুখ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করি না, সেও তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে কিছু বলে না। আমি তার রিসার্চ নিয়ে কথা বলি, তার ভবিষ্যৎ অভিলাষ নিয়ে আলাপ করি। বিভাগের মজার মজার ঘটনা নিয়ে কৌতুক করি। হসপিটাল থেকে চলে আসব, মার্ক বলল, ‘সাদিক তুমি মাঝে মাঝে এসো। তোমাকে দেখলে অনেক ভরসা হয়। মনে অনেক শক্তি পাই। তুমি দেখ, আমার কিছু হবে না।’ হসপিটালের ছায়া ঘেরা সুশীতল কার পার্ক থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসি। গ্রীষ্মের রৌদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে দিন। তবুও গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে বাইরের সবকিছু ঝাপসা লাগছে। বুকের গভীর থেকে বড় একটি বিষাদের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, মনে মনে বলি, পরম করুণাময়, তাই যেন হয়!

দুই সপ্তাহ আগে মার্কের ফোন এল আমার মোবাইলে—‘সাদিক, এই সপ্তাহে কবে ফ্রি আছ, তোমার কাছ আসব।’ বললাম, ‘তুমি কালকেই আসো, মর্নিং টির পরে আসো, তার আগে আমি একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকব।’ বেলা বারোটার দিকে মার্ক আমার অফিসে এল।

মার্ককে যখন প্রথম দেখি প্রথম বর্ষের আমার একটা ক্লাসে, আমি বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। গ্রিক দেবদেবীদের অনেক কাহিনি পড়েছি, তাদের চেহারার বর্ণনা পড়েছি, সাহিত্য, গল্প-উপন্যাসে তাদের উপমা পড়েছি। চোখে দেখিনি। মার্ক গ্রিক দেবতাদের মতো সুঠাম বলিষ্ঠ পেশিবহুল দেহের অধিকারী না, কিন্তু তার অবয়ব দেখে কেন যেন আমার ওই মুহূর্তে গ্রিক দেবতাদের চেহারার অবয়বটাই চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। প্রসঙ্গগত বলছি, সব গ্রিক দেবতাই পেশিবহুল শরীরের অধিকারী ছিলেন না। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো ছিলেন সুদর্শন, রুপালী ধনুকের প্রভু, মহান সুর স্রষ্টা, একাধারে ধনুর্বিদ্যার দেবতা, শিল্প-সংগীতের দেবতা। অ্যাপোলোর জন্ম সাত মাসে, তাই তিনি ছিলেন শিশুকালে খুব রুগ্‌ণ।

মার্কের মা ইতালিয়ান, বাবা গ্রিক। পড়াশোনা ছাড়াও মার্কের অন্যতম প্রিয় বিষয়, নেশার মতো বিষয়, সংগীত আর সুরসৃষ্টি। অফিসে মার্কের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প হলো, এলোমেলো ধরনের গল্প। বললাম, ‘চল তোমাকে নিয়ে লাঞ্চ করব’। ইনস্টিটিউটের কাছেই হাঁটার দূরত্বে ছোট একটা শপিং মলের ফুডকোর্টে এলাম দুজনে। খেতে খেতেও হাজারো গল্প। একপর্যায়ে মার্ক বলল, ‘সাদিক এখন আর আমি চাকরি খুঁজছি না, লেখাপড়ার কথাও ভাবছি না। আগের মতো তো আর সেই শারীরিক সামর্থ্য নেই। তাই আমি নিজেকে এখন সংগীতে ডুবিয়ে রেখেছি। গান লিখি, সুর করি। একটাই আশা যদি চমৎকার কিছু সুরের সৃষ্টি করে যেতে পারি!’ আমি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলি, ‘তুমি পারবে, মার্ক!’

বিকেল দুইটায় আমার আবারও রিসার্চ প্যানেলের একটা মিটিং ছিল। ফুডকোর্ট থেকেই দুজনে দুজনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য রাস্তার ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়েছি। মার্কের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই সেও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘Thank you, Sadiq! I am really honoured that I have got special mentor in my life!’ মার্ক রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরবে। আমি ফুটপাথের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছি, মার্কের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। সে কয়েক পা গিয়েই আমার দিকে ফিরে এল! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে দেখে তোমার কী মন অনেকটা খারাপ, সাদিক? মন খারাপ করো নাতো, এই যে আমি বেঁচে আছি, তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তাই বা কম কীসে।’

ক্যানসারের হিংস্র থাবা মার্ককে একেবারে ছেড়ে দেয়নি। তার মাথার সেই ঘন সোনালি রঙের ঝাঁকড়া চুল আর নেই। মায়াভরা চোখদুটোর ভেতর কোনো প্রাণ নেই। চোখদুটো ফ্যাকাশে রঙের হয়ে গেছে। টিকোলো নাকের আগা মনে হলো একটু বেকে গেছে। পায়ে শক্তি নেই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। থাক, তার চেহারা নিয়ে আর ভাবতে চাচ্ছি না।

মার্ক চলে যাচ্ছে, আমি তার পেছন দিকে তাকিয়ে আছি। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ভালো লাগার ভেতরে যে এত কষ্ট থাকতে পারে আগে বুঝিনি তো! মার্ক বেঁচে আছে, চলাফেরা করছে, দেখে ভালো লাগল। সেই সঙ্গে গলার কাছে একটা কষ্টের ঢেলা আটকে আছে, ঢেলাটা সারা বুকের পাঁজরে ছড়িয়ে পড়ছে। ওগরাতে পারছি না। দুই চোখের কোণা শিরশির করছে।

আমি আমার পথে পা বাড়ালাম। মনে মনে বলি, ‘দয়াময় এই অল্পবয়সী ছেলেটাকে সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রেখ। তোমার এই সুন্দর পৃথিবীতে!’

অস্ট্রেলিয়া আসার আগে আমি একসময় ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। জীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। অনাগত ভয়ংকর, কবরের অন্ধকারের মতো ভয়াবহ জীবনের কথা ভেবে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। মায়ের ঘরেই থাকতাম, পাশাপাশি দুটো খাট, এক খাটে আমি, অন্য খাটে মা। ভয়ংকর দিনগুলোর কথা ভেবে যখন কেঁপে কেঁপে উঠতাম, মুখ দিয়ে হয়তো নিজের অজান্তেই মা ডাক বের হয়ে আসত, ঘুমের ভেতরেও মা জবাব দিতেন, ‘এই যে বাবা, এই যে আমি!’ এখন যখন একটু অসুস্থ হই, অথবা মন খারাপ থাকে, অথবা কিছুই ভালো লাগে না, খুব শুনতে ইচ্ছে হয়, ‘এই যে বাবা, এই যে আমি!’

মা অসুস্থ হয়ে ল্যাব এইড হাসপাতাল ছিলেন।। মেলবোর্ন থেকে মাকে দেখতে গিয়েছি। ল্যাব এইড হাসপাতালের বেডে, মা নাকে নল, দুই হাতে স্যালাইন নিয়ে শুয়ে আছেন। কালশিটে পড়ে চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। কথা বলার ক্ষমতা নেই। জড়িয়ে কথা বলছেন, বোঝা যায় না। মাকে দেখে চমকে গেলাম! ছয় সাত মাস আগে বড় ভাইয়ের ছেলের বিয়ে উপলক্ষে ঢাকা গিয়েছিলাম, তখন মাকে দেখেছিলাম। এখন এই কোন মাকে দেখছি?

ইনস্টিটিউট থেকে মাত্র পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে গিয়েছি। মেলবোর্নে তখন পূর্ণোদ্যমে সেমিস্টারের ক্লাস চলছে। চলে আসতে হবে। চাকরির দায়িত্বটা বেশি বড় হয়ে উঠল, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। মার কাছ থেকে বিদায় নেব। মার শয্যার পাশে দাঁড়ালাম। আলতো করে মার কপালের ওপর চিবুকটা রেখে লেপটে থাকি কিছুক্ষণ। মাকে বলতে চাইলাম, মা আমি এখন যাচ্ছি, বলা গেল না। গলা বুঁজে আসছে, বুক ভারী হয়ে আসছে! মা কী বুঝলেন জানি না অনেক কষ্ট করে, কাঁপা হাতে আমার মাথাটি ধরে বুকের সঙ্গে চেপে রাখলেন। আলতো করে আমার কপালে শুষ্ক ঠোঁট দুটি ছোঁয়ানোর চেষ্টা করলেন। মা তার দুর্বল হাত দুটি আলগা করে দিয়ে আমার মাথাটি ছেড়ে দিলেন! মা আমার দিকে তাকিয়ে নেই, দৃষ্টি শূন্যে। দুই চোখের কোণায় বড় বড় দুটি পানির বিন্দু! আমি জানি মা কেন শূন্যে তাকিয়ে আছেন। মায়ের নিঃশব্দ কথাগুলো আমি শুনতে পাচ্ছি! শুধু শুনতেই পাচ্ছি না, আমার মর্ম মূলে গেঁথে যাচ্ছে! আমার বুকের পাঁজরে বসে যাচ্ছে! মা শূন্যেই তাকিয়ে আছেন! আমি ল্যাব এইডের সিসিউ থেকে বের হয়ে আসি।

ঢাকা থেকে মেলবোর্ন চলে আসার পাঁচ দিন পর দাদা ফোন করে বললেন, ‘মা আর নেই রে!’

আমরা মায়ের জন্য কে কী করেছি জানি না। তবে আমার বড়ভাই, দাদা, তিনি মায়ের অসুখের সময় দেখিয়েছেন, মা অন্তঃ প্রাণ একজন সন্তানের প্রতিচ্ছবি। আমার ধারণা ছিল আমিও সন্তান হিসেবে একেবারে খারাপ না। কখনো মায়ের সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলিনি। মা অসুস্থ হয়েছেন, অনেক কষ্টে সেমিস্টার চলাকালে ছুটি ম্যানেজ করেছি। হাসপাতালে মায়ের বেডে বেশি বেশি সময় কাটানোর চেষ্টা করেছি। মায়ের জন্য দোয়া করেছি, কিছুতো করেইছি।

বেশ কয়েক বছর আগে পবিত্র মক্কা শরিফে গিয়েছিলাম, ওমরাহ করতে। পবিত্র কাবা ঘর তাওয়াফ করছি, পাশেই দেখি এক বয়স্ক ছেলে তার ততোধিক বয়স্কা মাকে নিয়ে তাওয়াফ করছে। ছেলেরও অনেক বয়স, পিঠ কুজো হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যও ভালো না, শুকনা পাতলা। মাথার চুলও বেশির ভাগ পাকা। সঙ্গে কোনো হুইল চেয়ার নেই। ছেলে পিঠ বাঁকা করেই মাকে ঘাড়ে নিয়ে তাওয়াফ করছেন। মা ছেলে দুজনেই পড়ছেন, ‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক...’, এভাবেই কাবা ঘরের চতুর্দিকে, একবার, দুবার...সাতবার। তারপর সাফা মারওয়া পাহাড়ে। আমি অনেকক্ষণ মা-ছেলের পেছনেই হাঁটলাম। কী অপূর্ব দৃশ্য! এই মানুষটা একজন মায়ের সন্তান, আমিও একজন মায়ের সন্তান!

কাহিনিটা এই মেলবোর্নে আমার অনুজসম এক ডাক্তারের কাছে শোনা। মা–ছেলে দুজনেই ডাক্তারটির পেশেন্ট। মা এক সময় এই মেলবোর্নেরই গাইনির স্পেশালিস্ট ছিলেন। বেশ অনেক দিন আগেই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। অতীতের কথা তার কিছুই মনে নেই। তিনি শুধু বর্তমানকে বোঝেন। আর ছেলে পিটারকে চেনেন। মায়ের আর একটি জিনিস খুব ভালো মনে আছে সেটি হলো ছেলে পিটার ছোটবেলায় যে বিয়ার (ভালুক) নিয়ে ঘুমাত সেই বিয়ারকে। ছেলের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাকে দেখাশোনা করতে হয়, সেবা করতে হয়, সেই জন্যে বিয়েই করেনি, কোনো সম্পর্কেও জড়ায়নি। ছেলে সারাক্ষণ মাকে চোখে চোখে রাখে, খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে দেয়, পরিষ্কার করে দেয়। মা নিজে কিছুই পারেন না, ছোট বাচ্চা মেয়ের মতো। বাইরে গেলে কে মাকে দেখবে, ছেলে এ জন্যে ঘরে বসেই কাজ করে। নিয়মিত আমার অনুজসম ডাক্তারটির কাছে নিয়ে আসে।

অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবার প্রচুর সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। একপর্যায়ে ওই মায়ের অবস্থা এমন অবস্থায় পৌঁছাল যে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। স্বাস্থ্যকর্মী সপ্তাহে সোমবার আর বৃহস্পতিবার দুই দিন এসে তাকে দেখে যান, সেই অনুযায়ী ডাক্তারকে রিপোর্ট করেন। কোনো এক সপ্তাহের বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যকর্মী তাকে এসে দেখে গেছেন। ছেলে কম্পিউটারে কাজ করছিল। হঠাৎ ছেলের বুকে ব্যথা, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ধারণা করা হয় হয়তো ছেলে বারেবারে মাকে ডেকেছে, ডাক্তার–অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বলেছে। হয়তো মা কানেই শোনেনি অথবা শুনেছেন, হয়তো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেছেন, ছেলের ডাকে হয়তো কাছ দিয়ে ঘুরেছেন ফিরেছেন, কিছুই করেননি, করতে পারেননি। এটাই ডিমেনশিয়ার ভয়াবহতা। যথারীতি সপ্তাহের সোমবার স্বাস্থ্যকর্মী এসেছেন, ছেলের মায়ের রুটিন চেকআপের জন্য। বেশ কয়েকবার কলিং বেল টিপেও ভেতর থেকে সারা না পেয়ে স্বাস্থ্যকর্মী পুলিশকে জানান। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকে দেখে ছেলে কম্পিউটার টেবিলে মাথা রেখেই মরে আছে। শরীর শক্ত হয়ে গেছে, হালকা গন্ধ বের হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মী আর পুলিশের লোকজনকে দেখে মায়ের প্রথম কথাই ছিল, ‘দেখতো তোমরা, পিটার শুধুই ঘুমাচ্ছে, আমাকে একেবারেই খেতে দিচ্ছে না। এতবার ডাকছি তারপরও আমাকে খাওয়াচ্ছে না, আমার খিদে লাগে না?’ মা কথা বলছেন, কিন্তু তার হাতে পিটারের সেই ছোটবেলার বিয়ার।

পিটার মারা যাওয়ার পর স্বাস্থ্যকর্মীরা বিশাল সমস্যায় পড়লেন। পিটারের মা এখন কী করবে, কে দেখাশোনা করবে? তাকে ডিমেনশিয়ার পেশেন্টদের জন্য বিশেষ নার্সিং হোমে রাখতে হবে। সমস্যা হলো নার্সিং হোমে সিট পেতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে। স্বাস্থ্য কর্মীদের অনুরোধে এবং মানবিক কারণে আমার অনুজসম ডাক্তারটি দুইবেলা গিয়ে পিটারের মাকে দেখেছেন, খাইয়ে এসেছেন। এক সপ্তাহ পর পিটারের মাকে বিশেষ নার্সিং হোমে ট্রান্সফার করা হলো। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাসা থেকে পিটারের মায়ের জন্য অনেক কিছু নিলেন। আর পিটারের মা নিলেন ছেলের সেই ছোটবেলার বিয়ারটি। কেন হলো কেউ বলতে পারেন না। নার্সিংহোমে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর একদিন ভোরে নার্স এসে রুটিন চেকআপ করতে গিয়ে দেখেন পিটারের মা মারা গেছেন। যেন ঘুমিয়ে আছেন, শান্ত ভঙ্গিতে, শান্তশিষ্ট বাচ্চা মেয়ের মতো, তার কোলে তার ছেলে পিটারের সেই বিয়ারটি।

আমাদের মাও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কে জানে আমাদের সন্তান অন্তঃ প্রাণ মা হয়তো আমাদের আগেভাগে গিয়ে পরম করুণাময়ের কাছে ভার সন্তানদের ফরিয়াদ নিয়ে সেজদায় পড়ে আছেন। একালে যেমন মা আমাদেরকে আগলে রেখেছেন আমার বিশ্বাস ওই কালেও মা আমাদের তেমনি করে আগলে রাখবেন। তাই দয়াময়ের কাছে প্রার্থনা করি, ওই ক্ষমতাটুকু আমার মাকে দিয়ো। আর বলি, বারবার বলি, ‘পরম করুণাময় আমার বাবা-মাকে দয়া কর, অনুগ্রহ কর, যেভাবে তারা আমার শিশুকালে আমাকে আগলে রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে আমার অন্তরের আকুতি, মিনতি, প্রার্থনা-দয়াময়, আমাকে পৌঁছে দিয়ো মায়ের কাছে!’
...

সাদিকুল আওয়াল: মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]. au>