ক্যাঙারুর দেশে

লেখিকা। মরিসাট, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া
লেখিকা। মরিসাট, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া

অনেক দিন পর মনে হলো আজ এক পরমাত্মীয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম। এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে তারা আমাদের গাড়ির কাছে এসে নামিয়ে নিয়ে গেল, যেন মনে হচ্ছিল তারা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমাদের দেখা পেল। মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে তারা যেভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকল, তাতে মনে হলো তারা আমার সকাল–দুপুর–রাতের সকল খবর জানতে চায়। এই প্রিয় মুখগুলোর সাক্ষাৎ পেয়ে আজ নতুন করে পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল—সেই যে ভেড়ামারা, পোড়াদহ, খানখানাপুর থেকে আমরা অনেক দিন পরে যখন আমাদের বলরামপুরের বাড়িতে যেতাম, তখন ঠিক এভাবেই আমার বড় আম্মা, মেজ আম্মাসহ পাড়ার অন্য সবাই আমাদের ঘিরে ধরতেন সকল ভালো-মন্দ খবর জানার জন্য। এদের দেখে আজ একবারের জন্যও মনে হয়নি এরা মনুষ্য প্রজাতির বাইরে, এরা পশু প্রজাতি, এরা ক্যাঙারু। বিদায় নেওয়ার সময়ও ঠিক একইভাবে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। পরমাত্মীয় ছাড়া এমনটা কী কেউ করে নাকি তা আমার জানা নেই। অথচ কী আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে এই পরমাত্মীয়ের বাড়িতে আসতে আমাদের এতগুলো দিন লেগে গেল।

এতগুলো দিন বলছি এ জন্যই যে, দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল আমরা এসেছি এই ক্যাঙারুর দেশে। মনে হচ্ছে সেদিনের কথা, ঠিক রাত আটটা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছেছিলাম সিডনি বিমানবন্দরে। তাজরীর সে কী আনন্দ, তিন মাস পর বাবাকে কাছে পাওয়ার আনন্দ। প্লেন থেকে নামার সময় তো রীতিমতো আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাংকু মা, তুমি আমাকে বাবার কাছে নিয়ে এসেছ’। শিশুরা হয়তো এমনই, তাদের ভেতরের শূন্যতাগুলো তাদের প্রাপ্তির আনন্দে বোঝা যায়, তার আগে নয়।

যা হোক, ফারুক হোসেন তিন মাস বিশ দিন আগে এসে নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছিল সেটা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম তার গাড়ি চালানো দেখে। কারণ, ফারুক হোসেনের মতো নরমসরম ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ কীভাবে এত অল্প সময়ে খাঁড়া পাহাড় বেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সেটা দেখে আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। শুধু কী তাই, কখনো বা গাড়ি ১৮০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে আমাদের মা-মেয়েকে ঝাঁকিয়ে-বাঁকিয়ে এক করে দিয়েছিল। এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় বাসার সামনের পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার কথা মনে হলে। মনে হচ্ছিল আমাদের গাড়িটা যেন আকাশপানে ধাবমান। আমার আর আমার মেয়ের একযোগে সে কী চিৎকার।

হই হুল্লোড়ে মত্ত
হই হুল্লোড়ে মত্ত

শরৎ বাবু রবিঠাকুরের অনেক বইয়ে পড়েছি শারীরিক ক্লান্তি বা মানসিক অবসন্নতা দূর করতে বায়ু পরিবর্তনের জন্য পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা। আমি কেবল স্বপ্নই দেখেছি যাওয়ার, যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি কখনো। অথচ, সেদিন যখন স্বপ্নকে ছাপিয়ে সত্যি সত্যি চার বছরের জন্য পাহাড়ে এসে পড়েছিলাম, তখন পাহাড়ে ওঠার প্রথম ধাক্কায় আমার মনে হয়েছিল, বায়ু পরিবর্তন চুলোয় যাক, এর চেয়ে আমার ফজলুল হক হলের দীর্ঘ বারান্দার পায়চারি, জানালার গ্রিল ধরে ভরা পূর্ণিমার আলোয় নিজেকে আলোকিত করা, শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পানে কারণে অকারণে চেয়ে থাকা কিংবা সুফিয়া কামাল হলের মেয়েদের আসা যাওয়া দেখা বরং ভালো ছিল। দিন বদলেছে, এখন আর খাঁড়া, ঢালু, আঁকা-বাঁকা, উঁচু, নিচু, সরু রাস্তা কোনোটাতেই ভয় পাই না।

এবারে আসি আমাদের বাসস্থানের বর্ণনায়। এখানে আমাদের অবস্থান সেন্ট্রাল কোস্টের গজফোর্ডে। সিডনি থেকে দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। ড্রাইভ করে এলে ১ ঘণ্টা আর ট্রেনে চেপে আসলে এক ঘণ্টা ৩০ মিনিট। আর গজফোর্ডে আমাদের বাসাটা পাহাড়ের ঠিক উঁচু চূড়ায়। উঁচু চূড়ায় হলে কী হবে, চূড়াটাই আবার বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে সমতল এবং মেয়ের স্কুল ও হাসপাতাল বাসা থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। একমাত্র মেয়ের সুবিধার কথা চিন্তা করে ফারুক হোসেনের এমন জায়গায় বাসা নির্বাচন। মেয়ে অন্ত প্রাণ ফারুক হোসেনকে বাবা হিসেবে আদর্শ বাবা বললে কিছু ভুল বলা হবে না। বলছিলাম বাসা নির্বাচনের কথা, আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপ্রয়োজনীয় স্থান প্রায় বলতে গেলে আমার বাসার পাশেই, তা হলো ট্রেন স্টেশন। আমার বাসা থেকে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে নামার গড়ানেই স্টেশন, যেখানে বাসা থেকে স্টেশনে পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে পাঁচ মিনিট লাগলেও বিপরীতমুখী হয়ে বাসায় ফিরতে লাগে দশ মিনিট ও সেইসঙ্গে কিঞ্চিৎ ক্লান্তি তো আছেই।

বিদায় বেলায়
বিদায় বেলায়

অবশ্য ক্লান্তির চুল পরিমাণ অবশিষ্ট থাকে না যখন আমি আমার দুই কামরাবিশিষ্ট ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি। বাসার প্রসঙ্গ যখন এল তখন এ সম্পর্কিত দু-চার কথা বলতেই হয়। বাসাটা অনেক পুরোনো সেটা তার অবকাঠামো দেখলে বোঝা যায়। ইট বালুর দেয়াল সংবলিত, কাঠের পাটাতনওয়ালা মেঝে ও টিনের চাল দেওয়া দোতলা বাসার দোতলায় আমাদের বাস। অদ্ভুত আবহাওয়াবিশিষ্ট অস্ট্রেলিয়া যেহেতু বৃষ্টি বিলাসী দেশ তাই মাথার ওপর টিনের চাল হওয়ায় কারণে সময়ে-অসময়ে হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ আমাকে মাতাল করে দেয় ঠিক আমার ছোট বেলার মতো। তা ছাড়া, আমাদের বাসার পেছন–বারান্দায় দাঁড়ালেই একদিকে দেখা যায় রাস্তার পাশের ঘন জঙ্গল। আর অপর পাশে তাকালে চোখে পড়ে মেঘ আর পাহাড়ের মাখামাখি। যে কেউ দেখলে ভাববে এ যেন মেঘ পাহাড়ের দেশ। বিভূতি ভূষণের চাঁদের পাহাড় প্রথম যখন পড়েছিলাম তখন কতবার যে চোখ বন্ধ করে পাহাড়ে, আফ্রিকার জঙ্গলে হারিয়ে গেছি তার হিসাব নেই। যখন নিজেকে নিজে উদ্ধার করেছি দেখি মাঝখানে পেড়িয়ে গেছে অনেকটা সময়। এটাই হতো একমাত্র বই যেটা পড়তে আমার সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে। বইটি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজের অজান্তেই নিজেকে যখন-তখন পাহাড়ে, জঙ্গলে হারিয়ে ফেলেছি। আজ আমি সত্যি সত্যি পাহাড় আর জঙ্গলের অনেক কাছে। আজ আর স্বপ্নে নয় ইচ্ছে হলেই আমি হারিয়ে যেতে পারি কাছে পিঠের হরেক রকম জঙ্গলে। হয়তো একেই বলে নিয়তি। কবে কী মনে মনে বলেছি, তখন আল্লাহ সব কান পেতে শুনে নিয়েছে আর এখন একে একে আমাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে।
...

লাভলী ইয়াসমীন: সেন্ট্রাল কোস্ট, গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া