দুষ্টু ছেলের দল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমগাছের ডালে বসে কয়েকজন কিশোর সভা করছে। সবাই সাধারণত আমগাছের কাণ্ড বেয়ে ওপরে উঠে তারপর ডালে গিয়ে বসে। কিন্তু এই কিশোরেরা আমগাছের নুয়ে পড়া ডাল ধরে ঝুলে গাছে উঠেছে। তারপর সেখানে বসে পরিকল্পনা করে নিচ্ছে সেদিনের কর্মসূচি। সভায় মোট চারজন কিশোর উপস্থিত। তাদের সবারই বয়স আলাদা। সবচেয়ে বড় প্রবাল। সবাই তাকে ডাকে পোবো। এটা নিয়ে পোবোর মনে লুকানো ক্ষোভ থাকলেও সেটা সবার সামনে প্রকাশ করে না। বিদ্যুতের ভালো নাম অসীম। এ নাম ডাক নামের কাছে ফিকে হয়ে গেছে অনেক আগেই। আলী ওদের দলের নতুন সদস্য। পদ্মার নদী ভাঙনের পর ওরা এখানে এসে বাড়ি করেছে। তাই সবাই তাদের আড়ালে পাড়ু বলেও ডাকে। বাবা–মায়ের অনেক আদরের ছেলে সালাম। ওর কাকা বারবার নিষেধ করে দিয়েছে এই সব ফাজিল ছেলেদের সঙ্গে না মেশার জন্য, তবুও সে নিয়মিতই আসে। এই দলের কর্মকাণ্ড তাকে অনেক আনন্দ দেয়। তাই শত শাসন উপেক্ষা করেও সালাম আসতে পিছপা হয় না।

আমগাছের ডালকে ওপর নিচে দোল দিতে দিতে পোবো বলল, জানিস মনা পালের গাছের বাদাম পেকে গেছে। জাম্বুরাকে কুষ্টিয়ার স্থানীয় ভাষায় বাদাম বলে। যদিও নির্দিষ্ট কারও উদ্দেশ্য করেই এই কথা বলা হয়নি তবুও পাড়ু বলল, হ্যাঁ আমিও দেখেছি। কাল যখন গরুর জন্য লতাপাতা কাটতে গেছিলাম তখন। বিদ্যুৎ বলল, অসীমাদের গাছের বাদামও পেকে গেছে। সালাম বলল, বাগাড়ির গাছের আতাফলও দেখলাম হলুদ হয়ে গেছে। বাগাড়ি একটা বংশের নাম। তারা এককালে অনেক বড় বাগাড় (বাঘা আইর) মাছ দিয়ে একবার খানা দিয়েছিল। এরপর থেকে নাকি তাদের নামের সঙ্গে বাগাড় যুক্ত হয়ে গেছে। সবার কথা শেষ হওয়ার পর পোবো আবার বলল, মনা পাল দেখতে পারলেই জগতি হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবে। অসীমাদের গাছের বাদাম কেউ পাড়তে পারবে না, তাই সেগুলো পরেও চুরি করা যাবে।

বাড়াদি আর জগতি গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে গড়াই নদী। আসলে নদী না বলে খাল বলায় শ্রেয়। তবে এটা কৃত্রিম খাল। জগতির কুষ্টিয়া সুগার মিলের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য গড়াই নদী পর্যন্ত এই খাল খনন করা হয়েছিল। তার মধ্যে দিয়ে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় যখন সুগার মিলের বর্জ্য প্রবাহিত হয়, তখন তার আশপাশে ঘেঁষা দায় হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে গড়াই নদীর পানি বেড়ে গেলে সেই পানি যখন খালে ঢুকে পড়ে তখন গ্রামের সবাই দল বেঁধে সেখানে গোসল করতে নামে। এই গড়ই খালের এপারে বাড়াদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেখানে এই কিশোরেরা বিভিন্ন ক্লাসে পড়ে। পোবো আর পাড়ু পড়ে ক্লাস ফাইভে। বিদ্যুৎ আর সালাম পড়ে ক্লাস ফোরে। স্কুলের সামনের হাঁটাপথে এগোলেই খালের ওপর বাঁশের সাঁকো। যেটা বেশির ভাগ সময়ই কোনো না কোনোভাবে ভাঙা থাকে। তবুও সবাই জগতি যাওয়ার জন্য এটাকেই ব্যবহার করে তাতে অনেকখানি রাস্তা কমে যায়। তা ছাড়া, সাঁকো পার হলেই জগতি হাট। সপ্তাহের দুই দিন হাট বসে—রোববার আর বুধবার। আশপাশের গ্রামের লোকজন তাদের প্রাত্যহিক কেনাকাটার জন্য এখানেই আসে। পোবো এই হাটের কথাই বলছে।

বিদ্যুৎ বলল তাহলে আজই আমরা মনা পালের গাছের বাদাম পারব। পাড়ু বলল, সে না হয় বুঝলাম, গাছে উঠবে কে? সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বলল, কেন তুই। তুই আমাদের সবার মধ্যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি গাছে উঠতে পারিস। আর ধরা পড়তে গেলে তুই যেকোনো দিক দিয়ে নেমেও আসতে পারিস। সালাম বলল, সবই বুঝলাম কিন্তু আমি যাব না। তখন পাড়ু বলল, যাবি না মানে। আমি গাছে উঠে কি ভ্যারেন্ডা ভাজব। তখন পোবো বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। পাড়ু থাকবে গাছে। ও বাদাম পেড়ে আমাকে ক্যাচ দেবে। আমি থাকব গাছের তলায়। আর বিদ্যুৎ থাকবে মনা পালের ঘেড়ার কাছে। আমি পাড়ুর কাছ থেকে নিয়েই আমি ওকে ক্যাচ দেব। আর সালাম থাকবে রাস্তায়। বিদ্যুৎ সালামকে ক্যাচ দেবে। যদি কোনো কারণে আমি আর পাড়ু ধরা পড়েও যাই তাহলে বিদ্যুৎ আর সালাম নিরাপদে পালিয়ে যাবে। আমি আর পাড়ু পরে এসে যোগ দেব। আর আমাদের দুজনেরই যেহেতু মাইরের ভয় নাই, তাই আমরাই থাকব ঘেড়ার ভেতরে। ঘেড়া হলো বিভিন্ন লতাপাতার তৈরি বেড়া যাতে করে ভেতরে গরু ছাগল ঢুকতে না পারে।

পরিকল্পনা ঠিক করে কিশোরের দল আম গাছের ডাল বেয়ে আবার নেমে পড়ল। ওই আম গাছটা গিয়াস দাদুদের। এই গাছ থেকে সামান্য এগোলেই তেমাথা। সেখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে মনা পালের বাড়ির দিকে আর অন্যটা চলে গেছে শহরের দিকে। কিশোরের দল শহরের দিকে যাওয়ার রাস্তায় কিছু দূর এগিয়ে ডানপাশের বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে নেমে পড়ল। এই চোরাই পথে মুনা পালের বাড়ির পেছনে যাওয়া যাবে। যেখানে সেই কাঙ্ক্ষিত বাদাম গাছ রয়েছে। সালাম বাঁশঝাড়ের মধ্যেই রয়ে গেল। তার দায়িত্ব গাছ থেকে পাড়া বাদাম এক জায়গায় করে রাখা। কিছু দূর যাওয়ার পর ঘেড়া, বিদ্যুৎ সেখানে রয়ে গেল। তারপর পোবো আর পাড়ু এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট গাছের দিকে। সব দেখেশুনে তারা এগোতে থাকল। চারদিক ভালো করে দেখে নিয়ে পোবো বলল পাড়ু উঠে পড়। পাড়ু সন্তর্পণে গাছে উঠে পড়ল। কিন্তু বাদাম আর সহজে পাড়া যাচ্ছে না। কারণ প্রত্যেকটা বাদাম একেবারে ডালের মাথায় ধরেছে। বাদাম গাছের ডাল এমনিতেই বেশ ভঙ্গুর। তাই ডালের শেষপ্রান্তে গিয়ে বাদাম পাড়তে গেলে ডাল ভেঙে নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

তবুও পাড়ু চেষ্টা করে যাচ্ছে বাদাম পাড়ার। ইতিমধ্যে একটা পেড়ে সেটা গাছের তলায় দাঁড়ানো পোবোকে দিয়েছে। পোবো সেটা নিয়ে পাচার করে দিয়েছে। এ সময় হঠাৎ পাশেই শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ ভেসে এল। পোবো শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে মনা পাল আসছেন। তার বাঁ হাতে লুঙ্গির গিট্টু মুঠি করে ধরা আর ডান হাতে কাঁসার বদনা ধরা। দেখেই পোবো বুঝে গেল মনা পাল প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আসছেন। চাপ মনে হয় বেশিই। তাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছেন বাদাম গাছের তলায় কলাপাতা দিয়ে ঘেরা পায়খানাটার দিকে। পায়খানার ওপরটা খোলা। যদিও তার বাড়িতে পাকা পায়খানা আছে তবুও তিনি এখানেই কর্মটি সারেন। কারণ পাকা পায়খানাতে তার দমবন্ধ লাগে।

মনা পালকে দেখে পোবো কোনো প্রকার শব্দ না করে সেখান থেকে দ্রুত সটকে পড়ল। এদিকে দ্বিতীয় বাদামটা পেড়ে পাড়ু নিচে তাকিয়ে দেখে গাছের তলায় পোবোর নিশানা নেই। তখন সে নিজেও খেয়াল করে দেখে দ্রুত পায়ে মনা পাল এগিয়ে আসছেন। মনা পালকে আসতে দেখে পাড়ু গাছের ওপর সেখানেই জমে গেল। আর মনে মনে পোবোর গুষ্টি উদ্ধার করে মনে যত গালি আসে একে একে দিতে লাগল। মনা পাল এসে কলাপাতা ঘেরা পায়খানাতে ঢুকে তার কর্মটি শুরু করে দিলেন। পাড়ু লজ্জায় আর সেদিকে তাকাল না। চোখ বন্ধ করে গাছের ডাল ধরে মটকা মেরে বসে রইল।

চোখ বন্ধ করার কারণ মনা পাল যেন তাকে দেখতে না পান। পাড়ু মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা শুরু করে দিল আর তওবা করতে থাকল এবার যদি ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে আর কখনো সে চুরি করতে আসবে না। আর মনে মনে পোবো, বিদ্যুৎ সালামকে অভিসম্পাত দিল। একেকটি মুহূর্ত ইয়াকুবের কাছে একেকটি বছর মনে হতে থাকে। এভাবে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল তার ইয়ত্তা নেই। হঠাৎ নিচে শব্দে বুঝতে পারল মনা পালের প্রাকৃতিক ক্রিয়া শেষের দিকে। একটু পরে আবারও শুকনো পাতা মাড়িয়ে মনা পালের ফিরে যাওয়ার আওয়াজে পাড়ু নিশ্চিত হলো মনা পাল চলে গেছেন। চোখ খুলে নিচে তাকিয়ে দেখে আসলেই মনা পাল চলে গেছেন। পাড়ু মুহূর্তের মধ্যে গাছ থেকে নেমে এসে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে রাস্তার দিকে দিল এক ভোঁ দৌড়। একেবারে মূল রাস্তায় ওঠার আগ পর্যন্ত আর থামল না। সেখানে গিয়ে দেখে আগে থেকেই ওরা তিনজন ওর জন্য অপেক্ষা করছে। পাড়ু পোবোকে আচ্ছামতো বকে জিজ্ঞেস করল, তুই যখন পালালি তখন আওয়াজ দিলি না কেন?

পোবো বলল, শোন হঠাৎ দেখি মনা পাল আসছে এবং আমার খুবই কাছে। আমি কোনো প্রকার শব্দ করলে আমরা দুজনই ধরা খেয়ে যেতাম। তাই আমি আস্তে করে সটকে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুইতো তাকে দেখতেই পাবি, তখন হয়তো সাবধান হয়ে যাবি। যা হোক, তুই ভালোই ভালোই ফিরে এসেছিস এটাই অনেক। চল এখন বাদাম দুটো মাখিয়ে খেয়ে ফেলি। তারপর তারা চারজন রাস্তার উল্টোদিকে নেমে পড়ল যেদিকে সালামদের বাঁশঝাড় আছে। সালামদের বাঁশঝাড়ের মধ্যে গিয়ে পাশাপাশি চারটা বাঁশ খুঁজে নিয়ে সেগুলোতে চড়ে বসল ওরা চারজন। তারপর পোবো তার হাতের জাদুতে বাদামগুলো চিড়ে ফেলল। তারপর সবাইকে সমান করে ভাগ করে দিল।

মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>