মেঘে মেঘে রংধনু-আট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মাউন্ট পিরংগিয়ায় ওঠার পথটা বেশ উঁচুনিচু ও ঢেউখেলানো। পথটা ক্রমাগত ওপর থেকে ওপরে উঠে গেছে। পথের এক পাশে সরু ঢাল। পাহাড়ের পাদদেশের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ওয়াইপা নদী। পাহাড়ের চারপাশে বৃত্ত করে রয়েছে সীমাহীন সমতল ভূমি। সেই সমতল ভূমিগুলোতে সবুজের পর সবুজ যেন বিছিয়ে রয়েছে। যেন সবুজের কোনো শেষ নেই।

রাকিব ও নদী প্রায় গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তারা দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি অনেকগুলো সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠে যাওয়া ভিউ পয়েন্টের রেলিং ঘেঁষে। রেলিংটাও কাঠের তৈরি।

নদী দিগন্ত বিস্তৃত সমতল সবুজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, রাকিব ভাই, এই সবুজের শেষ কোথায়?

রাকিব হাসল। বলল, বেশ বলেছ। কাব্যিক প্রশ্ন। এই সবুজের শেষ নেই।

: শেষ তো কোথাও আছে। এই পৃথিবীতে সীমানাহীন বলে কিছু নেই। অবিনশ্বর বলেও কিছু নেই।

: তুমি মাঝেমধ্যে এমন কাব্যিক কথা বল যে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। ভাবি, আমি কবিতা লিখি না তুমি লেখ!

নদী হো হো করে হেসে ফেলল। বলল, কাঠ খড়ি আর যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে করতে মাঝেমধ্যে যে কবিতার ভাব আসে না, তা নয়। আফটার অল আমার মা একজন কবি। সারা জীবন একটা কাব্যিক পরিবেশে বড় হয়েছি। এই নিউজিল্যান্ডে এসেও তা থেকে নিস্তার পাইনি। এখানেও এক কবির পাল্লায় পড়েছি।

রাকিব নিঃশব্দে হলেও একটা দিঘল বিস্তৃত হাসি দিল। বলল, তোমাকে কে বলেছে নিউজিল্যান্ডে এসে এই কবির পাল্লা পড়তে?

: কেউ বলে দেয়নি। নিয়তি বলে দিয়েছে। কতক্ষণ আগে টেম্পল ভিউতে বলেছিলেন না, নিয়তি নিয়ন্তা? আমি সেই নিয়তি নিয়ন্তার জালে পড়েছি।

: ভালোই। বেশ ভালো। তুমি তোমার নিয়তি নিয়ন্তার জালে আটকে পড়ে থাক।

: আচ্ছা, না হয় পড়ে থাকব। আহা, বলেন না, এই সবুজের শেষ কোথায়?

: আক্ষরিক অর্থে বললে, আমি জানি না। ভৌগোলিক অর্থে বললে, এই সবুজের শেষ কাফিয়া হারবারে গিয়ে। যেখানে তাসমান সমুদ্র।

: তাসমান সমুদ্র? আমি তো জানতাম নিউজিল্যান্ডের সমস্তটা প্রশান্ত মহাসাগরের জল ঘিরে রয়েছে।

: না, একাংশে তাসমান সমুদ্র। কাফিয়া, র‍্যাগলেন থেকে নর্থ আইল্যান্ডের একেবারে নর্থের অর্ধেকটা পর্যন্ত। একটা মজার ব্যাপার কী, তুমি যদি এই নর্থ আইল্যান্ডের একেবারে নর্থের যাও, তাহলে তুমি স্পষ্ট দেখবে, প্রশান্ত মহাসাগরের সবুজ জল আর তাসমান সমুদ্রের নীল জল যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে জলের একটা স্পষ্ট রেখা। নীল জল ও সবুজ জলকে পুরোপুরি আলাদা করা যায়।

: আপনি ওখানে গিয়েছেন?

: হ্যাঁ, গিয়েছে। অকল্যান্ড থেকে প্রায় তিন শ কিলোমিটার দূরে। স্থানগুলোকে বলে, আপ নর্থের ফাঙ্গারাই, পাহিয়া ও কিরিকিরি।

: আমাকে ওখানে নিয়ে যাবেন?

রাকিব এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, তুমি যাবে ওখানে? অনেক দূরের পথ কিন্তু। তিন-চার দিন থাকতে হয়।

নদী নির্দ্বিধায় বলল, থাকতে হলে থাকব। আমাকে নেবেন তো ওখানে?

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে স্মিত হেসে বলল, আচ্ছা।

এ সময় দুজনই কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল।

রাকিব বরাবরই দেখেছে, এখানে প্রায় প্রত্যেকটা পর্বতের মাথা অনেকটা অংশ নিয়েই সমতল। মাউন্ট ইডেন, মাউন্ট মাঙ্গানুই, মাউন্ট তারানাকি, মাউন্ট রোয়াপিহো, এমন কী মাউন্ট পিরংগিয়াও। এটা যে ভ্রমণের জন্য মানুষ সমতল বানিয়েছে, তা নয়। প্রাকৃতিকভাবেই সমতল। হয়তো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পর্বতগুলো সৃষ্টি হয়েছে বলে এমনটা হয়েছে। মাউন্ট পিরংগিয়ার উপরিভাগও অনেকটা অংশ নিয়ে প্রায় সমতল। অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়া যায়। পর্বতের মাথায় দিঘল বন। এ ছাড়া ঢাল বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে গেছে সবুজ ঘাসের লন।

মাউন্ট পিরংগিয়ায় গাড়ি নিয়ে একেবারে চূড়ায় উঠে আসা যায়। চূড়ার একপাশে কার পার্ক ও পর্যটকদের জন্য একটা মোটেল বানানো হয়েছে।

মাউন্ট পিরংগিয়ায় আজ বেশ লোকজন এসেছে। ভিউ পয়েন্টের যে পাশটায় রাকিব ও নদী দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে লোকজন না থাকলেও কার পার্কের উল্টো পার্শ্বে ঘাসের লনে বেশ কিছু মানুষের জটলা। ওরা যে পিকনিক করতে এসেছে, বোঝা যায়। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ওরা ভারতীয়। তবে বাংলাদেশেরও হতে পারে। আবার শ্রীলঙ্কারও হতে পারে।

নদী ওদের দিকে তাকাল। বেশ দূরে বলে ওদেরকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। রাকিবও নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে একবার-দুবার তাকাল।

নদী জিজ্ঞেস করল, রাকিব ভাই, ওদিকে হাঁটতে যাবেন? দেখে আসি, ওরা কারা? আমার কাছে মনে হচ্ছে বাঙালি।

রাকিব বলল, তুমি গেলে যেতে পার। আমার ইচ্ছে করছে না।

নদী বলল, থাক, আমিও যাব না।

রাকিব কিছু বলল না।

নদী বলল, এত সুন্দর জায়গায় আমি আগে কখনো আসিনি। এত উঁচুতে উঠলে মন কেমন বড় হয়ে যায়।

রাকিব বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।

নদী পুবদিকে তাকিয়ে হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বলল, দেখেন, দেখেন, কী সুন্দর রংধনু উঠেছে! মনে হচ্ছে, মেঘে মেঘে রংধনু!

রাকিবও সেদিক তাকাল। হেসে বলল, তোমার কাব্যিক কথা শুনে আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিই। হা হা হা!

নদী নাক ফুলিয়ে বলল, দেখেন, ঠাট্টা করবেন না।

রাকিব হাসি থামিয়ে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে।

নদী জিজ্ঞেস করল, রংধনুটা সুন্দর না?

: হ্যাঁ, অনেক সুন্দর।

: মনে হচ্ছে, ধরা যাবে। একবার কী হয়েছিল জানেন? একবার নয় কয়েকবারই। আমার মনে হচ্ছিল, রংধনুটা যেন কাছেই। আমি রংধনু ধরার জন্য হাঁটতে শুরু করলাম। আমি হাঁটছি, রংধনু পেছাচ্ছে। আমি আরও হাঁটছি, রংধনু আরও পেছাচ্ছে। একসময় আমি হাল ছেড়ে দিই। হি হি হি!

আজকাল রাকিব নদীকে যতই দেখছে, ততই মুগ্ধ হচ্ছে। সে যতই নদীর কথা শুনছে, ততই মনে মনে আপ্লুত হচ্ছে। কিন্তু সে মুখে প্রকাশ করছে না। যদি বেশি কিছু বলা হয়ে যায়? যদি বেশি কিছু করা হয়ে যায়?

ওরা দুজন বেশ কিছুক্ষণ রংধনুর দিকে তাকিয়ে রইল।

নদী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, রাকিব ভাই, আজ তো এখানে বৃষ্টি হয়নি। রংধনু উঠল যে?

রাকিব বলল, এখানে বৃষ্টি হয়নি ঠিকই, হয়তো কাছে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। এ জন্যই রংধনু উঠেছে।

নদী সায় দিয়ে বলল, হুম।

রাকিব বলল, একদিন আমি আমার বাসার ব্যালকনিতে বসে আছে। দেখলাম কী, বৃষ্টি এসে আমার বাসার ব্যালকনির ও বাসার সামনের লনের অর্ধেকটা ভিজিয়ে দিয়ে গেল। বাকি অর্ধেকটা পুরোপুরি শুকনা।

: আমিও ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির সামনে এমনটা দেখেছি।

: এ হলো নিউজিল্যান্ডের মেঘবৃষ্টির খেলা।

: এখানে খুব বেশি খ্যাঁক শেয়ালের বিয়ে হয় যে!

রাকিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে এ কথা কে বলেছে?

নদী হেসে বলল, আমি নিজ থেকেই বলেছি।

: আমরা ছোট সময় এ নিয়ে ছড়া কাটতাম।

: ওই ছড়াটা? রোদ হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে। খ্যাঁক শেয়ালের বিয়ে হচ্ছে!

: হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি এই ছড়া জানলে কীভাবে? তুমি তো বাংলাদেশে গ্রামে থাকোনি?

: আহা, আপনি বারবার ভুলে যান কেন, আমাদের বাসায় আমার মা ছিলেন কবি...!

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হুম। বেশ, তাই তো। কিন্তু ম্যাডাম, নিউজিল্যান্ডে কোনো খ্যাঁক শেয়াল নেই। আদতে নিউজিল্যান্ডে কোনো হিংস্র প্রাণীই নেই। তুমি খ্যাঁক শেয়ালের সঙ্গে কীভাবে বিয়ে দেবে?

নদী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ওই তো, মনে মনে দিলেই হলো।

রাকিব স্মিত হেসে রংধনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ভালো। বেশ ভালো। তুমি মনে মনে খ্যাঁক শেয়ালের বিয়ে দাও। বলেই সে রংধনু থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার দিঘল বিস্তৃত সমতল ভূমির দিকে তাকাল। সেদিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কী ভেবে বলল, নদী, এই মাউন্ট পিরংগিয়া নিয়ে কিন্তু দারুণ একটা প্রেমের গল্প আছে।

নদী আগ্রহ নিয়ে বলল, প্রেমের গল্প? বলেন তো।

রাকিব বলল, এই মাউন্ট পিরংগিয়ার পুরো নামটা হলো, পিরংগয়া-ও-টি-আরু-আরু-ও-কাহু।

: ওরে বাপরে, এত দেখি কঠিন নাম। এত কঠিন নাম মনে রাখেন কীভাবে?

: মনে রাখতে হয়। এর অর্থটা জানবে তো। এর অর্থ হলো, কাহুর চলার একটি সুগন্ধ পথ।

নদী বলল, বেশ তো!

রাকিব বলল, হ্যাঁ। অবশ্য মাউন্ট পিরংগিয়ার ওপর দিয়ে চলার পথটা এত সুগন্ধযুক্ত হওয়ার পেছনে একটা মাউরি মিথ আছে।

: মাউন্ট পিরংগিয়ার এই চলার পথটা কী সুগন্ধযুক্ত?

: তাহলে আর কী বলছি?

: কিন্তু আমি তো কোনো সুগন্ধ পাচ্ছি না।

: সন্ধ্যার পরে পাবে।

: সন্ধ্যার পরে কেন?

: কারণ সন্ধ্যার পরে এখানে ভূত নেমে আসে।

নদী আঁতকে উঠে বলল, বলেন কী?

রাকিব জিজ্ঞেস করল, তুমি ঢাকার মেয়ে। তুমি ভূতে ভয় পাও?

: আমি ভূতে প্রচণ্ড ভয় পাই।

: তাহলে তো এই গল্প বলা যাবে না। আর সন্ধ্যার পরও থাকা যাবে না।

: জি জি, আমরা সন্ধ্যার আগেই এখান থেকে নেমে যাব।

: আচ্ছা, তা না হয় গেলাম। কিন্তু মাউন্ট পিরংগিয়ায় ভূত নামার গল্পটা তো শুনবে?

: আচ্ছা। তবে বেশি ভয়ের হলে বলার প্রয়োজন নেই।

: ভয়ের না। ভূতের গল্প হলেও প্রেমের গল্প। তুমি না শুনতে চাইলে অসুবিধা নেই। আমরা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি।

: না না, প্রেমের গল্প ভূতের হলেও প্রেমেরই। আর আপনি আমার পাশে আছেন না? ভয়ের হলেও কীসের ভয়?

রাকিব মৃদু হেসে বলল, গল্পটা মোটেও ভয়ের নয়।

নদী বলল, তাহলে বলুন।

রাকিব বলল, আচ্ছা, শোনো। সন্ধ্যার পরক্ষণ এই মাউন্ট পিরংগিয়ার ওপর ভূত নেমে আসে। ভূতটা অদ্ভুত এক সুগন্ধ বিলায়। কখনো কখনো রাত বাড়তেই সেই ভূত সূক্ষ্ম করুণ সুরে বাঁশি বাজায়।

: ওমা, এ তো সত্যি কী ভয়ের কথা!

: আহা, গল্পটা শুনবে তো আগে।

: জি জি, বলুন।

: এটা ভয়ের কথা নয়। এই ভূতটাকে আদিবাসী মাউরিরা প্রেমের দেবতা হিসেবে জানে। এই প্রেমের দেবতার নাম ফানা ফানা। সন্ধ্যার পর সত্যি এই পর্বত এবং পর্বতের চারপাশ সুগন্ধে ভরে যায়। অনেকে দাবি করে, ওরা মধ্যরাতে এখানে করুণ বাঁশির সুর শুনেছে। কেউ কেউ আবার মিষ্টি গানের সুরও শুনেছে। অনেকে দাবি করে, ওরা দূর থেকে ফানা ফানা ও টাফিয়াটুকে এক সঙ্গে দেখেছে।

: এই টাফিয়াটু কে?

: প্রেমের দেবতা ফানা ফানার প্রেমিকা। তবে এই টাফিয়াটু অন্যের স্ত্রী ছিল। টাফিয়াটুর স্বামীর নাম ছিল রোয়ারাঙ্গি।

: এ তো দেখছি রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মতো। রাধার স্বামী ছিল, অথচ রাধা ভালোবাসত কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ বাঁশি বাজাত। এদিকে ফানা ফানাও বাঁশি বাজাত।

: হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। সুন্দর তো, তুমি যে মিলটা বের করলে, ওটা তো আমার মাথায় আসেনি।

নদী হাসল। একটু ভাব নিয়ে বলল, আজকাল অনেক কিছুই আমার মাথায় আসে।

রাকিব বলল, হয়েছে। আর ভাব নিতে হবে না। আমি গল্পটা বলি। ফানা ফানা-টাফিয়ারটু ও রাধাকৃষ্ণের প্রেম একই রকম। তবে ফানা ফানা ও টাফিয়াটুর প্রেমের কাহিনি আরও চমকপ্রদ। ফানা ফানা প্রেমের দেবতা হলেও সে ছিল ভূত সম্প্রদায়ের। সে পাটুপাইয়ারিহির যুবক সর্দার ছিল।

: ফানা ফানা তাহলে আগে থেকেই ভূত ছিল?

: হ্যাঁ। আচ্ছা তোমাকে কাহিনিটা খুলেই বলি। আদিবাসী মাউরিদের ধর্মীয় মতে পাটুপাইয়ারিহি বা ভূত সম্প্রদায়ের অনেকগুলো বসতির মধ্যে একটা বসতি ছিল মাউন্ট পিরংগিয়ার ওপর। ওরা মাউন্ট পিরংগিয়া ও পিরংগিয়া বনে ঘর বানিয়ে দলবলে বসবাস করত। ওদের সর্দার ছিল যুবক বয়সী। সেই যুবক আর কেউ নয়, ফানা ফানা। ওদিকে নারওয়াহিয়ার কাছে হাকুরিমাতা রেঞ্জে বসবাস করত রোয়ারাঙ্গির গোত্র। মানুষ সম্প্রদায়। তা বহু বছর আগের কথা। রোয়ারাঙ্গি গোত্রের সর্দারের নামও ছিল রোয়ারাঙ্গি। রোয়ারাঙ্গি সর্দারের স্ত্রীর নাম ছিল টাফিয়াটু। এই টাফিয়াটু ছিল অসম্ভব সুন্দরী। সে ফুল ভালোবাসত। নদীর জল ভালোবাসত। যে নদীর গান গাইত। ফুলের গান গাইত। এক বসন্তের বিকেলে টাফিয়াটু একা হাকুরিমাতা রেঞ্জে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর ফুলের গান গাচ্ছিল। এমন সময় সেখানে ঘুরতে গিয়ে আড়াল থেকে প্রেমের দেবতা ফানা ফানা টাফিয়াটুকে দেখে ফেলে। টাফিয়াটুকে দেখেই ফানা ফানা প্রেমে পড়ে যায়।

নদী জিজ্ঞেস করল, প্রথম দেখায়ই প্রেম?

রাকিব বলল, হ্যাঁ।

নদী বলল, আহা, মানুষের জীবনে যদি প্রথম দেখায়ই প্রেম হতো?

রাকিব বলল, মানুষের জীবনেও ঘটে। এমন অজস্র প্রমাণ আছে। আচ্ছা, ওসব কথায় পরে যাচ্ছে, আগে গল্পটা বলি। ফানা ফানা প্রেমের দেবতা বলে, সে প্রেমের আবেশ সৃষ্টি করতে পারত। প্রেমের সম্মোহনে সম্মোহিত করে তুলতে পারত। টাফিয়াটুকে দেখে ফানা ফানা তাই করে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে সম্মোহিত টাফিয়াটুকে পাঁজাকোলা করে ফানা ফানা তাদের বসতি এই মাউন্ট পিরংগিয়াতে নিয়ে আসে। প্রেমের সম্মোহনে ও অপূর্ব এক মায়ার বাঁশি বাজিয়ে সারা রাত টাফিয়াটুকে ফানা ফানা বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু ভোর হতেই ফানা ফানা টাফিয়াটুকে হাকুরিমাতা রেঞ্জে রেখে আসে। এভাবে বেশ কিছুদিন চলে যায়। এদিকে হাকুরিমাতা রেঞ্জের সর্দার রোয়ারাঙ্গি কিছুদিনের মধ্যেই তার স্ত্রীর এই কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হয়। কিন্তু তার কিছুই করার থাকে না। রোয়ারাঙ্গি এত শক্তি বা সাহস ছিল না যে ভূতের সর্দার ফানা ফানার সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে জয়লাভ করবে। ওদিকে ফানা ফানা যেমন প্রেমিক দেবতা ছিল, তেমনি ছিল অসম্ভব শক্তিশালী ছিল। তার ওপর ফানা ফানা ছিল ভূত সম্প্রদায়ের।

একদিন রোয়ারাঙ্গি তার ট্রাইবের প্রধান গণক ও বুদ্ধিদাতার কাছে যায়। সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় বসে। প্রধান গণক গণনা করে, চাঁদ-সূর্য দেখে রোয়ারাঙ্গিকে উপদেশ দেয়, সে যদি হাঙরের তেল, হাঙরের রক্ত তার সমস্ত বাড়ির চারপাশে মেখে রাখতে পারে ও টাফিয়াটুর শরীরে মেখে দেয়, তাহলে প্রথম ধাপে ফানা ফানার একটা বাধার সৃষ্টি হবে। আর সন্ধ্যার পরক্ষণ চুলায় হাঙরের মাংস রান্না করার গন্ধ ঘরের আশপাশে ছড়িয়ে দিতে পারে, তাহলে ফানা ফানা তার ঘরের কাছে আসতে পারবে না। তার স্ত্রী টাফিয়াটুকেও ফানা ফানা আর স্পর্শ করতে পারবে না।

প্রধান গণকের পরামর্শ অনুযায়ী রোয়ারাঙ্গি এক বিকেলে কাফিয়া থেকে বেশ কয়েকটা হাঙর ধরে এনে হাঙরের তেল ও রক্ত তার বাড়ির আশপাশে ছিটিয়ে দেয়। তার ঘরের প্রতিটা দেয়ালে মেখে দেয়। তার স্ত্রী টাফিয়াটুর সমস্ত শরীরেও হাঙরের তেল ও রক্ত মেখে দেয়। সন্ধ্যার পরক্ষণে সেই হাঙরের মাংস চুলায় রান্না করতে বসে।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও সন্ধ্যার পর ফানা ফানা টাফিয়াটুকে নিতে মাউন্ট পিরংগিয়া থেকে হাকুরিমাতা রেঞ্জে আসে। আসার আগে যথারীতি সে তার ঘরে এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে আসে। কিন্তু হাকুরিমাতা এসে ফানা ফানা দেখে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। হাঙরের রক্ত সে পছন্দ করে না। কিন্তু সেটাই টাফিয়াটুর বাসস্থানের চারপাশে মেখে রাখা হয়েছে। হাঙরের তেল তার কাছে অসহ্যকর পদার্থ। ওটাও ঘরের দেয়ালে মেখে রাখা রয়েছে। আর তার প্রেমিকা টাফিয়াটুকে তো চেনাই যায় না। টাফিয়াটুর সমস্ত শরীরে হাঙরের রক্ত ও তেল মেখে রাখা। ওদিকে ঘরের ভেতর থেকে আসছে বুঁদ বুঁদ করে হাঙরের মাংস রান্নার গন্ধ আসছে।

ফানা ফানা সারা রাত একটা গাছের ওপর সেই রাতে টাফিয়াটুর বিরহে বসে থাকে। হাঙরের রক্ত, হাঙরের তেল ও হাঙরের মাংস রান্নার গন্ধে কিছুতেই সে টাফিয়াটুর ঘরের কাছে ভিড়তে পারে না। ওদিকে টাফিয়াটুর ভেতরেও এক করুণ আর্তনাদ। সে তার স্বামীর আদেশ অমান্য করতে পারছে না। আবার ফানা ফানার কাছেও যেতে পারছে না।

এভাবে রোয়ারাঙ্গি বেশ অনেক দিন বাড়ির আশপাশে এই ব্যবস্থা করে রাখে। প্রতিদিন সে তার লোকজন নিয়ে কাফিয়া হারবার থেকে হাঙর ধরে এনে বাড়ির আশপাশে রক্ত ছিটায়। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে হাঙরের রক্ত ও তেল মেখে রাখে। তার স্ত্রী টাফিয়াটুর সমস্ত শরীরের হাঙরের তেল ও রক্ত মেখে দেয়। ঘরের চুলায় হাঙরের মাংস রান্না করে।

ওদিকে ফানা ফানা প্রতিরাতে এসে টাফিয়াটুর কাছে ভিড়তে পারে না। প্রতিরাতেই সে কোনো না কোনো গাছের ওপর প্রতীক্ষায় বসে থাকে। টাফিয়াটুর বিরহে তার বাঁশি বাজানো বন্ধ হয়ে যায়। তার মিহি সুরে প্রেমের গান গাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

এক সন্ধ্যায় ফানা ফানা আর হাকুরিমাতা রেঞ্জে আসা বন্ধ করে দেয়। প্রেমিকা টাফিয়াটুর শোকে ও কষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে সেই সন্ধ্যায় বাতাসে বিলীন হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর টাফিয়াটু সেই খবর পেয়ে নিজ থেকেই মাউন্ট পিরংগিয়াতে ছুটে আসে। পরে আর কোনো দিন সে হাকুরিমাতায় তার স্বামীর গৃহে ফিরে যায়নি। একদিন মাউন্ট পিরংগিয়াতেই টাফিয়াটু মারা যায়।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এ হলো প্রেমের দেবতা ফানা ফানা ও প্রেমিকা টাফিয়াটুর প্রেমের গল্প।

নদী জিজ্ঞেস করল, তারপর?

রাকিব বলল, তারপর আর কী? এখনো সন্ধ্যার পর এই মাউন্ট পিরংগিয়ার ওপর ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যার পর সেই মোহিত করা সুগন্ধটা এখনো আসে। কখনো কখনো কেউ এই মাউন্ট পিরংগিয়ার ওপর থেকে মিহি সুরে সুমধুর বাঁশির সুর শোনে। কেউ কেউ মধ্যরাতে চমৎকার গলার গান শুনেছে বলে দাবি করে।

নদী আস্তে করে বলল, এটা তো ঠিক রূপকথার মতো।

রাকিব বলল, হ্যাঁ, মাউরি মিথগুলো রূপকথার মতোই। তবে এই রূপকথাগুলোই মাউরি আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন