মেঘে মেঘে রংধনু-নয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেলের মধ্যভাগ। ডে-লাইট সেভিংস শেষ হয়নি বলে এখনো বিকেলটাকে দীর্ঘ বিকেল হিসেবে ধরা যায়। বিকেলটা ভাগ করা যায় স্পষ্টভাবে। প্রথম বিকেল, মধ্য বিকেল ও শেষ বিকেল।

রাকিব ভাবল, বিকেলের এই তিনটা ভাগ নিয়ে তিনটা কবিতা লিখলে কেমন হয়। জীবনের মতোই তিনটা ভাগ।

রাকিব তখনো ভিউ পয়েন্টের কাঠের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে দিঘল-বিস্তৃত দৃষ্টি। সামনের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ সমতল ভূমিতে বিকেলের রোদটা পড়েছে নরম প্রলেপ বিছিয়ে। বিকেলের এই কাঁচাসোনা রোদ যেকোনো মানুষের দৃষ্টিতেই মায়াবী স্পর্শ দেবে। সেই কাঁচাসোনা রোদটা রাকিবের দৃষ্টিতেও মায়াবী স্পর্শ দিচ্ছে। নাক বরাবর দক্ষিণে সবুজ দিগন্তের পর কাফিয়া হারবার হলেও পুবে বেশ স্পষ্টই আরেকটা পর্বত দেখা যায়। পর্বতটার নাম মাউন্ট করিনই।

মাউন্ট করিনইয়ের ওপর মেঘের ভেলা। তবে গাঢ় মেঘ নয়। সাদা খণ্ড খণ্ড মেঘ। সেই খণ্ড খণ্ড মেঘ বাদে আকাশের নিঃসীম নীলটা চারদিকের বিকেলের রোদের মতোই নরম ও পিঙ্গল সোনারং চকচকে।

নদী নিচে, পাহাড়ের ঢালে। ভিউ পয়েন্টের সামনে ও পেছনে বিস্তৃত ঘাসের লন। নদী সেই মসৃণ ঘাসের লনে জুতাগুলো হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটছে।

নদীর জুতা হাতে খালি পায়ে হাঁটার দৃশ্যটা রাকিব খুব উপভোগ করছে। তার মনে হচ্ছে, এ যেন মাউরি রূপকথার সেই টাফিয়াটু হাঁটছে। মাউরি আদিবাসীরা আর্য সম্প্রদায়ের বলে তাদের গায়ের রং জলপাই রঙের শ্যামলা। তবে নাকমুখ খুব সুচারু। আজকাল অবশ্য সাদা ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন এক প্রজন্মের সৃষ্টি হয়েছে। না সাদা, না জলপাই রং। ওদেরকে বলা হয় ক্রস জেনারেশন।

নদীর গায়ের রংও শ্যামলা। তবে অনেকটা জলপাই রঙের বলা যায়। সে খুব একটা সাজে না। বড়জোর চোখে কাজলের টান দেয়। নাকমুখ এত সুচারু নয়। খানিকটা ভোঁতাই বলা যায়। তারপরও নদীকে রাকিবের অনেক ভালো লাগে। নির্মল সুন্দরী মনে হয়। এখন যে নদী খালি পায়ে ঘাসের ওপর হাঁটছে, এটাও রাকিবের কাছে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য মনে হচ্ছে।

নদী গলা বাড়িয়ে বলল, রাকিব ভাই, নেমে আসেন না, প্লিজ।

রাকিব কিছু বলল না। হাসল।

নদী বলল, আহা, আসেন না, প্লিজ। ঘাসের ওপর খালি পায়ে হেঁটে দেখেন, কী দারুণ লাগে!

রাকিব বলল, তুমি একাই হাঁটো। আমার এখানেই ভালো লাগছে।

নদী বলল, আপনি কবি হয়েছেন কীভাবে? এত কাটখোট্টা?

রাকিব হেসে ফেলল। শব্দ করে হাসি, হা–হা–হা।

নদীও শব্দ করে হাসল, হি হি হি।

তাদের হাসির শব্দ কোথাও আঘাত খেয়ে আবার ফিরে এল। হা হা হা। হি হি হি!

নদী জোর দিয়ে বলল, আরে, আসেন তো। ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটতে কী যে ভালো লাগছে। আপনারও অনেক ভালো লাগবে।

ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটতে যে রাকিবের ভালো লাগে না, তা নয়। তার বেশ ভালো লাগে। নদীর সঙ্গে যখন পরিচয় হয়নি, তখন সে একা একা কোথাও গেলে কখনো কখনো ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটত। কিন্তু আজ কেন জানি তার এ মুহূর্তে ভিউ পয়েন্টে থেকে নামতে ইচ্ছে হলো না।

নদী আবারও অনুরোধ করতে গিয়ে থেমে গেল। তার হঠাৎই দৃষ্টি গেল খানিকটা দূরে তিনজন নারী লন ধরে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। তারা ভিন্ন বয়সী। কাছাকাছি হতেই নদী তাদের দুজনকে চিনে ফেলল। নদী তাদের একজনকে শিমুল ভাবির বাসায় দেখেছে। আরেকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল হ্যামিল্টনের বাংলাদেশি কমিউনিটির পিকনিকে। কারাপিরো লেকে পিকনিকটা হয়েছিল। ওখানে নদী গিয়েছিল। তৃতীয়জনকে অবশ্য নদী চিনতে পারেনি। তৃতীয়জন একজন মধ্যবয়স্কা নারী।

কাছাকাছি আসতেই নদী আগ বাড়িয়ে বলল, আরে মিরা ভাবি যে? নীলু ভাবি আপনিও এখানে?

মিরা ভাবি বললেন, হ্যাঁ, নদী যে! আমরা এখানে কয়েকটা ফ্যামিলি মিলে এসেছি। পিকনিক বলতে পার, আবার পটলাকও বলতে পার।

নীলু ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, শিমুল ভাবি কোথায়? শিমুল ভাবিকে দেখছি না?

নদী বলল, শিমুল ভাবি আসেননি তো। তিনি বাসায়।

: কার সঙ্গে এসেছ?

: ওনার সঙ্গে এসেছি। বলেই নদী রাকিবকে দেখাল।

রাকিব ভিউ পয়েন্ট থেকে একবার তাদের দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে তাকাল। নদীদের অবস্থান থেকে ভিউ পয়েন্টটা একটু দূরেই।

নীলু ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে?

নদী নির্দ্বিধায় বলল, আমার বন্ধু।

: তোমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?

: না। নাজমুল ভাইয়ের পরিচিত। তিনিই আমাকে নাজমুল ভাই ও শিমুল ভাবিদের বাসায় বোর্ডার হিসেবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

মিরা ভাবি পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাঙালি তো?

নদী বলল, হ্যাঁ, বাংলাদেশের। হ্যামিল্টনে জব করেন।

পাশ থেকে মধ্যবয়স্ক সেই নারী মিরা ভাবিকে একটু ওপাশে টেনে নিয়ে অস্ফুট গলায় বললেন, আরে মিরা, তুমি চিনতে পারনি? ওই যে ওই ছেলেটা। নদী যার সঙ্গে লিভ টুগেদার করে।

মিরা ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, নাজমা ভাবি, আপনাকে কে বলেছে?

নদী বুঝতে পারল, মধ্যবয়স্কা নারীর নাম নাজমা ভাবি।

নাজমা ভাবি ও মিরা ভাবি অস্ফুট গলায় ফিসফিস করে কথা বললেও নদী তা স্পষ্টই শুনতে পেল।

নাজমা ভাবি এবার গলা একটু বাড়িয়ে বললেন, আর কে বলবে, বেবুন ভাবি বলেছে।

মিরা ভাবি কথাটা আড়াল করার জন্য বলল, বেবুন ভাবিও একজন মানুষ, তার আবার কথা! তিনি অনেক কথা না বুঝেই বলেন।

নাজমা ভাবি বললেন, না না, বেবুন ভাবি সত্যি কথাই বলেছেন। এ নিয়ে নাকি মেয়েটার সঙ্গে তার ঝগড়াও হয়েছে। বেবুন ভাবি তো মেয়েটার ওপর মহা ক্ষ্যাপা।

নদী এ মুহূর্তে কী করবে বুঝতে পারল না। আবার সে কী বলবে সেটাও বুঝতে পারল না। সে কী এখান থেকে চলে যাবে নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব কথা শুনবে? তবে নদী এটা বুঝতে পারল, বেবুন ভাবি সত্যি তার পেছনে লেগেছে। সামনেও যেমন সুযোগ পেলে কটাক্ষ করে কথা বলেন, পেছনেও তেমন কুৎসা রটিয়ে বেড়াচ্ছেন। একজন মানুষ শুধু শুধু যে কেন আরেকজন মানুষের পেছনে লাগে!

নদী ভিউ পয়েন্টের দিকে তাকাল। ভাবল, ভাগ্যিস ভিউ পয়েন্টটা এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। নয়তো রাকিব ভাই এসব কথা শুনলে তাকে কী লজ্জাতেই না পড়তে হতো!

নীলু ভাবি একটু এগিয়ে এসে বললেন, আহা, নাজমা ভাবি, মেয়েটা শুনছে তো। এসব কথা এভাবে না বললে হয় না?

নাজমা ভাবি চুপ হয়ে গেলেন।

মিরা ভাবি বললেন, নদী, তোমরা আমাদের সঙ্গে জয়েন করতে পার। ওই যে। আমরা সবাই ওখানে বসেছি। আরও কয়েকটা ফ্যামিলি এসেছে। এ রকমটা আমরা মাঝেমধ্যেই করি। হুটহাট করে যার যার মতো রান্না করে কাছে বা দূরে কোথাও চলে যাই। তুমি আমাদের সঙ্গে জয়েন করলে তোমাদেরও ভালো লাগবে।

নদী মাথা ঝাঁকিয়ে রাকিবকে দেখিয়ে বলল, আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

মিরা ভাবি বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। নীলু ভাবি স্মিত হাসলেন। নাজমা ভাবি অকারণেই চেহারা কালো করে রাখলেন।

নদী আর কথা বাড়াল না।

তারা তিনজন ঘাসের লনে হাঁটতে হাঁটতে অন্যদিকে চলে গেলেন।

নদীও ভিউ পয়েন্টে ফিরে এল।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, তাদের তুমি চেন?

নদী আস্তে করে বলল, হ্যাঁ। তারা বাঙালি। বাংলাদেশের। একজনের সঙ্গে শিমুল ভাবিদের বাসায় পরিচয়। অন্যজনের সঙ্গে পরিচয় একটা পিকনিকে। আপনার মনে আছে, আমি বলেছিলাম হ্যামিল্টনের বাংলাদেশি কমিউনিটির পিকনিকে আমি কারাপিরো লেকে গিয়েছিলাম?

রাকিব বলল, হ্যাঁ। সে তো কয়েক মাস আগে। তারপর তো তুমি-আমি মিলে কিছুদিন আগেই কারাপিরো লেকে ঘুরে এলাম।

নদী বলল, হ্যাঁ। আরেক ভাবির সঙ্গে সেই কারাপিরো লেকের পিকনিকেই পরিচয়। তবে তৃতীয়জনকে আমি কখনো দেখিনি।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও।

নদী বলল, তাদের সঙ্গে আরও কয়েকটা বাঙালি ফ্যামিলি এসেছে। আমাদেরও তাদের সঙ্গে জয়েন করতে বলেছে।

: তারা কি পিকনিক করতে এসেছে?
: তারা বলল, ঠিক পিকনিক নয়। আবার পিকনিকের মতোই। তারা যার যার মতো রান্না করে নিয়ে এসেছেন। তারা নাকি মাঝেমধ্যেই এ রকমটা করেন। নিজেরা রান্না করে একসঙ্গে কয়েক ফ্যামিলি মিলে দূরে কোথাও চলে যান। শিমুল ভাবিরাও এ রকমটা করেন। হঠাৎ হঠাৎ কাছে বা দূরে পটলাক করতে চলে যান। তবে শিমুল ভাবিদের গ্রুপটা অন্য।

: ও, এখানে বাঙালিদের মধ্যে আলাদা আলাদা গ্রুপও আছে।

: হ্যাঁ, হ্যামিল্টনে তো খুব বেশি বাঙালি নেই। এদের মধ্যেই তিনটা-চারটা গ্রুপ।

: বেশ ভালো। বাঙালি স্বর্গে গেলেও মনে হয় একত্রে থাকতে পারবে না। গ্রুপিং করবে।

নদী হাসল। বলল, আপনি কি ওখানে যাবেন?

: রাকিব জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

নদী বলল, ওই যে, তারা পটলাক করতে এসেছেন, ওখানে? ওই যে তিন ভাবির সঙ্গে ওখানে দেখা হলো না? তাদের দুজন আমাকে খুব অনুরোধ করে গেছেন।

: তাই! তাহলে তুমি যাও।

: না না, আমি বলেছি, আপনাকে জিজ্ঞেস করব। আপনি কি যাবেন?

রাকিব মাথা নেড়ে বলল, না। আমার ঠিক ভালো লাগবে না। তুমি যাও, প্লিজ।

নদী বলল, আপনি না গেলে আমি যাই কী করে?

রাকিব তাড়াতাড়ি বলল, না না, আমার জন্য চিন্তা করবে না। আমার এখানেই ভালো লাগছে। তুমি যাও। আমি খুব খুশি হব।

নদী মাথা নেড়ে বলল, না। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: