সবুজ মেঘের ছায়া-এক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গতরাতে নদী তার মায়ের সঙ্গে মেসেঞ্জারে অনেকক্ষণ কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু সে তার মায়ের কাছ থেকে খুব একটা আগ্রহ পায়নি। মা যেন নদীর কথাগুলো ঠিক পছন্দ করছিলেন না। বারবার কেমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলেন। কথার উত্তরগুলোও দিচ্ছিলেন কেমন নিষ্প্রভভাবে। বেশির ভাগ কথাই তিনি সংক্ষিপ্তভাবে দু-একটা শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করছিলেন।

গত রোববার মাউন্ট পিরংগিয়া থেকে ফিরে ওই রাতেও নদী মাকে ফোন দিয়েছিল। সেই রাতেও নদী যতটুকু আনন্দ ও আগ্রহ নিয়ে তার চাচাতো ভাই নাবিদ চৌধুরী, জুঁই ও মৌনতার কথা বলছিল, মা যেন ততই নিস্পৃহ ও নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছিলেন।

নদী ওর মার এভাবে নিস্পৃহ হয়ে যাওয়ার কারণ যে বুঝতে পারছে না, তা নয়। স্পষ্টই বুঝতে পারছে। কিন্তু এতে তার নাবিদ ভাই, জুঁই ভাবি বা মৌনতার কী দোষ? দোষ অন্য কারও থাকতে পারে। তার দাদার, সময়ের কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির। হয়তো নিয়তি নিয়ন্তার হাতও ছিল।

নিয়তি নিয়ন্তা! নদী নিয়তি নিয়ন্তা শব্দটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করে রাকিবের কথা মনে পড়ল। গত রোববারে সে রাকিবের সঙ্গে মাউন্ট পিরংগিয়া গিয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহের ওপরে হয়ে গেল। আজ আবার রোববার। গত এক সপ্তাহে রাকিবের সঙ্গে তার খুব একটা কথা হয়নি। মাত্র দুই দিনই ফোনে কথা হয়েছে।

অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেই নাবিদের সঙ্গে মাউন্ট পিরংগিয়াতে নদীর সাক্ষাৎ হয়। এরই মধ্যে তার বেশ কয়েকবার নাবিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। নদী নিজেই থেকে ফোন দিয়েছে। জুঁই ও মৌনতার সঙ্গে কথা বলেও সে খুব আনন্দ পেয়েছে। একে কী রক্তের টান বলে? আর মৌনতা কী মিষ্টি! মাউন্ট পিরংগিয়া থেকে ফেরার পর তার কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে।

আজ নদী দুপুরে নর্থ হ্যামিল্টনের গ্লেন ভিউতে নাবিদের বাসায় যাবে। এ ব্যাপারে সে মনে মনে একটু চাপ বোধ করছে। ছোটবেলা থেকে নদী সবার কাছ থেকে শুনে এসেছে, দাদার বাড়ি যাওয়ার জন্য নাকি সে বেশ জেদ ধরত! মা থাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এটা-সেটা বলে তাকে থামাত। বড় হয়ে অবশ্য সে মার কষ্টটা বুঝতে শিখেছিল। তাই সে খুব একটা জেদ বা বায়না ধরত না। তারপরও তার ভেতর একটা ছোট্ট হাহাকার ছিল। তার বন্ধুবান্ধবেরা ঈদে-পার্বণে দাদার বাড়িতে যেত, আর সে ঢাকাতেই পড়ে থাকত। মাঝেমধ্যে যে তার মনে মনে ঢাকা শহরে আত্মীয়স্বজনকে খুঁজতে মন চায়নি, তা নয়। মার কষ্টটা ভেবে সে আর এগোয়নি। কিন্তু এই নিয়তি নিয়ন্তা কোথায় কোন দূর দেশ, এই নিউজিল্যান্ডের এক পর্বতের ওপর মাউন্ট পিরংগিয়ায় আকস্মিকভাবে তার এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিল। হোক দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। তারপরও একই বংশের তো!

নদী আজ রাকিবের বাসায় যাবে না। রাকিব তার ফ্ল্যাটমেট আতিককে নিয়ে কী একটা কাজে অকল্যান্ডে মতি ভাই নামে কারও বাসায় যাবে। আজ রাতেই আবার তারা ফিরে আসবে। কাল সকালে রাকিবের অফিস আছে।

তবে নদী হ্যামিল্টন ইস্টে ঠিকই যাবে। হ্যামিল্টন ইস্টে গিয়ে তার শিক্ষক প্রফেসর রজারসনের বাসায় যাবে। প্রফেসর রজারসনের শরীর খুব খারাপ। ওয়াইকাটো হাসপাতাল থেকে এক নার্স সকাল-বিকেল ও সন্ধ্যায় তিনবেলা এসে তাঁকে দেখে যান। হাসপাতালের এক ডাক্তার দিনে একবেলা করে আসেন। এ ছাড়া হাসপাতালের এক কর্মী বাসার সব কাজ করে দিয়ে যায়। তারপরও নদী গত চার দিন ধরে দিনেরবেলায় ক্লাস শেষে বা ল্যাবের কাজ করে একবার হলেও প্রফেসর রজারসনকে দেখে আসে। প্রফেসর রজারসন এখন সুপ বা লিকুইড জাতীয় খাবারই খান। ভারী কোনো খাবার খেতে পারেন না।

গত চার দিন ধরে নদী হ্যামিল্টন ইস্টে প্রফেসর রজারসনের বাসায় গেলেও রাকিবের বাসায় একবারও যায়নি। তার যে রাকিবের বাসায় যেতে অনীহা ছিল, তা নয়। বরং বেশ আগ্রহই ছিল। কিন্তু সে কী করবে, রাকিবের নয়টা-পাঁচটা অফিস। গতকাল শনিবার হলেও রাকিব সারা দিন অফিস করেছে। কেমব্রিজের প্রজেক্টটা নিয়ে কী একটা ঝামেলা হয়েছে। এতে রাকিবের কোনো দোষ নেই। ফ্লিটচার কোম্পানির পুরো সিস্টেমেরই সমস্যা ছিল।

আজ রাকিবের ডে-অফ থাকলেও তার ফ্ল্যাটমেট আতিকের ঝামেলায় আবার অকল্যান্ড যেতে হয়েছে। ঝামেলাটা কী, নদী অবশ্য জানে না। এ সপ্তাহে রাকিবের সঙ্গে ফোনেও তেমন কথা হয়নি। মাত্র দুই দিন কথা হয়েছে। মাউন্ট পিরংগিয়া থেকে ফেরার পর একবার, আর গতকাল সন্ধ্যায়।

নদী এ মুহূর্তে জানালার পাশে বসে দিঘল ফিন্সলি স্ট্রিটের দিকে দিঘল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। তার ঘুম ভেঙেছে বেশ আগেই। এতক্ষণ সে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। রোববারের সকালটা সে আরাম করে অনেক সময় নিয়ে ঘুমায়। আজও সে তা-ই করছে। এখন ঘড়িতে প্রায় দশটা বাজে। শরতের প্রায় শেষ। শীতকাল প্রায় আসি আসি করছে। ডে-লাইট সেভিংসও শেষ। এরই মধ্যে শীতটা বেশ জেঁকে পড়েছে। গতরাতে কুয়াশা পড়েছিল। যেকোনো কারণেই হোক, হিলক্রেস্ট-ক্লোডল্যান্ড সাবার্বে শীত-কুয়াশা একটু বেশিই পড়ে।

এখন থেকে বারোটা পর্যন্ত নদীর হাতে কোনো কাজ নেই। গতকাল সে পুরো সপ্তাহের রান্না করে কন্টেইনারে ভরে ফ্রিজে রেখেছে। এ কাজটা সে কখনো কখনো রোববারেও করে।

আজ যেহেতু কোনো কাজ নেই তাই নদী ভাবল, সে আরও কিছুক্ষণ লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে। বারোটার দিকে সে হ্যামিল্টন ইস্টে রজারসন স্যারের বাসায় যাবে। ওখানে আধা ঘণ্টার মতো থেকে সে ওয়েলিংটন স্ট্রিট থেকে বাস ধরে দুটোর আগেই গ্লেন ভিউতে নাবিদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে পৌঁছাবে।

নাবিদের বাসায় প্রথম যাবে বলে নদী মনে মনে সত্যি একটু চাপ বোধ করছে। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে এত কাছের একজন মানুষ! হোক তিনি দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। কিন্তু একই চৌধুরী বাড়ির তো! ওর তো এমনিতেই কোনো আপন ভাইবোন নেই।

জুঁই ভাবিকে নদীর বেশ ভালো লেগেছে। যদিও সেদিন মাউন্ট পিরংগিয়ার চূড়ায় সে অল্পক্ষণই জুঁই ভাবির সান্নিধ্যে কাটিয়েছে। খুব অল্প কথাই হয়েছে। তারপরও তাকে মনে হয়েছে বেশ মিশুক।

নদী আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে ভাবলেও কী ভেবে জানালার দিকে আবার তাকিয়ে বিছানায় উঠে বসল। জানালার দিকে তাকিয়েই সে দুই হাতের দশ আঙুল একত্রে করে মটকা ফোটাল-মট মট, কট কট, ময়ট ময়ট। শরীরের আড়মোড়া ভাঙল শরীর টান টান করে। সে নিজেকে দেখল একটু। এমনিই। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় সে যে ওজন নিয়ে এসেছিল গত দুই বছরের নিউজিল্যান্ডের বসবাসে তার খুব একটা ওজন বাড়েনি। এর পেছনে প্রধান কারণ, সে প্রচুর হাঁটে। তার গাড়ি নেই বলেই তাকে প্রচুর হাঁটতে হয়।

শীতকাল প্রায় চলে এসেছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। নিউজিল্যান্ডের শীতের বৃষ্টি। শীতের বৃষ্টিতে সকালে উঠে ছাতা মাথায় ইউনিভার্সিটিতে যাওয়াটা খুব কষ্টকর।

মাস কয়েক আগে নদী রাকিবের কাছ থেকে ড্রাইভিংটা ভালোভাবে শিখে গাড়ির রেস্ট্রিকটেড ফুল লাইসেন্সটা নিয়ে রেখেছে। স্কলারশিপ থেকে টাকা বাঁচিয়ে বেশ কিছু টাকাও জমিয়েছে। আরও কিছু টাকা জমলে সে সস্তায় একটা গাড়ি কিনবে।

নিউজিল্যান্ডে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির দাম খুব সস্তা। পাঁচ-ছয় হাজার ডলারে ভালো একটা গাড়ি কেনা যায়। কিন্তু নদী পাঁচ-ছয় হাজার ডলারই একত্রে জমাতে পারছে না। স্কলারশিপ থেকে স্টুডেন্ট অ্যালাউন্স আর কত পায়? থাকা-খাওয়ার খরচ বাদে আর কীই-বা টাকা জমানো যায়? তবুও সে পাই পাই করে জমাচ্ছে। একটা পার্ট টাইম চাকরি হলে তাকে এ সমস্যায় পড়তে হতো না। কিন্তু হ্যামিল্টনে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা সহজে চাকরি খুঁজে পায় না, সেখানে একজন আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের চাকরি পাওয়া তো সোনার হরিণ হাতে পাওয়া।

রাকিব অবশ্য গাড়ি কেনার জন্য নদীকে কয়েক হাজার টাকা ধার দিতে চেয়েছিল। বলেছিল আস্তে আস্তে দিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু রাকিবের কাছ থেকে নদীর টাকা ধার নিতে খুব সংকোচবোধ হয়। এমনিতে সে নিজে রাকিবের ওপর যখন-তখন অধিকার খাটায় ঠিকই। তার গাড়িটা সারা দিনের জন্য চেয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তার কাছ থেকে টাকা ধার নিতে নদীর কিছুতেই মন চায় না।

জানালা গলে বাইরের একটা রোদ রুমের ভেতর এসে পড়েছে। জানালার কাচ এখন কুয়াশায় ভেজা নয়। তারপরও রুমের রোদটায় একটা ঝিকিমিকি চিত্রল খেলা। নদী সেই রোদটার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে বিছানা ছেড়ে নামল। নেমেই সে রোদটায় পা দিল। রোদে শীত ও উষ্ণতার আবেশ।

রোদে পা দিয়ে নদী জানালা গলে দিঘল ফিন্সলি স্ট্রিটে দিঘল দৃষ্টি মেলল। ফিন্সলি স্ট্রিটের দুই পাশে সারি সারি ম্যাপল গাছের একটাতেও এখন পাতা নেই। গাছগুলো এখনো ছোট। তাই গাছগুলোকে কেন্দ্র করে সোনালি রঙের পাতাগুলো বৃত্তাকারে বিছিয়ে রয়েছে। পাতাগুলোর ভেজা ভাবটা এখান থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ভেজা পাতায় রোদ পড়ে আলোর সূক্ষ্ম ও সরু প্রতিবিম্ব হচ্ছে।

নদী ঝরে পড়া ম্যাপল গাছের পাতাগুলোর দিকে আরও ভালো করে তাকাল। এমনিই। ভাবল, পাতাগুলো কি আসলেই সোনালি? সে মাথা নাড়ল। না, ঠিক সোনালি নয়। বিভাস খয়েরি।

বিভাস খয়েরি! এমন একটা কঠিন শব্দ নিয়ে ভাবতে গিয়ে নদী নিজে নিজে হাসল। তার আবার মার কথা মনে পড়ল। মা এসব কঠিন ও সাংকেতিক শব্দ কবিতায় ব্যবহার করেন। এ রকম কঠিন ও সাংকেতিক শব্দ আরও একজন ব্যবহার করেন। রাকিব ভাই! নদী ভাবল, এক কবির পাল্লায় পড়ে সে বেড়ে উঠেছে। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে আরেক কবির পাল্লায় পড়ে সে বেদিশা হচ্ছে।

নদী সঙ্গে সঙ্গে মাকে ছাপিয়ে রাকিবকে নিয়ে ভাবতে বসল। সারা সপ্তাহ অপেক্ষার পর শনিবার বা রোববার এলে সে নিজেকে কেন এমন অসম্পূর্ণ বোধ করে। একটা আনন্দ, আনন্দের একটা দৌরাত্ম্য। একটা সম্পর্ক, সম্পর্কের একটা দৌরাত্ম্য...!

নদী আবার শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ভাবল, ধ্যাত, সে কী যা-তা ভাবছে! তবে সে আজকাল প্রতিনিয়ত এই ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে, ইচ্ছে হলে সে নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে। পছন্দটা তার, পছন্দ না হওয়াটাও তার। মানুষটাকে সত্যি সে অনেক শ্রদ্ধা করে। শ্রদ্ধা যদি ভালোবাসা হয়, তাতে ক্ষতি কী?

বাইরে চমৎকার রোদ উঠলেও রুমের ভেতর শীত শীত ভাবটা তখনো রয়ে গেছে। নদী ওয়ার্ডরোব থেকে গাউনটা নিয়ে গায়ে চাপিয়ে রুম থেকে না বের হয়ে দরজায় দাঁড়িয়েই লাউঞ্জে তাকাল।

লাউঞ্জ ফাঁকা। সাধারণত এ সময় নিঝুম টিভির সামনে চুপচাপ বসে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকে। নিরালাকেও লাউঞ্জে দেখা যাচ্ছে না। নাজমুল আহসান শুক্রবার ও শনিবারে নাইট শিফটে ট্যাক্সি চালান বলে দিনে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর বারোটা কী একটা বেজে যায়। কিন্তু শিমুল ভাবি কোথায়? নদী ভাবল, ওরা বাইরে যায়নি তো?

নদী দরজা থেকে ফিরে এসে বাথরুম ঢুকে থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই ভেতরের কোনো একটা রুম থেকে কারও কথাবার্তা শুনল। নদী কৌতূহলী হয়ে রুম ছেড়ে বের হয়ে করিডর ধরে এগোতেই নিঝুমের রুম থেকে শিমুল ভাবি ও নিরালার গলা শুনল।

নদী নিঝুমের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকাতেই দেখল, শিমুল ভাবি সিথানের পাশে একটা চেয়ারে বসে নিঝুমের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন। নিঝুম লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নিরালা খাটের একপাশে বসে পা দোলাচ্ছে।

নদী গতরাতেই শুনেছে, নিঝুমের নাকি গাটা গরম। ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। এ সময় ঘরে ঘরে ভাইরাসজনিত জ্বর হয়ে থাকে।

নদী নিঝুমের রুমে ঢুকে খাটের কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাবি, নিঝুমের জ্বরটা কি বেশি এসেছে?

শিমুল ভাবি মাথায় পট্টি দেওয়া থামিয়ে মেজাজ খারাপ করে বললেন, আমার কপাল, আর বলো না!

: কী হয়েছে ভাবি?

: এমন বাজে স্কুল।

: স্কুলের আবার কী হলো?

: স্কুলের কিছু হয়নি। হয়েছে এখানকার লেখাপড়ার বাজে সিস্টেমের।

: লেখাপড়ার বাজে সিস্টেম?

: হ্যাঁ, দেখ না, আমার ছেলেটাকে এমন ঠা–ঠা রোদের মধ্যে পুরো তিন ঘণ্টা হাঁটিয়ে এনে জ্বর বাঁধিয়ে দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের রোদ যা বাজে! এমন বাজে রোদের চাপ কী আমার ছেলেটা সহ্য করতে পারে?

নদী জানে, নিউজিল্যান্ডের রোদ খুব খারাপ। এখানকার রোদে আলট্রা-বায়োরশ্মি খুব তীব্র। এ ছাড়া রোদে কোনো আর্দ্রতা নেই বলে দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড়ালে চেহারা পুড়ে তামা বা পেতল হয়ে যায়। তাই সে শীত-গ্রীষ্ম সব সময় একটা ছাতা হাতে রাখে।

নদী জিজ্ঞেস করল, নিঝুমকে কি স্কুল থেকে তিন ঘণ্টা বাইরে ঘুরিয়েছে?

শিমুল ভাবি বলল, তাহলে তোমাকে আর কী বলছি?

: তাকে কেন ঘুরিয়েছে?

: শুক্রবারে স্কুল থেকে কী সব রাস্তার ট্র্যাফিক সিগন্যাল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।

: ও, সে তো ভালো কথা।

: ভালো আর কী, শুক্রবারে স্কুল থেকে ফিরেই আমার ছেলেটা বলছিল, তার শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। একটা রাত ভালোই ছিল। গত রাত থেকে জ্বর শুরু হয়েছে। এখন যে আমার ছেলেটা জ্বর বাঁধিয়েছে, এর দায়িত্ব নেবে কে?

নদী মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না। তার বুঝতে বাকি রইল না, আসল ব্যাপারটা কী। ব্যাপারটা রোড কোড সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান নিয়ে। নিঝুমের স্কুলের শিক্ষকের তার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের এমন ঠা–ঠা রোদের ভেতর তিন ঘণ্টা ধরে হাঁটিয়ে আনার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, নিউজিল্যান্ডের রোড কোড সম্বন্ধে ব্যবহারিক জ্ঞান দেওয়া। ট্র্যাফিক সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিং, গিভওয়ে সাইন, স্টপ সাইন, রাউন্ড অ্যাবাউট, ফুটপাত, ইয়োলো ডট, হোয়াইট ডট ইত্যাদি আঙুলে ধরে ধরে দেখানো।

নদী জানে, নিউজিল্যান্ডের স্কুলগুলোতে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার। স্কুলগুলোতে বয়স ও ক্লাস অনুযায়ী একেক ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আরও অনেক কাজ, রাস্তাঘাটে নিরাপদ চলাচল, বাড়িতে নিরাপদে বসবাস ও দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান। এমনকি, ছাত্রছাত্রীদের টিন এইজে পড়তেই স্কুল থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও এইডস সম্বন্ধে ব্যবহারিক জ্ঞান দেওয়া হয়। ক্লাসে কনডম এনে নিরাপদ সেক্সের জন্য ওদেরকে কনডমের ব্যবহার প্রণালির শিক্ষা দেওয়া হয়।

নিউজিল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের মতো বই পড়ে মুখস্থ করা নয়। এখানে রাত জেগে চোখ লাল করে ঘুম ঘুম চোখে পড়তে হয় না। হামিদ বাবার সঙ্গে শহরে ঘুরতে বের হলো, অ্যাঁ অ্যাঁ পথে জেব্রা ক্রসিং ও ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ল। একজন ট্রাফিক পুলিশ ডানহাত মেলে দিয়ে বাম হাত বাঁকা করল। তারপর হামিদ, অ্যাঁ অ্যাঁ ফুটপাত, অ্যাঁ অ্যাঁ ট্রাফিক লাইট, অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ...! ছাত্র তখন পড়ার টেবিলেই ঘুমে কাত। তখন জায়গির মাস্টার বা মায়ের বেত্রাঘাত পড়ে। ছাত্র আবার জেগে উঠে পড়া শুরু করে, অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, হামিদ, হা-মি-দ, জেব্রা ক্রসিং, ট্র্যাফিক সিগন্যাল, অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ...!

নিউজিল্যান্ডে স্কুলগুলোতে কখনোই ছাত্রছাত্রীদের রাত জেগে মুখস্থ করার মতো বিশাল হোমওয়ার্ক দিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে না। এখানে শিক্ষক-শিক্ষিকারা ক্লাসের পড়া ক্লাসেই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অত্যন্ত যত্নসহকারে ও অতি সুকৌশলে থেকে আদায় করে নেন।

নিঝুম সারাক্ষণ কম্পিউটার ও প্লে-স্টেশন নিয়ে অযথা সময় কাটায় বলে নাজমুল আহসান একদিন স্কুলে গিয়ে নিঝুমের ব্যাপারে অভিযোগ তোলেন। ক্লাসের শিক্ষকদের কাছে অনুরোধ করেন, তারা যেন নিঝুমকে বেশি বেশি হোমওয়ার্ক দেন।

নাজমুল আহসানের অভিযোগ ও অনুরোধ শুনে ক্লাসের শিক্ষক পরদিন বেশি করে হোমওয়ার্ক হিসেবে নিঝুমের সঙ্গে অনেকগুলো গল্পের বই পাঠিয়ে দেয়। তখন নিঝুমকে আর পায় কে! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>