সবুজ মেঘের ছায়া-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুপুরের রোদটা গায়ে মেখে নাবিদ একটা চেয়ারে পা ছেড়ে বসে আছে। সে বসে আছে বাসার পেছনের দোতলার বেডরুমের পাশের ব্যালকনিতে, আউট ডোর সেটিংয়ের একটা চেয়ারে। কতক্ষণ ধরেই তার দৃষ্টিটা এপাশ-ওপাশ করছে। কখনো তার দৃষ্টি ক্যাবেজ গাছের চিরল পাতার তির তির কাঁপুনিতে আটকে যাচ্ছে। কখনো তার দৃষ্টিটা পাতা ঝরতে থাকা পপলার গাছের মাথায় গিয়ে থামছে। পপলার গাছটা অনেক উঁচু বলে গাছের মাথায় বাতাস নৃত্য করছে। গাছের মাথাটা ঠিক হেলেদুলে নড়ছে না। নৃত্যের তালে তালে একজন যুবতী যখন মাথা নাচায়, গাছের মাথাটা ঠিক তেমন ভাবেই নাচছে। শুধু তা ধিং তা ধিং শব্দটাই শোনা যাচ্ছে না। তবে বাড়ির পেছন দিয়ে যে ঝরনাটা বয়ে গেছে, এর শব্দ আসছে-কল কল, কুল কুল।

নাবিদ নদীর কথাই ভাবছে। কী অবাক ব্যাপার! যার কথা সে প্রায় ভুলতেই বসেছিল, সেই রাজীব চাচা। রাজীব আহসান চৌধুরী। তার মেয়ে নদী এই নিউজিল্যান্ডে...!

রাজীব আহসান চৌধুরী নাবিদের আপন চাচা ছিলেন না। তবে একই চৌধুরী বাড়ির যেহেতু, একটু দূরের হলেও একই বংশের তো! এ ছাড়া তার সঙ্গে নাবিদের একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলায় তিনি তাকে পড়িয়েছেন। রাজীব চাচা পড়িয়েছেন বলেই নাবিদ পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিল। রাজীব চাচা সাহিত্যটা ভালো বুঝতেন। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এলে তিনি সাহিত্যের আলোচনা করতেন। এভাবে নাবিদ সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠে।

নাবিদও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে। তবে সাহিত্যের প্রতি যতই অনুরক্ত হয়ে উঠুক, সে বাংলা সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেনি। নাবিদ বরাবর বিজ্ঞানের ছাত্র, বিজ্ঞান নিয়েই লেখাপড়া করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিষয় ছিল পদার্থ বিজ্ঞান।

রাজীব চাচার সঙ্গে নাবিদের বয়সের পার্থক্যও খুব বেশি ছিল না। মাত্র নয় বছরের পার্থক্য। চাচা-ভাতিজার সম্পর্কের বাইরেও তাদের একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নাবিদ যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়, তত দিনে রাজীব চাচা মারা গেছেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের প্রথম দিকে নাবিদ তার রাজীব চাচাকে খুব বেশি অনুভব করত।

রাজীব চাচার স্ত্রী আলপনা আহসান চৌধুরীকে নাবিদ জীবনে একবারই দেখেছে। সেটাও তাদের বিয়ের পরপর। সেদিনের কথাটা নাবিদের এখনো স্পষ্ট মনে আছে। পুরো চৌধুরী বাড়িতে হুলুস্থুল। এই হুলুস্থুল আনন্দের নয়, বিচ্ছেদের। রাজীব চাচা তার স্ত্রীর হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাড়ির কেউ আটকাচ্ছে না, বরং পেছন থেকে শোরগোল তুলে সবাই অভিশাপ দিচ্ছে।

নাবিদের বয়স তখন আর কত ছিল? পনেরো কী ষোলো। সেদিন সে নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। আর সেদিনই সে তার রাজীব চাচাকেও শেষবারের মতো দেখেছিল। এর বছর দেড়েক বা দুই পরে নাবিদ একদিন শোনে, ঢাকার ডেমরা না কোথায় রাজীব চাচা মারা গেছেন...!

এটা প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগের কথা। আজ এত দিন পর সেই রাজীব চাচার মেয়ে নওরীন চৌধুরী নদীর সঙ্গে গত সপ্তাহে রোববারে মাউন্ট পিরংগিয়াতে দেখা। দেশ থেকে বহুদূর, দূরদেশে। নাবিদ মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবল, ব্যাপারটা কী আজবই না!

আজও রোববার। আজ নদী বাসায় আসবে। দুপুরে নদী হ্যামিল্টন ইস্টে তার এক শিক্ষকের বাসায় যাবে। সেখান থেকে বাস ধরে এখানে আসবে। নাবিদের বাসাটা নর্থ হ্যামিল্টনের গ্লেন ভিউতে।

নাবিদ ঘড়ি দেখল। সবে একটা বাজে। নদী বলেছে, সে দুটোর দিকে আসবে। আরও এক ঘণ্টা বাকি।

নাবিদ নদীর কথা ভাবতে ভাবতে আবার পপলার গাছটার দিকে তাকাল। পপলার গাছের মাথাটা আগের মতোই নাচছে। পপলার গাছের একটা বৈশিষ্ট্য, গাছটা মোটা হয়ে শুধু ওপরের দিকে বেড়ে ওঠে। সরু সরু ডাল বের হয় ঠিকই কিন্তু মোটা কোনো ডাল হয় না। এতে গাছটাকে দেখতে মনে হয় নিঃসঙ্গ বিশাল আকৃতির সবুজ কোনো মূর্তির মতো। আর এটাও সত্য, নিউজিল্যান্ডের কৃষকেরা পপলার গাছ তাদের জমির সীমানার পাহারাদার হিসেবেই ব্যবহার করেন। কৃষকেরা তাদের জমির সীমানা নির্ধারণের জন্য প্রতিটা জমির পাশে সারি করে পপলার গাছ লাগিয়ে রাখেন।

শীতকালে পপলার গাছের সব পাতা ঝরে গিয়ে কেমন যেন উলঙ্গের মতো হয়ে যায়।

পপলার গাছটার দিকে তাকাতে তাকাতে নাবিদ পাশের ক্যাবেজ গাছটার দিকেও তাকাল। গ্রীষ্মকালে ক্যাবেজ গাছটায় দুধ সাদা ফুল ফুটেছিল। এখন শরতে এসে ফুলগুলো ধূসর হয়ে ঝরে গেছে। তবুই ধূসর ডাটগুলোতে কিছু ধূসর ফুল আটকে আছে। ক্যাবেজ গাছের চিরল পাতাগুলোও শরতের মৃদুমন্দ বাতাসে কাঁপছে তির তির, তির তির।

নাবিদ ক্যাবেজ গাছটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাশের এলিরা স্মিথের বাড়ির দিকে তাকাল।

এলিরা স্মিথ রাকিবের প্রতিবেশী। প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়স ভদ্রমহিলার। এত বড় বাড়িটায় একাই থাকেন। অবশ্য তিনি সম্পূর্ণ একা থাকেন বললে ভুল হবে। তার সঙ্গে একটা কুকুরও বসবাস করে।

আগে এলিরা স্মিথের কুকুরটার একটা সঙ্গী ছিল। মাস ছয় আগে সেই সঙ্গী কুকুরটা লিভার ক্যানসারে মারা গেছে। কুকুরটার মৃত্যুতে এলিরা স্মিথ কী যে কেঁদেছিলেন! এ দেশি মানুষ সাধারণত শব্দ করে খুব কম কাঁদেন। কান্নায় তাদের শুধু চোখ ভেজে। কিন্তু এলিরা স্মিথ কুকুরটার মৃত্যুতে সেদিন খুব শব্দ করে কেঁদেছিলেন। আর্তনাদে কুঁই কুঁই কান্না যাকে বলে!

কুকুরটার মৃত্যুর আগে এলিরা স্মিথ কুকুরের ক্যানসারের চিকিৎসা বাবদ প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার ডলার খরচ করেছিলেন। তার সারা জীবনের সঞ্চয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ টাকা। মাঝেমধ্যে নাবিদের মনে হয়, এ দেশের মানুষ যেন তাদের ছেলেমেয়েদের চেয়েও কুকুর বেড়ালকে বেশি ভালোবাসেন।

নিউজিল্যান্ডের বয়স্ক পুরুষ ও নারীদের জীবনটাকে নাবিদের কাছে মনে হয় এক যন্ত্রণাময় জীবন। ছেলেমেয়ে কাছে থাকে না। অনেকে বৃদ্ধ বয়সে আবার বিয়ে করেন। বিয়ে করে সংসার জীবন ও ভালোবাসার স্বাদ নেন। কিন্তু সেই সংসার জীবন ও ভালোবাসার স্বাদও বেশি দিন টিকে না। বেশি বয়স হওয়ায় হুট করেই কেউ না কেউ মারা যান। তখন যিনি জীবিত থাকেন, তার আরও নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসে। একাকী দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, একাকী ভেতরে-ভেতরে কাঁদেন। বৃদ্ধ বয়সে চলার সঙ্গী হারিয়ে এমনিতেই তারা যেন আরও বৃদ্ধ হয়ে যান।

নিউজিল্যান্ডের বয়স্কদের কাছে বাগান খুব প্রিয় হয়। অবসরে যাওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে তাদের কিছু করার থাকে না বলে তারা বাড়ির সামনে বা পেছনে ছোট-বড় বাগান গড়ে তোলেন। সেই বাগানে তারা সারা দিন এটা-সেটা করে বেড়ান। একটা ছোট্ট নুড়িপাথর বা একটা ঘাসকে পর্যন্ত তারা মমতা দিয়ে বাগানে সাজান।

এলিরা স্মিথের স্বামীও মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। নাবিদ অবশ্য এলিরা স্মিথের স্বামীকে কখনো দেখেনি, দেখার কথাও নয়। নাবিদ তার এই বাড়িটা কিনেছে তিন বছর আগে।

তবে স্বামী হারানোর পর যে একাকিত্ব, নাবিদ এলিরা স্মিথের সেই একাকিত্ব বরাবরই দেখেছে। এলিরা স্মিথের ষাট-পঁয়ষট্টি বা বৃদ্ধ বয়সের বিয়ে নয়। তাদের পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্যজীবন। এলিরা স্মিথের যখন পঁচিশ বছর বয়স, তখন তারা বিয়ে করে হল্যান্ড থেকে নিউজিল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করে। তারপর তাদের অবিচ্ছেদ্য সুখদুঃখের দীর্ঘ বিবাহিত জীবন। তাদের ঘরে তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়।

অবশ্য ছেলেমেয়েরা কেউ এলিরা স্মিথের সঙ্গে থাকেন না। ওরা নিজেদের সংসার, ছেলেমেয়ে নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে বসবাস করে। নাবিদ এই তিন বছরে এলিরা স্মিথের ছেলেমেয়েদের কাউকে এ বাড়িতে দেখেনি।

এলিরা স্মিথও অন্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মতো সারা দিন দুটো কাজ খুব গুরুত্বসহকারে করেন। তার প্রথম কাজ কুকুরের সেবা-যত্ন করা। কুকুরটার দীর্ঘ লোমগুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দেওয়া। কুকুরটার দাঁত ব্রাশ করিয়ে দেওয়া। শ্যাম্পু দিয়ে একটা ছোট্ট বাথটাবে কুকুরটাকে গোসল করানো। সপ্তাহে একদিন ডেকে বসে কুকুরটার নখ কাটা।

এলিরা স্মিথের দ্বিতীয় কাজটা হলো, বাগানের পরিচর্যা করা। তিনি তার বাড়ির পেছনে অদ্ভুত সুন্দর একটা বাগান গড়ে তুলেছেন। বাগানের প্রতিটা গাছপাতায় যেন তার মমতার স্পর্শ। কুকুরের সেবাযত্ন করা বাদে দিনের বাকিটা সময় তিনি এই বাগানেই কাটান। কত জাতের ফুল ও ফলের গাছ যে তিনি লাগিয়েছেন!

প্রতিবেশী হিসেবে এলিরা স্মিথের সঙ্গে নাবিদ বা জুঁইয়ের বেশ ভালো সম্পর্ক। তবে মৌনতার সঙ্গেই এলিরা স্মিথের সম্পর্কটা বেশ গভীর। মৌনতা একটা বাকপটু বলে সুপারমার্কেট বা শপিংমলে ঘুরতে গেলে এ দেশি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাকে খুব পছন্দ করে। যেচে কথা বলেন। তাদের দোকানে আসা মার্গারেট তো মৌনতাকে নিজের নাতনি বলে পরিচয় দেন। সবাইকে বলেন, মৌনতা ইজ মাই গ্র্যান্ড ডটার।

নাবিদ বা জুঁই দুজনই দোকান ও সংসারের আনুষঙ্গিক কাজ নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে। তাই এলিরা স্মিথের সঙ্গে তাদের খুব একটা কথা হয় না। কিন্তু মৌনতার প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। মৌনতা সব সময় দোতলার কাঠের ডেকের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এলিরা স্মিথের বাড়ির দিকে মুখ করে যত দূর সম্ভব গলাটা বাড়িয়ে বলে, হ্যালো মিসেস এলিরা, আজ আমাকে কী রঙের ফুল দেবে?

এলিরা স্মিথ হয়তো বলবেন, আজ আমি তোমাকে সাদা গোলাপ দেব।

মৌনতা তখন মাথা নেড়ে বলবে, না না, আজ আমি সাদা গোলাপ নেব না। তুমি আমাকে লাল গোলাপ দেবে।

এলিরা স্মিথ তখন লাল গোলাপই নিয়ে আসেন। কখনো কখনো তিনি রং-বেরঙের ললিপপ, কখনো ছোট ছোট খেলনা, কখনো বা বাসায় বানানো কেক নিয়ে আসেন। মাঝেমধ্যে ঝুড়ি ভর্তি স্ট্রবেরিও নিয়ে আসেন।

নাবিদ ও জুঁই শত ব্যস্ততার মধ্যেও কখনো বাসায় ভালো কিছু রান্না করলে তারা একটা প্লেটে পরিমাণমতো ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন তরকারি সাজিয়ে এলিরা স্মিথকে দিয়ে আসে। এলিরা স্মিথ প্লেট ভর্তি এসব ভাত ও তরকারি সাজানো দেখে কী যে খুশি হন!

নাবিদ বসা থেকে গলা বাড়িয়ে আরও ভালো করে এলিরা স্মিথের বাসাটা দেখার চেষ্টা করল। এমনিই। এলিরা স্মিথ আজ বাগানে কাজ করছেন না। তিনি প্রায় প্রতি রোববারেই সকালে গির্জায় গিয়ে দুপুরের শেষে ফেরেন। তিনি আজও নিশ্চয়ই গির্জায় গেছেন? তিনি গির্জায় গেলে কুকুরটা ঘরে শেকল দিয়ে বেঁধে আটকে যান। অন্য কোনো শহর বা দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে তিনি জুঁই বা নাবিদকে ঘরের চাবিটা দিয়ে কুকুরটার খাবার দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে যান।

এলিরা স্মিথের বাসার দিকে তাকিয়ে থেকে নাবিদ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। মৌনতা কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি।

মৌনতা আদু আদু গলা করে বলল, বাবা, বাবা দেখ, বেবি ডলটা কী পাজি!

নাবিদ এলিরা স্মিথের বাসা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মৌনতার দিকে তাকাল। চেয়ারের পেছন ছেড়ে মৌনতার দিকে একটু ঝুঁকে বসে জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছে?

মৌনতা বলল, দেখ না বাবা, পাজি বেবি ডলটা একটা চোখ খুলছে তো আরেকটা চোখ খুলছে না। কেমন এক চোখে তাকায়।

নাবিদ হাত বাড়িয়ে মৌনতার হাত থেকে পুতুলটা নিল। পুতুলটার সাদা ধবধবে চেহারায় নীল চোখের ওপর সোনালি পাপড়ি। মাথার চুলগুলোও সোনালি। পরনে আঁশ ওঠা সোনালি সুতোয় কাজ করা সাদা লং স্কার্ট। স্কার্টের ওপর টপসটাও একই রঙের। সাদার ওপর সোনালি সুতোর কাজ।

নাবিদ দেখল, সত্যিই পুতুলটাকে যখন শুইয়ে দেওয়া হয়, ওটা দুটো চোখ ঠিকই বন্ধ করে। কিন্তু যখন ওটাকে দাঁড় করানো হয়, তখন শুধু বাম চোখটার পাপড়ি খোলে। ডান চোখটার পাপড়ি খোলে না।

নাবিদ বুঝতে পারল, যেকোনো কারণেই হোক মৌনতা তার নখ দিয়ে পুতুলটার ডান চোখ খুঁচিয়েছে। প্রায় নয়-দশ মাস আগে মৌনতার পঞ্চম জন্মদিনে জুঁই ও সে পুতুলটা কিনে দিয়েছিল। টয় ওয়ার্ল্ড থেকে পুরো এক শ ডলার দিয়ে এই পুতুলটা তারা কিনেছিল। প্রথমে পুতুলটার সুইচ অন করলেই মিউজিক বাজিয়ে ড্যান্স করত। এখন এর কিছুই করে না। এত দিন পুতুলটা চোখ দুটো মেলত ও বুজত। কিন্তু আজ আবার একটা চোখ কাজ করছে না।

নাবিদ পুতুলটা মৌনতার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, তোমার এই বেবি ডলটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

: কী, চোখের ডাক্তারের কাছে?

: হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। চোখের ডাক্তারের কাছে।

: তুমি যে ডাক্তারকে চোখ দেখিয়েছ, সেই চোখের ডাক্তারের কাছে?

: হ্যাঁ, সেই চোখের ডাক্তারের কাছে।

: ডাক্তার উইন্সটন?

: হ্যাঁ, তার কাছে। তুমি তার নাম মনে রেখেছ?

: হ্যাঁ বাবা, আমি সবার নাম মনে রাখি। তোমার চোখের ডাক্তার, ড. উইন্সটন। আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার, ডা. স্প্রে। আমাদের বিজনেস লইয়ার উইলিয়াম থমসন। আমাদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট মিসেস প্রিয়া পাতিল...!

নাবিদ মৌনতাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, হয়েছে, হয়েছে, তোমাকে আর নাম বলতে হবে না।

মৌনতা জিদ দেখিয়ে বলল, না বাবা, আমাকে নামগুলো বলে শেষ করতে হবে তো।

: আহা, মৌনতা। বলছি, তোমাকে আর নাম বলতে হবে না।

: তুমি খুব মিন বাবা!

: পাকনা মেয়ে, বাবাকে মিন বলতে নেই। তুমি ওদের নাম কেন মনে রেখেছ?

: আমার প্রয়োজন পড়বে যে!

: কেন প্রয়োজন পড়বে?

: আমি বড় হলে তো তোমাদের সঙ্গে থাকব না, তাই এখন থেকে ওদের নামগুলো মনে রাখছি।

: কী বল এসব! নাবিদ চোখ বড় করে মৌনতার দিকে তাকাল।

মৌনতা বলল, বাবা, তুমি চোখ বড় করে তাকাবে না। আমি সত্যি বলছি।

নাবিদ জিজ্ঞেস করল, কী সত্য বলছ?

: আমি সত্যি বড় হলে তোমাদের সঙ্গে থাকব না।

: কেন থাকবে না?

: বিকজ, আই উইল নিড সাম প্রাইভেসি!

: তোমাকে কে বলেছে যে তোমার প্রাইভেসির প্রয়োজন হবে?

মৌনতা ভাব নিয়ে বলল, কেউ বলেনি। আমিই বলছি। এভরি বডিজ নিড প্রাইভেসি।

নাবিদ বলল, দেখ মৌনতা, এসব পাকামো করবে না। আই ডোন্ট লাইক ইট!

: আই ডোন্ট কেয়ার বাবা। আমি ট্রু বলছি। তুমি তো তোমার বাবা-মার সঙ্গে থাক না।

: তারা তো বাংলাদেশে, তাই।

: মিসেস এলিরার সঙ্গেও তো তার চিলড্রেনরা থাকে না?

নাবিদ এবার গম্ভীর হয়ে গেল। তবে সে যে মৌনতার দিকে রাগ করে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকাল, তা নয়। তার ভেতর একটা অবাক করা সত্য এসে ভিড় করল। এখনো ছয় বছর হয়নি এমন একজন মেয়ে, তাদের মৌনতা এখনই তার ভবিষ্যতের প্রাইভেসি নিয়ে চিন্তা করছে। এ দেশের বাবা-মার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক ও সামাজিক ব্যবস্থাটা কীভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে...!

নাবিদকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মৌনতাও কী ভেবে চুপ হয়ে গিয়ে নাবিদের হাত থেকে বেবি ডলটা নিয়ে খেলতে শুরু করল।

সাধারণত মৌনতা একটা কথা এখন বললে কিছুক্ষণ পরই তা ভুলে যায়। একটা প্রসঙ্গ থেকে অন্য আরেকটা প্রসঙ্গে চলে যায়। কিন্তু এখন সে ভুলল না। সে বেবি ডলটাকে দাঁড়া করিয়ে বলল, বাবা, বাবা এখনো দেখ, বেবি ডলটা একটা চোখ খুলছে না। বাবা, তুমি কখন বেবি ডলটাকে ডাক্তার উইন্সটনের কাছে নিয়ে যাবে?

নাবিদ বলল, তুমি যখন বলবে।

: অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেবে না?

: হ্যাঁ, হ্যাঁ, অ্যাপয়েন্টমেন্টও নেব।

: বাবা, তুমি এখনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাও।

: ঠিক আছে, আমি এখনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেব।

: তাহলে আমি তোমার কাছে মোবাইলটা নিয়ে আসি?

: আচ্ছা, মোবাইলটা নিয়ে আস।

: না, থাক বাবা, আমি কর্ডলেসটা নিয়ে আসি।

নাবিদ বলল, আচ্ছা, কর্ডলেসটাই নিয়ে আস।

মৌনতা দৌড়ে বাসার ভেতর চলে গেল। নাবিদ মৌনতার যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজে নিজেই হাসল। তারপর কী ভেবে হাত দুটো ঘাড়ের পেছনে দিয়ে শরীরটা আবার চেয়ারে ছেড়ে দিল। তার দৃষ্টি দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে দিকে গেল।

আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ। গুচ্ছ মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের নীলটা এত স্পষ্ট যে নীল রংটা চোখকে নরম করে দেয়। নাবিদ আকাশ দেখতে দেখতে দৃষ্টিকে চারপাশ করল।

তার বাসার মাত্র বিশ-পঁচিশ মিটার দূর দিয়ে ঝরনাটা বয়ে গেছে। ঝরনার দুই পাশে অনেক গাছ। পপলার, ক্যাবেজ, মেহগনি, পাইন, ম্যাপল বা ওক গাছ তো আছেই। বিভিন্ন গাছ থেকে অনেক স্বর্ণলতাও ঝুলে আছে। ঝরনার ওপাশে একটা বড় পার্ক। একটা মাউরি উপাসনালয়। যেটাকে মারাই বলা হয়। মাঝেমধ্যে সেই মারাইতে রাতভর মাউরি সংগীত হয়। মাউরিদের বাঁশি বাজানো যে কত সুন্দর! পাহাড়ি সংগীতের একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

ঝরনাটার ওপাশে পার্কের গাছগুলোতে অসংখ্য পাখির বাস। দিন নেই রাত নেই শুধু পাখির ডাক, কিচিরমিচির, কিচ কিচ, কিচিরমিচির। টউব টউব, টুব টুব, টউব টউব। ডুব ডুব, ডউব ডউব, ডুব ডুব। টুইট টুইট, টুইট টুইট।

নাবিদ এ মুহূর্তে ঝরনার ধারে একটা গাছের ঝুলে থাকা ছোট্ট ডালে মাছরাঙা পাখি দেখল। মাছরাঙাটা ঝরনার স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটা ছোট ছোট মাছ শিকারের অপেক্ষায় বসে আছে। মাছরাঙাটার নিস্তব্ধ অনড় দৃষ্টি।

নাবিদের দৃষ্টিও মাছরাঙাটার ওপর স্থির হয়ে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ মাত্র। জুঁই ব্যালকনিতে এসে ডাকল, এই যে সাহেব, এত মনোযোগ দিয়ে পার্কে কী দেখছেন?

নাবিদ জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, জি সাহেবা, আমি পার্কে কোনো মেয়ে দেখছি না। আমি মাছরাঙা পাখিটা দেখছি।

জুঁই বলল, সেই ভালো। মাছরাঙা, ময়ূরী, কইতরি সবই দেখ। কিন্তু কোনো মেয়ের দিকে তাকাবে না।

নাবিদ বলল, তুমি এত সুন্দর। আমি কোন দুঃখে অন্য মেয়ের দিকে তাকাব?

জুঁই পাশের একটা অ্যালুমিনিয়াম চেয়ারে বসতে বসতে বলল, সেই ভালো। কিন্তু আমি পুরুষ মানুষ চিনি। ওরা ভেড়ার মতো সবকিছু দেখলেই হা করে।

: ভেড়া নয়, ছাগল। কথায় আছে, ছাগলে কী না খায়!

: ভেড়া আর ছাগল একই প্রজাতির।

: মোটেও না।

: তোমার সঙ্গে তর্ক করতে যাবে কে? এই যে, তোমার জন্য চা আর সমুচা ভেজে নিয়ে এসেছি। খাও। বোনের জন্য অপেক্ষা করে কতক্ষণ খালি পেটে বসে থাকবে?

নাবিদ খুশি হয়ে বলল, বাহ, বেশ করেছ। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: