সবুজ মেঘের ছায়া-তিন

নাবিদ জুঁইকে নিয়ে মাঝেমধ্যে কাঠের ডেকে বসে জ্যোৎস্না দেখে। জ্যোৎস্নার চাদর বিছানো রাতে রাত পাখির ডাক শোনে টুব টুব, টুউব টুউব, টুব টুব।

জুঁইয়ের গানের গলা বেশ ভালো। কখনো কখনো জুঁই জ্যোৎস্নার এই মনোরম আবহের সঙ্গে মিহি সুরে গান ধরে। নাবিদ তখন মুগ্ধ হয়ে শোনে।

নাবিদ ও জুঁই খানিকক্ষণ আগে বাসার পেছনের কাচের ব্যালকনিতে বসে ছিল। কিন্তু সূর্যটা খানিকটা পশ্চিমে হেলতেই রোদটা যখন সরাসরি ব্যালকনিতে এসে পড়ছিল, তখন দুজনই বাসায় ঢুকে যায়। শুধু রোদের কারণেই যে ওরা বাসার ভেতর ঢুকেছিল, তা নয়। জুঁই একটার আগেই রান্নাবান্না শেষ করে ফেলেছে। নদী আজ প্রথম আসবে বলেই জুঁই বিশেষ কিছু রান্না করেছে। রান্না করার আগে অবশ্য নাবিদ জুঁইকে ধোয়াধুয়ির কাজে সহযোগিতা করেছে। নাবিদ মাঝে আরেকবার গিয়ে সালাদও কেটে দিয়ে এসেছে।

নাবিদ এখন বাসার পেছনের ব্যালকনিতে না বসে বাসার উত্তরে বেশ বড় করে বানানো কাঠের ডেকটাতে এসে বসেছে। কাঠের ডেকের ওপরও একটা আউট ডোর সেটিং আছে। তবে ব্যালকনির আউট ডোর সেটিংটা যেমন অ্যালুমিনিয়ামের, ডেকেরটা তা নয়। ডেকেরটা কাঠের। নাবিদ কাঠের ডেকের সঙ্গে মিলিয়ে আউট ডোর সেটিংটাও কাঠের কিনেছে। অবশ্য এ সবকিছু জুঁইয়ের পছন্দ অনুযায়ী কেনা।

কাঠের ডেকটা থেকেই এলিরা স্মিথের বাসাটা স্পষ্ট দেখা যায়। এলিরা স্মিথের বাসার পেছনের বাগানটাও রাকিবের বাসার ডেকের একেবারে গা ঘেঁষে। মাঝখানে শুধু একটা কাঠের বেড়া। উত্তর হ্যামিল্টনের গ্লেন ভিউ সাবার্বে নাবিদ ও এলিরা স্মিথের বাড়িটা প্রায় শহরের শেষ সীমানায়। এ জন্যই একটা গ্রামীণ আবহে বাড়ির পাশে একটা ঝরনা বয়ে গেছে ও একটা বিস্তৃত পার্ক বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে। নাবিদের বাড়ির একটা বাড়ির পর বিস্তৃত খামার। অনেক দূরে দূরে কৃষকের বাংলো।

নাবিদ সময়টা আন্দাজ করার চেষ্টা করল। তার হাতে ঘড়ি নেই। মোবাইলটাও সে ভেতরে রেখে এসেছে। তবে দুটোর মতো মনে হয় বেজে গেছে।

নাবিদ ভাবল, নদীর তো দুটোর আগেই আসার কথা। কিন্তু নদী এখনো আসছে না কেন? মোবাইলটা হাতে থাকলে এখনই একটা ফোন দিত। তারা একসঙ্গে দুপুরে খাবে বলে নদীর অপেক্ষায় বসে আছে। যদিও তার এখন তেমন একটা ক্ষুধা নেই। খানিকক্ষণ আগে জুঁইয়ের সঙ্গে সে বেডরুমের পাশের ব্যালকনিতে বসে সমুচা আর চা খেয়েছে।

নাবিদ আবার সূর্যটা দেখে সময়টা আন্দাজ করার চেষ্টা করল। ঠিক তখনই জুঁই এল। পেছনে পেছনে মৌনতাও এল। মৌনতা বেশ আগেই কর্ডলেস টেলিফোন সেটটার কথা ভুলে গেছে। সে এমনই।

জুঁই পাশের একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, খাবারদাবার তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কই, তোমার বোন তো এখনো এল না?

নাবিদ বলল, আমিও তাই ভাবছি।

: একটা ফোন দাও।

: একটা ফোন দিলে ভালো হয়। পথে আবার কোনো সমস্যা হলো কিনা। বলেই নাবিদ মৌনতাকে বলল, মৌনতা যাও তো, ভেতর থেকে মোবাইলটা নিয়ে আস।

জুঁই বলল, তুমি তাকে পাঠাচ্ছ? দেখবে সে ভেতরে গিয়ে বেমালুম ভুলে গেছে।

নাবিদ হাসল। বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। তাহলে তুমি যাও?

জুঁই একটা ঝামটি মেরে বলল, তোমার সাহস তো কম না? আমি এতক্ষণ রান্না করে শেষ করে এলাম। এখন একটু ফ্রি হয়েছে। তুমি আমাকে এখন অর্ডার দিচ্ছ তোমার মোবাইলটা এনে দিতে? যাও, তুমি যাও। তুমি নিজে গিয়ে ভেতর থেকে নিয়ে আস।

নাবিদ আবার হাসল। এবার সে হাসল একটু বোকার মতো, হে হে, হে হে! বলল, আচ্ছা।

মৌনতা ব্যস্ত হয়ে বলল, বাবা, আমি নিয়ে আসি। বলেই সে দৌড়ে ডেক ছেড়ে বাসার ভেতর গিয়ে ঢুকল।

নাবিদ মৌনতার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। জুইও।

মৌনতা এবার ঠিকই মোবাইলটা নিয়ে এল।

জুঁই একটু চোখ বড় করে তাকাল।

নাবিদ জুঁই ও মৌনতার দিকে তাকিয়ে একটু রহস্যের হাসি হাসল। সে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিল। মোবাইলে নদীর নম্বর সেভ করাই আছে। সে নদীকে ফোন দিল।

তৃতীয়বার রিং বাজার আগেই নদী ওপাশে ফোন ধরল।

নাবিদ জিজ্ঞেস করল, নদী, তুমি কোথায়? আর কতক্ষণ লাগবে?

নদী বলল, সরি ভাইয়া, আমি হ্যামিল্টন ইস্ট থেকে গ্লেন ভিউর সরাসরি বাসটা একটুর জন্য মিস করেছি। এখন সিটি হয়ে বাস চেঞ্জ করে গ্লেন ভিউতে আসছি। আর বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। এখন হাসপাতালের পাশে আছি। আর বড়জোর সাত-আট মিনিট লাগবে।

: তুমি বাস মিস করেছ আমাকে ফোন দিলেই পারতে। আমি গাড়ি নিয়ে গিয়ে তোমাকে হ্যামিল্টন ইস্ট থেকে পিক করে নিয়ে আসতাম।

: সরি ভাইয়া, ওটা মাথায় আসেনি।

: তুমি কেন যে বাস ধরার কথা বললে? ওটা সহজ ছিল না, আমি যদি তোমাকে সরাসরি নাজমুল ভাইয়ের বাসা থেকে পিক করে নিয়ে আসতাম?

: জি ভাইয়া, ওটা সহজ ছিল। কিন্তু আমাকে যে হ্যামিল্টন ইস্টে আমার এক স্যারের বাসায় যেতে হয়েছে?

নাবিদ বলল, হুম, আচ্ছা আস। তোমার ভাবি রান্না করে বসে আছে। আমিও তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।

নদী বলল, জি, এই তো। আর বেশিক্ষণ লাগবে না।

নাবিদ লাইন কেটে দিল। মোবাইলটা সামনের টেবিলের একপাশে রাখতে রাখতে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নদী এসে গেছে প্রায়। এখন হাসপাতালের পাশে আছে।

জুঁই মাথা ঝাঁকাল। এক মুহূর্ত কী ভেবে বলল, শোনো, আমি বুঝতে পারছি না এ মুহূর্তে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা।

নাবিদ জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

: নদীর সম্বন্ধে। সে আসার আগেই বলে রাখি।

: নদীর সম্বন্ধে কী কথা?

: তুমি কথাটা অন্যভাবে নিয়ো না, প্লিজ।

: আহা, বলবে তো।

: তুমি আবার নদীকে বলে বসো না যে আমাদের বাসায় থেকে যেতে।

: এটা আবার কী কথা? নদীর যদি থাকতে ইচ্ছে করে থাকবে। সে আমার রাজীব চাচার মেয়ে। আমাদের বাসার দুই রুম তো খালি পড়ে আছেই।

: এমনি যদি একদিন-দুই দিন বেড়ানোর জন্য থাকে, অসুবিধা নেই। আমি তার পারমানেন্টলি থাকার কথা বলছি।

: নদী পারমানেন্টলি আমাদের বাসায় থাকবে, ওটা তোমাকে কে বলেছে?

: কেউ বলেনি। আমি নিজ থেকেই বলছি। আমাদের সংসারে প্রাইভেসি বলতে একটা কথা আছে। একজন বাইরের মানুষ থাকলে সেই প্রাইভেসিটা আর থাকবে না।

: সে বাইরের মানুষ হতে যাবে কেন?

: সে তো তোমার আপন বোন নয়? আপন চাচাতো বোনও নয়?

: সে আমাদের চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। তবে জুঁই, তোমাকে একটা কথা বলি, নদী আমার রাজীব চাচার মেয়ে। রাজীব চাচা একটা সামান্য কারণে জেদ ধরে চৌধুরী বাড়ি থেকে নতুন বউ নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ইচ্ছে করলে একটু সমঝোতা করে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেননি। নদী তো তারই মেয়ে। আমার বিশ্বাস, সে নিজ থেকে আমার বাসায় কখনো থাকতে বলবে না। তোমার চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আর...!

জুঁই জিজ্ঞেস করল, আর কী?

নাবিদ বলল, থাক, তোমাকে ও কথা বলে লাভ নেই। তোমার সঙ্গে সংসার করছি চৌদ্দ বছর ধরে। আমি তোমাকে চিনি তো। নদী প্রথম আমার বাসায় আসছে। আমি এ মুহূর্তে কোনো ঝগড়াঝাঁটি চাই না।

জুঁই কিছু বলল না। চুপ হয়ে গেল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>