প্রথম আলোর সাথে বিশ বছর

তখন পর্যন্ত রশীদ হলে আমাদের ফ্লোরে পত্রিকা হিসেবে দৈনিক ইত্তেফাক রাখা হতো। কারণ ইত্তেফাকে চাকরির ও টিউশনির বিজ্ঞাপন থাকে, যেগুলো আমরা যারা ছাত্র এবং যারা ছাত্রত্ব থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তাদের জন্য খুবই দরকারি। তবে টিভিতে কয়েক দিন ধরে নতুন একটা পত্রিকা বাজারে আসার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। হলের টিভি রুমে ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে আমরা যারা একটু জুনিয়র তারা ফ্লোরের সিনিয়রদের কাছে বায়না ধরলাম, এখন থেকে ফ্লোরে প্রথম আলো রাখার জন্য। শুরুতে তারা একটু গাঁইগুঁই করলেও পরে রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত ছিল ভালো না লাগলে সেটা বেশি দিন রাখা হবে না। এভাবেই প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। বলাই বাহুল্য পরবর্তীতে ফ্লোরে প্রথম আলোকেই বেছে নেওয়া হলো পত্রিকা হিসেবে।

প্রথম আলোর সবকিছুই ভালো লাগত তবে কিছু কিছু পাতা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যেত ফ্লোরে। আমাদের উইংয়ে ২০১ থেকে ২০৬ মোট ছয়টি কক্ষ। তারপর সিঁড়ি, সিঁড়ির অন্যপাশে অন্য উইং। আমাদের এই ছয়টা কক্ষের প্রতিটা কক্ষে চারজন করে মোট চব্বিশজন ছাত্র থাকেন। আর পত্রিকা মাত্র একটা, তাই পেপার নিয়ে একটু টানাহেঁচড়া হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে একেকজনের একেকটা বিষয় পছন্দ হওয়াতে ঝামেলা একটু কমত। দোলা ভাই ছিলেন আমাদের ফ্লোরের খেলার অভিধান। খেলার পাতা তাই সবার আগে ওনার হাতে। আমার পছন্দ হচ্ছে শনিবারের বিশেষ সংযোজন ‘ছুটির দিনে’। বিশেষ করে ছুটির দিনের চিঠিপত্র অংশে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার লেখাগুলো আমাকে খুবই টানে। আর শিল্প সাহিত্য পাতার পাশাপাশি সম্পাদকীয় পাতাতে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কলাম। সবার পড়া হয়ে গেলে দিন শেষে আমি জাফর ইকবাল স্যারের কলামগুলো পেপারের গাদা থেকে বের করে আমার বিছানার নিচে আলাদা করে রেখে দিতাম।

শনিবারের ছুটির দিনে আমার বন্ধু পাভেলের একটা লেখা ছাপা হয়েছিল আমাদের কলেজের এক স্যারের প্রসঙ্গে। লেখাটার শিরোনাম ছিল ‘স্যার বলতে লজ্জা লাগে’। তখন লেখাটা কুষ্টিয়াতে আমাদের সহপাঠী, অভিভাবক ও শিক্ষক মহলে অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ওর সেই লেখা পরে উৎসাহিত হয়ে কতবার ভেবেছি, আমার নিজেরও কলেজজীবনের স্মৃতি নিয়ে একটা লেখা লিখে প্রথম আলোতে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। শুক্রবারের শিল্প সাহিত্য পাতার আমি মোটামুটি নিয়মিত পাঠক। বিশেষ করে বিদেশি লেখার অনুবাদগুলো এখনো নিয়মিত পড়ি। আর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই শিল্প সাহিত্য পাতার বইয়ের তালিকা ধরে একদিন চলে যেতাম বইমেলাতে বই কিনতে। এ ছাড়া, বাজারে কী নতুন বই আসছে সেটা শিল্প সাহিত্য পাতা থেকে জানি। এখন আর যেহেতু নিজে বইমেলাতে যেতে পারি না, তাই কেউ দেশে গেলে তাকে তখন সেই বইয়ের তালিকাটা গছিয়ে দিই। এভাবে প্রবাসেও এখন আমার বইয়ের সংগ্রহ বেশ সমৃদ্ধ।

এ ছাড়া, আমরা আনন্দ পড়তাম বড় ভাইদের লুকিয়ে লুকিয়ে। কারণ বড় ভাইয়েরা দেখলে অনেক প্রশ্ন করবে। অবশ্য আনন্দের শেষ পাতায় সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার তালিকা ও রিভিউগুলো ভালো সিনেমা বেছে নিতে অনেক সাহায্য করত। মঙ্গলবারের নকশা আমাদের মধ্যে যারা একটু রূপ সচেতন ছিলেন তারা চুপিচুপি পরে সেই মোতাবেক রূপচর্চা করতেন। বিশেষ করে যারা প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। নকশার পাতা থেকে ডিজাইন দেখে তারা বছরের বিশেষ দিনগুলোতে নিজের ও প্রেমিকার জন্য উপহার কিনতেন। আর বুধবারের সাময়িকীর পাতা সম্পর্ক ঠিক রাখার ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখতেন। তবে আলাদা করে বলতে হবে আলপিনের কথা, যেটা এখন রস‍+আলো নাম নিয়েছে। আলপিনের একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম একাধিকবার আর নিজের অজান্তেই হেসে উঠতাম বারবার। এভাবে প্রথম আলো আমাদের হলজীবনের এক নিয়মিত অংশ হয়ে গিয়েছিল।

এরপর একসময় আমরা কয়েকজন মিলে একটা ব্যাচেলর বাসা নিলাম সেখানেও প্রথম আলোর পদচারণায় প্রতিটা সকাল হতো। তারপর বিয়ে করে সংসারী হওয়ার পর প্রথম আলো আমাদের সংসারের একজন হয়ে উঠেছিল। টেলিকমিউনিকেশনের চাকচিক্যময় চাকরি ছেড়ে যখন বিসিএস দেব বলে আমি আর আমার গিন্নি স্থির করলাম তখন প্রথম আলোর লেখাপড়া পাতা আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে গেল আর আমার স্কুল পড়ুয়া শ্যালিকার হয়ে উঠল গাইড। প্রথম আলো অনলাইন চালু হওয়ার পরও বাসায় আমরা নিয়মিত পত্রিকা রাখতাম। কারণ অনলাইন ভার্সন পড়ে কেন জানি মন ভরে না। আর অনলাইন ভার্সন পড়লেও পড়তাম ই-প্রথম আলো, যেটা দেখতে অবিকল প্রিন্টের প্রথম আলোর মতো।

এরপর একসময় জীবনের তাগিদে অস্ট্রেলিয়াতে প্রবাসী হলাম। তারপরও জীবনের প্রতিটা দিন শুরু হতে লাগল প্রথম আলোর মাধ্যমে। অবশ্য সেটা শুধুমাত্র অনলাইন ভার্সনেই। এই অভ্যাসটা বিশ বছরের পুরোনো ও আশা করি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। প্রথম আলোর মাধ্যমেই আমার যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখির শুরু। আগে শুধু ফেসবুকে পাতায় স্ট্যাটাস আকারে লিখতাম। প্রবাসী হওয়ার পর দেশের প্রতি অনুভূতি নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম ফেসবুকের পাতায়। সবাই সেটা পড়ার পর বলল, কেন আমি প্রথম আলোতে পাঠাই না? সেই প্রথম শখের বশে প্রথম আলোতে লেখা পাঠানো। তারপর পার হয়েছে অনেক সময়। একসময় পরিচয় হলো দূর পরবাস পাতার সম্পাদকের সঙ্গে। তার উৎসাহ ও উপদেশে লেখার গুণগতমানের অনেক সৌন্দর্য বৃদ্ধি ঘটেছে। একসময় স্বপ্ন দেখতাম প্রথম আলোতে লিখব এখন সেটা সম্ভব হয়েছে ভাবতেই অবাক লাগে।

আমার মেয়ে তাহিয়াও হয়তো জিনগতভাবেই লেখালেখির অভ্যাসটা পেয়েছে। সেই সঙ্গে পেয়েছে আউট বই পড়ার অভ্যাস। দিনের বেশির ভাগ সময়ই সে আউট বই পড়ে পার করে। অবশ্য তার জন্য অনেক বকুনিও হজম করতে হয় তাকে। আমি একদিন তাকে বললাম, একটা বই পড়ে তোমার যা মনে আসে তাই লিখে ফেল। তাহিয়া বলল আমিতো ভালোমতো পারি না। আমি বললাম, কী যে বল, তুমি হলে লেখকের মেয়ে। সে জিজ্ঞেস করল কিন্তু তোমার তো বই বের হয়নি। আমি আমার বন্ধুদের বলেছি তুমি লেখক, তখন তারা তোমার বই দেখতে চেয়েছে। আমি বললাম আমি অনলাইনে লিখি। তখন সে জানতে চাইল আমি কোন পত্রিকায় লিখি। তখন আমি বললাম প্রথম আলোতে। এভাবেই প্রথম আলো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে পাঠক প্রিয়তা পাচ্ছে। প্রথম আলোর বিষয়ে আমি সব সময়ই যে কথাটা বলে এসেছি সেটা হলো, বিভিন্ন রাজনৈতিক বোধের মানুষ বিভিন্ন পত্রিকা পড়েন। কিন্তু সেই খবরটার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য দিন শেষে ঠিকই একবার প্রথম আলোতে চোখ বুলিয়ে নেন। প্রথম আলোর বিশ বছর পূর্তিতে একজন নিবিড় পাঠক হিসেবে অনেক অনেক সাধুবাদ ও শুভাশীষ রইল। আশা করি প্রথম আলো ভবিষ্যতেও তার এই ধারা অব্যাহত রাখবে।
...

মো. ইয়াকুব আলী: মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>