প্রবাসীর বিলাসিতা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বিদেশে এসে একসময় স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া প্রবাসীরা এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকেন জীবনের বাকি দিনগুলো। বিদেশে আসার পর শুরুতে প্রত্যেকে অনেক কষ্ট করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর যখন আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিজের অবস্থান শক্ত হয়ে যায় তখন শুরু করেন বিলাসিতা। তবে সেই বিলাসিতা একটু অন্য ধরনের। বিদেশে আসার পর যখন আর্থিক দুশ্চিন্তা আর থাকে না, তখন তারা নিজেদের জীবনাচরণে বিরক্তি বোধ করা শুরু করেন। জীবন হয়ে পড়ে একঘেয়ে। এই একঘেয়ে জীবনে বিনোদনের জন্য তারা শুরু করেন বিভিন্ন সেবামূলক কাজ। আর সে কাজ আদতে কতখানি সেবামূলক আর কতখানি লোক দেখানো সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি।

প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশে নাম সর্বস্ব নানা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে। তারা বিভিন্ন দাতব্য কাজের কথা বলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে সেই অনুষ্ঠান থেকে অর্জিত অর্থ দেশের অমুক সেবায় কাজে লাগানো হবে। আদতে কতখানি কাজে লাগানো হয় তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অবশ্য কেউ কেউ অন্তরের তাগিদেই এমন অনুষ্ঠান করেন এবং অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থের পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দেন। আবার কেউ কেউ দেশে গিয়ে যে টাকাটা দান করেছেন সেই টাকা হস্তান্তরের ছবিকে কভার ফটো বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেখে দেন দিনের পর দিন। তখন আপনার মনে হতেই পারে যে তিনি হয়তো এই ছবিটা তোলার জন্যই টাকাটা দান করেছেন।

কিছু কিছু সংগঠন বছরব্যাপী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। সেখানে বলা হয় নতুনদের সাহায্য করা হবে। কিন্তু একজন নতুন মানুষ বিদেশে এলে তার আসলে কী–কী দরকার হতে পারে সে বিষয়ে তারা কোনো প্রকার সাহায্য না করে নিজেদের কী–কী আছে সেটা দেখাতেই তারা ব্যস্ত থাকেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁরা নিজেরাও কিন্তু কিছুদিন আগেও এমন অবস্থায় ছিলেন। সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে এমন ভাব দেখাতে থাকেন যেন বিদেশে থাকেন তারা অনেক পুরুষ ধরে। অবশ্য কথায় কথায় বলেন যে, তারাও এমন অবস্থা পার করে এসেছেন। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এমন কোনো দিক নির্দেশনা তারা দেন না। একের পর একটা আয়োজন করতে থাকেন আর সেটাতে নতুনদের উপস্থিতি কামনা করতে থাকেন। সেই সব আয়োজনে একজন নতুন মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য হয়েই তাকে একসময় সেই সংগঠন ত্যাগ করতে হয়।

এ সব সংগঠনগুলোর মধ্যে কিছু আছে যেগুলো সারা বছর কোনো প্রকার কাজ করে না। কিন্তু বছর শেষে দেশ থেকে শিল্পী নিয়ে আসে কনসার্টের জন্য। আর শিল্পীর সঙ্গে আসে আরও কিছু মানুষ যারা আর পরবর্তীতে দেশে ফিরে যান না। অবশ্য এই অবস্থার এখন পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু শিল্পী আনা থেমে নেই। কে কত বড় মাপের শিল্পী আনতে পারল সেটা নিয়েও চলে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। এমনও দেখা গেছে, একই দিনে একাধিক সংগঠনের অনুষ্ঠান থাকে। তখন মানুষ দ্বিধায় পড়ে যান, কোনটাতে যাবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। শিল্পী আনার পর সেই শিল্পীকে বসিয়ে রেখে স্থানীয় ভুঁইফোড় শিল্পীরা একের পর এক পরিবেশনা উপহার দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আমন্ত্রিত অতিথিদের শোরগোলে আসল শিল্পীকে মঞ্চে পাঠানো হয়। তারপরও তার সঙ্গে এখানকার কোনো না কোনো শিল্পীকে লেজুড় হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়। এই সব লেজুড়ের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় বিনোদন হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। প্রবাস জীবনে যেহেতু উত্থান-পতনের সুযোগ খুবই কম তাই জীবন থেকে ঋণাত্মক বিশেষণগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। আর ঋণাত্মক বিশেষণের অভাবে ধণাত্মক বিশেষণগুলোও অবধারিতভাবে ফিকে হয়ে যায়। তখন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে প্রবাসীরা আলোচনা সমালোচনা করে সময় কাটান। চায়ের কাপে, দাওয়াতে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবচেয়ে মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের রাজনীতি। আর যদি এর সঙ্গে কোনো প্রকার চলমান ঘটনা যোগ হয় তখন তো খাওয়া ঘুম হারাম করে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটার শেয়ার দিয়ে চলা। যদিও তাদেরকে কোনোভাবেই রাজপথে পাওয়া সম্ভব না তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করে রাখেন ইটারেস্টেড ও গোয়িং ইত্যাদি দিয়ে।

প্রবাসে আসলে দেশপ্রেম বেড়ে যাওয়ার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা দেখা যায়। তবে সেটা সবার জন্যই দেশপ্রেমের বিষয় না। বিষয়টা এমন দেশে থাকলে পায়ের ওপর পা তুলে বসে খেতাম। আশপাশে একদল কাজের লোক থাকত। পূর্বপুরুষের অমুক ছিল, তমুক আছে। আমি নিজে অমুক বড় চাকরিতে ছিলাম। এই বিষয়গুলো তাদের পোড়ায়। সেটাকেই তারা দেশপ্রেমের প্রলেপ দিয়ে প্রচার করেন যে দেশের জন্য তার পরানডা পুড়ে যাচ্ছে। আসলে দেশে থাকতে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী ছিলেন, এখানে এসে সেটা করতে পারছেন না বলে হীনমন্যতায় ভোগা। অবশ্য সুযোগ পেলে বিদেশেও তারা বিভিন্ন প্রকারের সুবিধা নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না।

বাংলাদেশিদের একটা চিরায়ত ভ্রান্ত ধারণা হলো, কেউ বিদেশে যাওয়া মানেই সে সেই দেশে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করেন। ভালো থাকেন, এমনকি টাকার বিছানায় ঘুমান। রূঢ় বাস্তবতা ঠিক এর উল্টো। আপনি যে কারণেই দেশ ছাড়েন না কেন বিদেশে একটা অজানা অচেনা স্বজনহীন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াটা আসলেই কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভবও। দেশের মতো বিভিন্নভাবে ছলচাতুরীর মাধ্যমে টাকা আয় করার সুযোগ বিদেশে একেবারে নেই বললেই চলে। তাই কাজ না করলে টাকা উপার্জনের অন্য কোনো রাস্তা নেই। আর সেই টাকা দিয়ে নিজে এবং পরিবারের লোকদের চালিয়ে নিয়ে টাকা জমানো আসলেই অসম্ভব একটা সময় পর্যন্ত। সম্ভব যদি তিনি মানবেতর জীবনযাপন করেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানবেতর জীবনযাপন করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শো-অফ করেন তিনি আপনি প্রচণ্ড আরাম আয়েশে আছেন। কারণ দেশে থাকা তার আত্মীয়পরিজন এমন ধারণাই পোষণ করেন এবং সেটা পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে বলেও বেড়ান।

বিদেশে এসেও পোশাকের তুলনা, বাড়ি-গাড়ির তুলনা আর সর্বোপরি ছেলেমেয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনা থেকে তারা বের হতে পারেন না। পোশাকের ক্ষেত্রে কারটা কোন দেশ থেকে এসেছে সেটা নিয়ে শুরু হয় বিলাসিতা। বাড়ি-গাড়ির ক্ষেত্রে সংখ্যা ও ব্র্যান্ডের পাশাপাশি কোনটা পুরোনো কোনটা নতুন সেটা নিয়েও চলে বিলাসিতা। আর ছেলেমেয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে বিলাসিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। প্রাইভেট না পাবলিক সেটা নিয়ে চলে গালগল্প। স্কুলে কার বাচ্চা কয়টা অ্যাওয়ার্ড পেল সেটা নিয়েও চলে তুলনা। এতে করে কম অ্যাওয়ার্ড পাওয়া বাচ্চার অভিভাবক স্বভাবতই তার নিজের বাচ্চার ওপর রুষ্ট হন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে বাচ্চারাই বরং অভিভাবকদের সান্ত্বনা দেয়। প্রায় প্রত্যেক বাচ্চায় হয়তোবা কোচিংয়ে যায় অথবা বাসায় প্রাইভেট পড়ে—নিজের মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করার কাজে লেগে পড়ে নিজের ভালো না লাগলেও। এমনকি দিনে দিনে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে বাচ্চারা একই সঙ্গে দুটি কোচিং সেন্টারে যাওয়ার পাশাপাশি বাসায় আসা একাধিক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু অভিভাবকের সেদিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়।

তবে ইদানীংকালে প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় বিলাসিতার নাম হচ্ছে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা। অবশ্য সেটা শুধুমাত্র অনলাইনেই। হাতেগোনা কিছু ছাপা সংবাদপত্র আছে। কিন্তু সেটা চালানো অনেক খরচের বিষয় বলে সবাই ইদানীং অনলাইনের দিকে ঝুঁকছে আর রাতারাতি সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন। সামান্য কিছু ডলার খরচ করলেই একটা অনলাইন সংবাদপত্র খোলা যায়। এরপর নিজেই নিজের খবর নামে বেনামে প্রকাশ করে সাংবাদিকও হয়ে যান। এই সব সংবাদপত্রে আদতে কমিউনিটি বা জাতীয় খবরগুলো তেমন একটা গুরুত্ব পায় না, যতটা নিজের অপছন্দের মানুষদের দুর্নাম বা কুৎসা গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের মতো এখানেও ব্যবসায়ীরা নিজেদের মুখপত্র হিসেবে অবশেষে একখানা অনলাইন সংবাদপত্র বের করে ফেলেন। তারপর সেখানে চলে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নানা রকম দাতব্য কর্মকাণ্ডের ইনিয়ে-বিনিয়ে বর্ণনা। এখানে যারা সাংবাদিক আছেন তাদের খুবই কম জনেরই সাংবাদিকতার পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ডিগ্রি রয়েছে। যার ফলে সাংবাদিকতার ইথিকসের লেশমাত্র তাদের সংবাদপত্র বা সংবাদে দেখা যায় না। আর পেশাদারি মনোভাব নিয়ে যারা ইথিকস বজায় রেখে সংবাদ পরিবেশনের কাজটি করে যাচ্ছেন তাদের অতটা কাটতি না থাকাতে রীতিমতো যুদ্ধ করে বাজারে টিকে থাকতে হচ্ছে।

প্রবাসীর বিলাসিতার প্রশ্ন এলেই সবার আগে যে প্রসঙ্গটা সামনে চলে আসে সেটা হচ্ছে দাওয়াত খাওয়া ও বিনিময়ে দাওয়াত দেওয়া। বিভিন্ন দাওয়াতে গিয়ে তাদের সঙ্গে সেলফি তুলে জানান দেওয়া যে আপনি তাদের সঙ্গে আছেন। কে কয় পদ রান্না করে খাওয়াল সেটা নিয়ে চলে অলিখিত প্রতিযোগিতা। কার হাতের রান্না কত ভালো সেটা নিয়ে চলে গুণকীর্তন। যদিও এখন বেশির ভাগ বাঙালিই খাবার অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসেন বিভিন্ন ক্যাটারিং থেকে। কিন্তু চালিয়ে দেন নিজের হাতের রান্না বলে। কেউ একজনের দাওয়াতে গেছেন কিন্তু অন্যজনের দাওয়াতে যাননি সেখান থেকেই তিনি গ্রুপিংয়ে বিভক্ত হয়ে যাবেন। এখানে যেহেতু সবাই স্বনির্ভর তাই কেউ কারও একটু কথাকেও ছাড় দেন না। যার ফলে দিনে দিনে বেড়ে চলেছে গ্রুপের সংখ্যা। পরমত সহনশীলতা এখানে অভিধানের শব্দ মাত্র। বিলাসিতার পাশাপাশি বাংলাদেশি প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় বিনোদনের বিষয় হচ্ছে পরচর্চা। প্রয়োজনে হোক আর অপ্রয়োজনে হোক অন্যের পরিবার পরিজন নিয়ে অন্য একজনের কাছে গিবত না করলে করোও পেটের ভাত হজম হয় না। আর এখানে বাংলাদেশিরা সংখ্যায় যেহেতু কম তাই আজ হোক কাল হোক একজনের কথা অন্যজনের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছে যায়। তখন বিভক্তিটা একেবারে প্রকট আকার ধারণ করে।

এত কিছুর পরও বাংলাদেশিরা যে কারণে অসুখী নন সেটা হচ্ছে বিলাসিতার বা বিনোদনের বিষয়ের প্রাচুর্য ও নতুনত্ব। তাদের জীবন কখনো একঘেয়েমি হয়ে যায় না। কারণ প্রতি মুহূর্তেই একেকটা স্থানীয় ও জাতীয় ইস্যু তৈরি হতে থাকে আর সেটা নিয়ে চলে আলোচনা, নতুন আরও একটা ইস্যু যোগ হওয়ার আগে পর্যন্ত। প্রবাসেও বাংলাদেশিরা দেশের ইস্যু নিয়েই অবিরত আলোচনা, সমালোচনা, বিভক্তি নিয়ে আছেন। যার ফলে দেখা যায়, তাদের মস্তিষ্ক সব সময় কোনো না কোনো কারণে ব্যস্ত থাকে। তবে ওপরে আলোচিত কিছু কিছু বিষয় পরিহার করতে পারলে আসলেই তাদের জীবন একেবারে নিস্তরঙ্গ সুখের জীবন হতে পারত। যদিও নিস্তরঙ্গ সুখের জীবন একসময় আবার একঘেয়ে লাগা শুরু করত। যা হোক, আশা করি পরবর্তী প্রজন্ম এগুলো ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশি ও অস্ট্রেলীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে একটা পরিপূর্ণ প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে। যাদের মনে একইসঙ্গে থাকবে পূর্বপুরুষের প্রতি ভালোবাসা আর বর্তমান রাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধা।
...

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>