আজকের রোববারটা নাবিদের জন্য খুব পানসে রোববার। কোথাও আজ যাওয়া হবে না। আজ বাসাতেও কেউ আসবে না। গত রোববারে নদী বাসায় এসেছিল। প্রায় সন্ধ্যা অবধি ছিল। সন্ধ্যায় সে নদীকে শেয়ারউড পার্কে নাজমুল আহসানের বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসেছে।
নাবিদের এর আগের রোববারটাও বেশ ভালো কেটেছিল। তারা কয়েকটা পরিবার মিলে মাউন্ট পিরংগিয়া গিয়েছিল। সেখানে নদীর সঙ্গে কী অদ্ভুতভাবে পরিচয়!
আজ নাবিদ ফোন করে নদীকে বাসায় আসার কথা বলতে পারত। সে ফোন দিলে নদী নিশ্চয়ই না করত না। কিন্তু সমস্যা জুঁইয়ের। জুঁই বাসায় কোনো বাড়তি ঝামেলা চায় না। জুঁই নদীকে এরই মধ্যে ঝামেলা ভাবতে শুরু করেছে। এটা নাবিদের জন্য খুবই দুঃখজনক। কিন্তু সে জুঁইকে ডিঙিয়ে কিছু করতে পারছে না। তার ভেতরে দোটানা আছে। তবে শেষ পর্যন্ত জুঁইকেই তার প্রাধান্য দিতে হবে। ঘরের শান্তি বড় শান্তি।
নাবিদ আজ পেছনের কাচের ব্যালকনিতে না বসে বেডরুমের পাশের কাঠের বড় ডেকটায় বসেছে। এখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। ডে-লাইট সেভিংস শেষ হয়ে গেছে গত মঙ্গলবারের আগের মঙ্গলবারে। হুট করে এক ঘণ্টা কমে যাওয়াতে এখন দুপুরটা দেখতে না দেখতেই শেষ হয়ে যায়। বিকেলটাও খুব একটা দীর্ঘ হয় না। শীতের বিকেল এমনিই।
জুঁই বাসার ভেতর থেকে এল। সঙ্গে মৌনতাও এসেছে। জুঁই একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, এমন অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ?
নাবিদ একটু নড়েচড়ে বসে বলল, কিছু না। একা একা বোরিং লাগছিল। তুমিও বাসার ভেতর থেকে বের হচ্ছ না। তো কী করব, সিন-সিনারি দেখছি আর তোমার কথা ভাবছি।
জুঁই হাতের প্লেটটা সামনের টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, আমার কথা যে ভাবছ না, সেটা আমি নিশ্চিত। কোন দুঃখে আমার কথা ভাববে?
নাবিদ প্লেটে পেঁয়াজি ভাজা দেখে একটু আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল, ওরে আমার লক্ষ্মী বউটা। তুমি কী করে ভাবলে আমার এখন পেঁয়াজি টাইপের কিছু একটা খেতে ইচ্ছে করছে!
: ঢং করো না। চৌদ্দ বছর ধরে সংসার করছি। কোনো দিনও তো অ্যাপ্রিশিয়েট করতে শিখলে না।
: এই যে অ্যাপ্রিশিয়েট করছি?
: কী অ্যাপ্রিশিয়েট করছ, হ্যাঁ? এখন পেঁয়াজি ভেজে এনেছি বলে লক্ষ্মী বউ। আর যদি না আনতাম তাহলে পক্ষী বউ হয়ে যেতাম।
নাবিদ শব্দ করে হাসল। বলল, কখনো না। তবে একটা কথা কী, এই পেঁয়াজির সঙ্গে চা হলে আরও ভালো হতো।
জুঁই মাথা নেড়ে বলল, এ জন্যই বলি, পুরুষ মানুষ প্রচণ্ড লোভী। পেঁয়াজি বানিয়ে এনেছি, পেঁয়াজি খাও। চায়ের কথা পড়ে চিন্তা কর।
: তাহলে আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসি?
: হয়েছে, তোমার আর চা বানাতে হবে না। আমি হট ওয়াটার জগে পানি দিয়ে এসেছি। পেঁয়াজি খাওয়া শেষ হলেই চা নিয়ে আসব।
নাবিদ আবার রসিকতা করে বলল, ধন্যবাদ আমার লক্ষ্মী বউটি।
জুঁইও একটা পেঁয়াজি হাতে নিয়ে কামড় কামড় বসাতে বসাতে বলল, হয়েছে, আবারও ঢং করতে হবে না। শোনো একটা কথা, মিসেস এলিরা স্মিথের কী হয়েছে বলো তো?
নাবিদ জিজ্ঞেস করল, কেন, কিছু হয়েছে নাকি?
: জানি না তো। আজ দুদিন ধরে তাকে দেখছি না।
: দুই দিন মানে, কবে থেকে?
: শুক্রবারে দেখিনি। গতকালও তাকে বাগানে কাজ করতে দেখিনি। আজকেও বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ।
: আজকে তো রোববার। হয়তো চার্চে গেছেন। তিনি তো প্রতি রোববারেই চার্চে যান।
: কিন্তু গতকাল? শুক্রবারে কথা না হয় বাদ দিলাম। শুক্রবারে তাকে দেখছি কিনা পুরোপুরি শিওর না। গতকাল একবারও তিনি বাগানে আসেননি। কুকুরটাকেও বাসার বাইরে আসতে দেখিনি। দরজা-জানালাগুলো কেমন বন্ধ দেখছ?
: তিনি হয়তো কোথাও গেছেন?
: তিনি কোথাও গেলে তো আমাদের চাবি দিয়ে যান। কুকুরটার খাবার কিনে রেখে যান। আজ সকালে কুকুরটা বাসার ভেতর থেকে কীভাবে কুই কুই করে কাঁদল!
: কুকুর কাঁদে না, ডাকে।
: হয়েছে, কুকুর কাঁদুক আর ডাকুক, আমার কিন্তু একটা ভয় হচ্ছে।
: কী ভয়?
: মিসেস এলিরা স্মিথ ঘরে মরে পড়ে আছে নাতো?
: ধেৎ, কী যে বল!
: না না, আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে!
নাবিদ এলিরা স্মিথের বাসার দিকে তাকাল। সত্যি বাসার দরজা-জানালা সব বন্ধ। বাগানে কিছু পপলার গাছের শীতের ঝরা পাতা এলোমেলো পড়ে আছে। গোলাপ গাছগুলোতে কিছু গোলাপ পুরোনো পাপড়িগুলো খসে পড়ছে। এলিরা স্মিথ গোলাপ গাছে কখনো পুরোনো গোলাপগুলো রাখেন না। পুরোনো গোলাপের মধ্যে একটু তরতাজা গোলাপগুলো তিনি মৌনতাকে দেন। বাগানেও তিনি একটা ঝরা পাতা পড়ে থাকতে দেন না।
জুঁই আবার কিছু বলতে যাবে এ সময় এলিরা স্মিথের কুকুরটা বাসার ভেতর থেকে কুই কুই করে উঠল, বড্ড নিস্তেজ গলা।
নাবিদ এলিরা স্মিথের বাসার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
জুঁই বলল, শুনেছ, শুনেছ, কুকুরটা আবার কেমন কুই কুই কাঁদছে?
নাবিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ।
জুঁই বলল, আমার সত্যি সন্দেহ হচ্ছে। এখানে তো এমন অনেক ঘটনাই ঘটে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ঘরে মরে পড়ে থাকে। দুই-তিন দিন পর খবর হয়। তুমি কি একবার মিসেস এলিরার বাসার দরজায় গিয়ে নক করবে?
নাবিদ বলল, আমার মনে অযথা দরজায় গিয়ে নক করে লাভ নেই। আজ রোববার। তিনি চার্চেও যেতে পারেন। আবার কোথাও ঘুরতেও যেতে পারেন। তিনি হয়তো কারও বাসায় ঘুরতে গিয়ে আটকা পড়ে গেছেন।
: আটকা পড়ে গেলে তো ফোন দেন। ফোন দিয়ে কুকুরটার দেখাশোনার কথা বলেন।
: এবার হয়তো ভুলে গেছেন। বৃদ্ধ মানুষ। বাচ্চাদের মতো মন হয়।
জুঁই মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না। এলিরা স্মিথের কুকুরটা আবার ডেকে উঠল।
নাবিদ আরেকটা পেঁয়াজি হাতে নিয়ে কামড় বসাতে যাবে জুঁই বলল, শুনেছ, শুনেছ, কুকুরটা আবার কুই কুই করে কীভাবে কাঁদছে?
নাবিদ বলল, কুকুরটা কাঁদছে না, কুকুরটা ডাকছে।
জুঁই নাক ফুলিয়ে বলল, ওই, একই কথা।
নাবিদ মৃদু হাসল। সে জুঁইয়ের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এলিরা স্মিথের বাসার দিকে আবার তাকাল। কুকুরটা ডাকতে ডাকতেই আবার থেমে গেছে। কয়েকটা চড়ুই পাখি বসে আছে এলিরা স্মিথের বাসার ডেকের রেলিংয়ে। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ছে আর বসছে। বাগানের পাশে মাচা থেকে সবুজ আঙুরগুলো থোকায় থোকায় ঝুলে আছে। শীতের শুরু এখন। কিন্তু আঙুরগুলো এখনো পুরোপুরি বাড়ন্ত হয়নি। ফুল গাছের পাশাপাশি কত জাতের ফলের গাছ যে এলিরা স্মিথের বাগানে। খুব বেশি নয়, একটা-দুইটা গাছ করে গাছ। একটা আপেল গাছ। একটা কমলা গাছ। একটা ফিজিওয়া গাছ। একটা অ্যাপ্রিকট গাছ। দুটো লেবু গাছ। তবে ফুলের গাছ বেশি। ওগুলোকে একটা-দুইটা সংখ্যা করে হিসাব করা যাবে না।
এলিরা স্মিথের বাগানের দিকে তাকালে নাবিদের প্রায়ই তার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। তার মারও বাগান করার খুব শখ ছিল। বাড়ির পেছনের চকে তিনি সারি সারি করে আম গাছ, জামরুল গাছ, কাঁঠাল গাছ, লিচু গাছ লাগিয়েছিলেন। ওগুলোতে তিনি সকাল-বিকেল নিজ হাতে পানি ঢালতেন। বাড়ির পেছনের চকে গাছগুলো হয়তো এখনো আছে। কিন্তু তার মা নেই চৌদ্দ বছর ধরে। অসুখটা কী ছিল ডাক্তার ধরতে পারেনি। অসুখটা ধরা পড়ার আগেই তিনি নেই!
নাবিদ মন ভারী করার আগেই এলিরা স্মিথের বাসা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার জুঁইয়ের দিকে তাকাল। জুঁইও তাকাল নাবিদের দিকে। দুজনই হাসল। মৃদু হাসি। দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের বিবাহিত জীবন। তাদের প্রায় ছয় বছরের একটা মেয়ে। ছোট্ট সংসার। ছোট্ট পরিসর। ভালোবাসা ও সমঝোতার মিশ্রণে বেশ উপচে পড়া সুখ তাদের দাম্পত্য জীবনে।
কিন্তু এই সুখটা আনতে নাবিদের অনেক কাঠ-খড়ি পোড়াতে হয়েছে। ভুগতে হয়েছে অনেক কষ্ট, অনেক যন্ত্রণায়। অনেক অনির্ধারিত দুঃখও এসে ভিড় করেছে। যদিও ওগুলো বহু আগেই অতীত হয়ে গেছে।
মৌনতা এতক্ষণ ডেকের রেলিং চেপে নিজে নিজে খেলছিল। কখনো পাখি তাড়াচ্ছিল। কখনো ঝরনার জলের দিকে তাকিয়ে হাঁস তাড়াচ্ছিল, হিস হিস, হিস হিস। কিন্তু হঠাৎ করেই সে ওগুলো বাদ দিয়ে পাশের একটা চেয়ারে টেনে বসতে বসতে বলল, বাবা, আমি ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে হ্যাপি মিল খাব। ম্যাকডোনাল্ডসের হ্যাপি মিলের সঙ্গে এখন টকিং এলডিন দেয়।
নাবিদ জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ এ মুহূর্তে তোমার ম্যাকডোনাল্ডসের হ্যাপি মিলের চিন্তা মাথায় এল কোথা থেকে?
মৌনতা বলার আগেই জুঁই কথাটা টেনে নিয়ে বলল, ওই তো, কিছুক্ষণ আগে আমি বলেছিলাম। সে দুধ খাচ্ছিল না। তাকে এক গ্লাস দুধ পটিয়ে খাওয়ানোর জন্য এ কথা বলেছিলাম।
নাবিদ মৌনতার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা বিকেলে সুপারমার্কেটে শপিং করতে যাব তো, তখন ম্যাকডোনাল্ডস থেকে হ্যাপি মিল কনে দেব।
মৌনতা জেদ ধরে বলল, না, না, এখন যাব। মা বলেছে এখন ম্যাকডোনাল্ডসে নিয়ে যাবে।
জুঁই চোখ বড় করে বলল, দেখ কী পাজি মেয়ে! আমি কখন বললাম যে এখন ম্যাকডোনাল্ডসে নিয়ে যাব?
মৌনতা জোর গলায় বলল, হ্যাঁ, তুমি বলেছ তো!
নাবিদ বলল, থাক, হয়েছে, হয়েছে। আচ্ছা মৌনতা, তুমি কর্ডলেসটা নিয়ে আস তো। আমি টেলিফোনে অর্ডার দেই।
বাবা, তুমি ভুল কথা বলো না তো! তুমি জানো না, ম্যাকডোনাল্ডস ফোনে অর্ডার নেয় না। পিৎজা ফোনে অর্ডার নেয়।
নাবিদ পেঁয়াজিতে কামড় বসাতে বসাতে একটা লজ্জার হাসি দিল।
জুঁই বলল, তোমার মেয়ে কেমন সেয়ানা দেখছ?
: তোমার মেয়ে না!
: হ্যাঁ, ভালো কিছু হলে নিজের মেয়ে। মন্দ কিছু হলে আমার মেয়ে...!
নাবিদ পেঁয়াজিতে কামড় বসাতে বসাতে মৃদু হাসল। মুখে কিছু বলল না।
দুটো বালিহাঁস ঝুপ করে শব্দ করে এসে ঝরনায় নামল। জুঁইয়ের দৃষ্টি সেদিকে গেল। নাবিদও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বালিহাঁস দেখে মৌনতা সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল হয়ে চেয়ার ছেড়ে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়াল।
নাবিদ বলল, আজকাল এই ঝরনাতে বেশ বালিহাঁস নামছে।
জুঁই একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, হ্যাঁ।
মৌনতা হাঁস তাড়ানোতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। গলা বাড়িয়ে রেলিংয়ের ওপর দুই হাত মেলে শব্দ করতে শুরু করল, হিস হিস, হিস হিস! সে মুহূর্তেই ম্যাকডোনাল্ডসের কথা বেমালুম ভুলে গেল।
জুঁইকে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখে নাবিদ জিজ্ঞেস করল, তুমি কী ভাবছ।
জুঁই মাথা নেড়ে বলল, না, তেমন কিছু না। আমি ভেতরে যাই। তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।
নাবিদ বলল, ঠিক আছে। (ক্রমশ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>
ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1564804