ডিজিটাল দেশ গড়তে দরকার সুস্থ জাতি

ফেলে দেওয়া হচ্ছে ভেজাল দুধ। ছবি: প্রথম আলো
ফেলে দেওয়া হচ্ছে ভেজাল দুধ। ছবি: প্রথম আলো

কিছুদিন আগে সন্তানসম্ভবা একজন নারীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যিনি খুবই অসুস্থ। যেহেতু এই দূরদেশে স্বামী ছাড়া তাকে দেখাশোনা করার কেউ নেই তাই আমি তাকে বললাম, আপনি কেন বাংলাদেশে চলে যাচ্ছেন না?

চট্টগ্রামের বাসিন্দা ওই নারীর বললেন, ‘আমি যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্বামী দেশে যেতে দিতে চান না। উনি বলেন দেশে খাবারে এত ভেজাল। এই খাবার খেলে গর্ভের শিশুর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।’

এ কথা শুনে অনেকেই হয়তো মুখ ভেচকি দিতে পারেন—আমাদের দেশে মানুষের কী বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না। অবশ্যই হচ্ছে, কিন্তু একজন বাবা হিসেবে সব সময় তিনি তার সন্তানের ভালোটাই চিন্তা করবেন। আর এ ক্ষেত্রে অপশন থাকলে তো ভালোটাই গ্রহণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। একজন আদর্শ বাবার বৈশিষ্ট্য, পরিবারের অভিভাবক হিসেবে সকলের ভালোমন্দ দেখা।

বাবার দায়িত্ব যেমন একটি পরিবারের ভালোমন্দ দেখার, তেমনি দেশের জনগণের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব সেই দেশের সরকারের। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার সেই দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, তা বিবেচনার বিষয়।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়া বর্তমান সরকারের একটা স্বপ্ন। ‘ডিজিটাল’ মানে তথ্য প্রযুক্তি আর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ মানে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দরকার শারীরিক ও মানসিকভাবে একটা সুস্থ প্রজন্ম। যা কিনা শুধুমাত্র সঠিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু যে দেশের মানুষের ভেজালের ভিড়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ গঠনের চিন্তা বাতুলতা মাত্র।

আমরা সবাই জানি আমাদের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে খাদ্য সবার আগে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারলে জনগণের খাদ্য অধিকার লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারের সে দিকে নজর আছে বলে মনে হয় না। এমনকি সরকারের তরফ থেকে আমরা মাঝে মাঝে যে ভেজাল বিরোধী অভিযান দেখতে পাই তা প্রয়োজনের তুলনায় এতই অপ্রতুল যে সার্বিকভাবে তা বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

আমাদের দেশের উচ্চ পর্যায়ের বেশির ভাগের পরিবার-পরিজন থাকেন বিদেশে। সে কারণেই কী খাবারে ভেজাল নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ততটা মাথা ব্যথা নেই? নাগরিক হিসেবে তাই এ কথা জানতে ইচ্ছে করে।

ভেজাল নেই কোথায়? জমিতে বীজ ফেলা থেকে শুরু হয়ে যায় ভেজালের কার্যক্রম। ফ্যাক্টরিগুলোতে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ভেজালেরও ধরন রয়েছে ভিন্ন। চাল, ডাল, তেল, ফল, মাছ, মাংস, এমনকি শাকসবজি মানেই এখন তথাকথিত তাজা জিনিস! এমনকি মিনারেল ওয়াটারে ভরে দেওয়া হয় ট্যাপের পানি। মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই মাছ-ভাত এখন আর নিরাপদ নেই। কেমিক্যালমুক্ত তাজা মাছ এখন পাওয়া আসলেই দুষ্কর। ফলমূল পাকানোর জন্য রাসায়নিক তো আছেই। এর ওপর অধিকাংশ ফলের রস তৈরি হচ্ছে ফল ছাড়াই, একে ফলের রস না বলে কেমিক্যালের রস বলাই বোধ হয় যুক্তিযুক্ত।

বিদেশ থেকে মানসম্মত খাবার আনার নামে মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার এনে নতুন স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে হরহামেশাই। এমনকি বেকারির পণ্যগুলোও ভেজালে ভরা। এসব খাবার খেয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।

যে দেশে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেখানে রোগ বালাই যেন গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো।

২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ বিল পাস হয়। বিলে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এই যদি হয় শাস্তি, তাহলে খাদ্যে ভেজাল মেশানো কোনো দিনই বন্ধ হবে না।

ভেজাল খাদ্যদ্রব্য। ছবি: প্রথম আলো
ভেজাল খাদ্যদ্রব্য। ছবি: প্রথম আলো

এক অর্থে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষ খুন করছে। আর এ জন্যই অতি দ্রুত নতুন করে আইন প্রণয়ন করে কঠোরতম শাস্তির বিধান করা দরকার। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণ সচেতন হলে সেই অন্যায়কে রোধ করা যায় কিন্তু মানুষ এ ক্ষেত্রে নিরুপায় বাঁচতে হলে তাদের খাবার খেতেই হবে। এখানে যা করণীয় তা সরকারকেই করতে হবে।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষকেরা বলছেন, এই বিষক্রিয়া প্রজন্মকেও বুদ্ধিহীন, পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।

পরিশেষে সরকারের কাছে এইটুকুই বলতে চাই; ডিজিটাল নয়, সবার আগে দরকার আগামী প্রজন্ম যেন সুস্থভাবে, সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে পারে সে দিকে নজর দেওয়া। আর সে জন্য ভেজাল মুক্ত খাবার নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই! আমাদের সন্তানরা যদি শারীরিক, মানসিকভাবে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে, তবে নিশ্চয়ই আমাদের দেশ একদিন বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পাবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে।