সবুজ মেঘের ছায়া-পনেরো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ অফিসে কাজের চাপ একেবারেই ছিল না। অন্যদিন হলে চারটার মধ্যে রাকিব অফিস থেকে বের হয়ে যেত। তার অফিসে একটা ব্যাপারে বেশ শিথিল। কাজ না থাকলে একটু আগে বের হয়ে যাওয়া যায়। তখন পাঁচটা পর্যন্ত না থাকলেও চলে। এ ছাড়া, কোনো দিন সাইডে গিয়ে তিনটা-চারটার ওপরে বেজে গেলে সেদিন আর অফিসে না গেলেও হয়। তবে জরুরি বিষয়গুলো সব সময়ই জরুরি। অফিসে কাজ থাকলে বা সাইডের জরুরি বিষয় থাকলে, সেদিন সাতটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়।

কিন্তু আজ ওয়েলিংটনের হেড অফিস থেকে লোক আসাতে রাকিবকে পাঁচটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হলো। ঠিক পাঁচটার সময় রাকিব অফিস থেকে বের হয়ে কার পার্কের দিকে হাঁটতে শুরু করল। পাশে ডেভিড ইটন।

ডেভিড ইটন গত সপ্তাহেই নতুন গাড়ি কিনেছে। গত বছরও সে এ সময় নতুন গাড়ি কিনেছিল। তার যে নতুন গাড়ির প্রতি দুর্বলতা আছে, তা নয়। সে বছরের ট্যাক্স কমানোর জন্য গত দুই বছর ধরে একটা করে নতুন গাড়ি কিনছে। নতুন গাড়ি কিনলে বছরের ট্যাক্স কমে গিয়ে সেখান থেকেই গাড়ির পুরো টাকাটা দিয়ে দেওয়া যায়। কেউ ট্যাক্সের এই সুযোগটা নেয়, কেউ নেয় না।

রাকিবও এ কাজটা করতে পারে। ডেভিড ইটন ও সে একই স্কেলের চাকরি করে। কিন্তু সে গত চার বছর ধরে আট বছরের পুরোনো মডেলের সেই একটা গাড়িই চালাচ্ছে। গাড়ি আর পরিবর্তন করেনি। যদিও ডেভিড ইটন সুযোগ পেলেই তাকে এ ব্যাপার বোঝায়। তাকে কথায় কথায় নতুন গাড়ি কিনতে চাপ দেয়।

তবে রাকিবের মাথায় যে এ বছর নতুন গাড়ি কেনার চিন্তা নেই, তা নয়। সে তার পুরোনো গাড়িটা ট্রেড ইন করে নতুন একটা গাড়ি নেবে। নতুন গাড়িতে নদী ও সে দূরে কোথাও যাবে। নদীকে নিয়ে তার কত স্থানে ঘোরাঘুরির ইচ্ছে! উত্তর দ্বীপের উত্তরের শেষ। দক্ষিণ দ্বীপের দক্ষিণের শেষ। নদীরও এই ঘোরাঘুরির প্রতি খুব আগ্রহ। রাকিব ভাবল, এখন তো নদীর ক্লাস ও তার নয়টা-পাঁচটা অফিস। এ বছর শেষে দীর্ঘ ছুটিতে তারা ওই দূরদুরান্তের ভ্রমণে যাবে।

ডেভিড ইটনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাকিব নিজের গাড়িতে বসল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কার পার্ক ছেড়ে রাস্তায় নামতেই দেখল, চারদিকে বিকেলের নরম রোদটা যেন গলে গলে পড়ছে। শীতের হিন হিন বাতাস। দিঘল গ্রিনউড স্ট্রিট। কিলারনি রোড। লেক ক্রিসেন্ট। রাকিব হ্যামিল্টন লেকের পাশ দিয়ে যেতে যেতে নদীর কথা ভাবল। নদীর কথা ভাবতে ভাবতে তাকে কী এক আবেশ পেয়ে বসল। আজ সকালেই নদীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তারপরও তার নদীকে একটা ফোন দিতে ইচ্ছে হলো। সাধারণত তার নিজ থেকে কাউকে ফোন না দেওয়ার বদ অভ্যাসটা এখনো যায়নি। কিন্তু মানুষের অভ্যাস তো পরিবর্তন হয়। তারও খানিকটা হচ্ছে। নদীই তাকে পরিবর্তন করছে।

লেক ক্রিসেন্ট থেকে সামান্য ডানে গিয়ে লেক ডোমেইন ড্রাইভের এক পাশে রাকিব তার গাড়িটা পার্ক করল। লেক ডোমেইন ড্রাইভ ও লেক ক্রিসেন্ট পুরো হ্যামিল্টন লেকটা বৃত্ত করে রেখেছে। লেকে অসংখ্য হাঁস, পানকৌড়ি ও ডাহুকের বাস। লেকের চারপাশে বিস্তৃত কাশবন। শরতে কাশবনে অসংখ্য কাশফুল যখন বাতাসে মাথা নাড়ে, তখন অপূর্ব এক আবহের সৃষ্টি হয়।

রাকিব গাড়ি থেকে নেমে লেকের দিকে মুখ করে হেলান দিয়ে নদীকে ফোন দিল। ওপাশে দুবার রিং বাজতেই নদী ফোন ধরল। নদীকে ফোন দেওয়ার আগে সে ভেবেছিল, নদী তার ফোন পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত হবে। হয়তো বলবে, হোয়াট এ সারপ্রাইজ! রাকিব ভাই, আজ নিজ থেকে ফোন দিয়েছেন? এ সব ছোট ছোট আবেগগুলো রাকিবকে আজকাল ভাবায়।

কিন্তু রাকিব ফোনের ওপাশে নদীর নিষ্প্রভ গলা শুনল। নদী ফোন ধরেই বলল, রাকিব ভাই, আপনি ফোন দিয়েছেন ভালোই হয়েছে। আমিই আপনাকে ফোন দিতাম। আপনি অফিসে আছেন বলে এতক্ষণ ফোন দিইনি।

রাকিব বলল, আমি অফিস থেকে বের হয়ে গেছি তো।

: কখন বের হয়েছেন?

: এই তো, এইমাত্র।

: আপনি এখন কোথায়?

: আমি হ্যামিল্টন লেকের পাশে।

: ওখানে কেন?

: এখান দিয়ে আসার পথে বিকেলের লেকটা দেখতে বেশ ভালো লাগছিল। তাই গাড়ি থামালাম। আর মনে হলো, তোমাকে একটা ফোন দিই। সকালে তো ঠিকমতো কথা বলতে পারিনি। তুমি কি নাবিদ ভাইকে তার দোকানে কাজ করবে বলে হ্যাঁ বলে দিয়েছ?

: সেটা তো আপনাকে ফোন দেওয়ার আগেই হ্যাঁ বলে দিয়েছি। কিন্তু একটু কনফিউজড ছিলাম বলে আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম।

: ও, আচ্ছা। একটু আগে বলছিলে যে তুমি নিজ থেকে আমাকে ফোন দিতে। কেন?

নদী বলল, জি, রাকিব ভাই। রজারসন স্যারের অবস্থা খুব খারাপ।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, রজারসন স্যারের আবার কী হয়েছে?

: আমি বারোটার ক্লাসটা করে আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করে রজারসন স্যারের বাসায় যাই। গিয়ে দেখি, বাসা একেবারে নিস্তব্ধ। স্যারের রুমে ঢুকে দেখি, তিনি কাত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তার কোনো জ্ঞান নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স কল করি।

: কী বলো, স্যারকে না সর্বক্ষণ একজন আয়া দেখে?

: আয়া তো সকাল বিকেল আসে। দুপুরে থাকে না।

: স্যারের না গলায় একটা লাল মেডিকেল অ্যালার্টের মতো কী একটা ঝুলিয়ে রাখেন? ওটায় চাপ দিলে তো অ্যাম্বুলেন্স চলে আসার কথা? তিনি তা করেননি?

: হয়তো তার সে অবস্থা ছিল না।

: ও, আচ্ছা। স্যারের এখন কী অবস্থা?

: স্যারের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তবে মেজর না। বছর দেড়েক আগে একবার মেজর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, ওটার অ্যাফেক্ট পড়েছে।

: স্যার এখন কোথায়?

: হাসপাতালে।

: এখনো কি স্যার অজ্ঞান আছেন?

: না, হাসপাতালে আসার পরপরই জ্ঞান ফিরেছে। স্যার এখন বেশ ভালো আছেন। এখনো তিনি অবজারভেশন ইউনিটে আছেন।

: তুমি কোথায়?

: আমি এখনো হাসপাতালে। তবে আপনার ফোন না এলে এতক্ষণে আমি বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতাম।

: তুমি বের হয়ো না। আমি এখনই আসছি। বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগবে।

নদী বলল, আচ্ছা।

রাকিব পাঁচ মিনিটের কথা বললেও ওয়াইকাটো হাসপাতালের অবজারভেশন ইউনিটে আসতে আসতে তার পুরো বিশ মিনিট লেগে গেল। সে অবজারভেশন ইউনিটে এসে প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসনের কেবিনের সামনে এসে দেখল, দরজার পাশে প্রফেসর রজারসনের পুরো নাম স্পষ্টাক্ষরে লেখা। দরজা অর্ধেক খোলা।

রাকিব রুমে উঁকি মারতেই দেখল, কেবিনের ভেতর ডাক্তার ও নার্স প্রফেসর রজারসনকে দেখছেন। নদী রুমের একপাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাকিবকে দেখে নদী সঙ্গে সঙ্গে কেবিন থেকে বের হয়ে এল।

রাকিব ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, স্যারের এখন কী অবস্থা?

নদী বলল, স্যার এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবে আজ রাতটা তাকে এই অবজারভেশন ইউনিটের কেবিনেই কাটাতে হবে। কাল বলা যাবে, স্যারকে বাসা নিয়ে যাওয়া যাবে নাকি হাসপাতালেই রাখতে হবে।

রাকিব মাথা ঝাঁকাল। মুখে কিছু বলল না।

হাসপাতালের এপাশের কেবিনগুলো নতুন করা হয়েছে। বেশ ঝকঝকে। একটা পাঁচতারা হোটেলের রুমের মতোই হাসপাতালের এই কেবিনগুলো। প্রত্যেকটা অন স্যুইট।

নিউজিল্যান্ডের সরকার প্রতিটা হাসপাতালে রোগীদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। এখানকার হাসপাতালের প্রতিটা রুম, প্রতিটা কেবিন ও প্রতিটা ইউনিটে রোগীদের জন্য এমন একটা ঘরোয়া পরিবেশের সৃষ্টি করে যাতে রোগীরা মনে করেন, তারা অসহায় ও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে নেই। তারা বাসাতেই আছেন।

ডাক্তার ও নার্স কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রফেসর রজারসনের কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।

রাকিব ও নদী সঙ্গে সঙ্গে প্রফেসর রজারসনের কেবিনে ঢুকল।

প্রফেসর রজারসন রাকিবকে দেখে একটা দিঘল হাসি দিয়ে বললেন, আরে ইয়ং পোয়েট, কী খবর? এই পাগলি নদীই বুঝি তোমাকে ফোন করে নিয়ে এসেছে।

নদী বলল, না স্যার, তিনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি দিইনি। ফোনে আপনার অসুস্থতার কথা শুনে অফিস থেকে সরাসরি এখানে চলে এসেছেন।

প্রফেসর রজারসন বললেন, ভালো করেছ এখানে এসেছ। আমাকে এখন বাসায় নিয়ে যাও। আমি আমার বাসার সামনের ডেকের বিকেলটা মিস করছি। আমার ছোট্ট লাইব্রেরিটাও খুব মিস করছি। আর আজ পূর্ণ অমাবস্যার রাত, সেটা জান?

রাকিব বলল, না স্যার, জানি না।

প্রফেসর রজারসন কৃত্রিম কটাক্ষ করে বললেন, কী বলো, তুমি কবি মানুষ! এসবের খবর রাখ না?

রাকিব হেসে বলল, স্যার, মানুষজন তো জ্যোৎস্নার খবর রাখে, অমাবস্যার না।

প্রফেসর রজারসন বললেন, কবিদের রাখতে হয়। এখন শীতকাল। শীতের রাতের অমাবস্যার অন্যরকম একটা সৌন্দর্য আছে।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, সেটা কেমন?

প্রফেসর রজারসন বললেন, তুমি একদিন আমার বাসায় এসো। বাসায় এসে রাতের অমাবস্যা দেখ। এই শীতেই আসতে হবে কিন্তু। আগামী শীতে আমি না-ও থাকতে পারি। আর হ্যাঁ, শীতের গরম কাপড় ও কানটুপি নিয়ে এসো। বাইরে বসে অমাবস্যা দেখতে হবে কিন্তু...! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>