সবুজ মেঘের ছায়া-ষোলো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিব ভাবল, শনিবারে অফিস থাকলেই ভালো হতো। গত দুই-তিন মাস শনিবার সে নদীর সান্নিধ্য না পেলেও অন্তত শূন্যতা অনুভব করেনি। কিন্তু আজ করছে। গত পরশু দিন অফিসের সার্ভিস ম্যানেজার ম্যালকম ফক্স হাসি হাসি চেহারা করে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, কেমব্রিজের প্রজেক্টের ঝামেলা শেষ হয়েছে। শনিবার থেকে আর কাউকে অফিসে ওভার টাইম করতে হবে না।

ম্যালকম ফক্সের কথায় বেশির ভাগ খুশি হলেও কেউ কেউ ওভার টাইম করতে না পারার দুঃখে সাময়িকভাবে মন ভারী করেছে। রাকিব অবশ্য খুশিই হয়েছিল। ভেবেছিল, শনিবার নদীকে নিয়ে সে ঘুরতে বের হতে পারবে।

আজ শনিবার। কিন্তু রাকিব আজ সেই নদীকেই সান্নিধ্যে পাচ্ছে না। নদী আজ তার নাবিদ ভাইয়ের দোকানে ট্রেনিংয়ে যাবে। সারা দিন ওখানেই থাকবে।

সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস। বাতাসের তেজ অবশ্য কম। পাতাহীন ম্যাপল ও ওক গাছগুলো কেমন বিমর্ষ যুবতীর মতো দাঁড়িয়ে ভিজছে।
রাকিব জানালার পাশে বসে আছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানার ওপর বসে রাকিব একটা কবিতার খসড়া করছে। আপাতত কবিতাটার নাম দিয়েছে, কষ্টগুলো এমনই।
রাকিব আজকাল কাহিনিসর্বস্ব কিছু কবিতা লিখছে। বলা যায় সিরিজ কবিতা। যদিও প্রত্যেক কবিতার আলাদা আলাদা নাম দিচ্ছে। কষ্টগুলো এমনই সেই সিরিজ কবিতার একটা। কবিতার শেষ কয়েকটা লাইন নিয়ে রাকিব এখন কাজ করছে। কিন্তু লাইনগুলো নিয়ে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছে না।
একদল অশরীরী বুবু বাতাসের ভেতর শরীর হয়ে
ভূঁইয়াদের চাপকলের মতো নিশিরাতে কুঁইয়ে কাঁদছে।
কান্নাটা কেমন করুণ বাতাসে ভর করে
শুনলে তোমার কষ্ট হবে। কষ্টগুলো এমনই।
রাকিব ভাবল, কবিতাটা সে এ মুহূর্তে নদীকে দেখাতে পারলে বেশ ভালো লাগত। খুব আহামরি কবিতা নয়, তা সে বুঝতে পারছে। তবুও আজকাল নতুন কোনো কবিতা নদীকে না দেখাতে পারলে তার কাছে কবিতাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
শীতের শুরুতে বৃষ্টি বা ঠান্ডা খুব বেশি না পড়লেও এখন শীতটা ঠিকই জেঁকে পড়েছে। শীতের সঙ্গে হিম শীতল বৃষ্টি। রাকিব নিজেকে লেপে মুড়িয়ে কখনো বৃষ্টি দেখছে, কখনো কবিতার খসড়ায় দৃষ্টি বোলাচ্ছে। এখনো সে সকালের নাশতা করেনি। তবে তার যে ক্ষুধা পায়নি, তা নয়। ক্ষুধায় তার পেট গুড়গুড় করছে। সঙ্গে কফির নেশাটাও আছে। গতরাতে সে সন্ধ্যার দিকে হালকা কিছু খেলেও রাতে তেমন আর কিছু খায়নি। অড্রিয়ান হেনরি, রজার ম্যাকগ্রা ও ব্রায়ান প্যাটিনের পেঙ্গুইন সিরিজের দ্য মারসি সাউন্ড পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে গিয়েছিল!
রাকিব আরও কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে দৃষ্টির ওঠানামা করল। কখনো সে বৃষ্টি দেখল, কখনো সে কবিতার কোনো পঙ্‌ক্তি বা কোনো শব্দ নিয়ে ভাবল। কিন্তু তার সমস্ত মন জুড়ে নদীর চেহারাটাই জেঁকে বসেছে। বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা তার মনে এখন থেমে থেমে বিরক্তি ধরাচ্ছে। কবিতাটাও তাকে আর এখন টানছে না।
রাকিব লেপ সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামল। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে বাথরুমে ঢোকার আগে রাকিব হট ওয়াটার জগটায় পানি নিয়ে অন করল। ছোট্ট ফ্রাইপ্যানে সামান্য তেল ঢেলে একটা চুলাও অন করে দিল। রাকিব রুটি ও ডিম পোজ দিয়ে নাশতা করবে। সঙ্গে ব্ল্যাক কফি।

আতিক গতরাতে ট্যাক্সি চালিয়েছে। সকাল সাড়ে ছয়টায় বাসায় ফিরেছে। এখন সে তার রুমে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আতিকের এই পরিবর্তনে আজকাল রাকিবকে বেশ ভাবায়। একটা মেয়ে একজন পুরুষের জীবনের মোড় কীভাবে ঘুরিয়ে দিতে পারে...! যে আতিক উইকএন্ডে নাইট ক্লাব ও নারী বাদে থাকতে পারত না। মদ গিলত হাঁসের মতো। সেই আতিকের কী পরিবর্তন!

মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন রাকিবের ভালো লাগে। আতিকের এই পরিবর্তনও তার বেশ ভালো লাগছে। আতিক আর আগের মতো বেফাঁস কথা বলে না। যখন-তখন ভুলভ্রান্তিও করে না। সপ্তাহ খানিক আগে আতিক এক সন্ধ্যায় জোর করেই রাকিবকে বউয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছিল। ফোনে আতিকের বউয়ের সঙ্গে কথা বলে রাকিবের বেশ ভালোই লেগেছে। সে খানিকক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পেরেছে, কেন আতিকের এই পরিবর্তন!

রাকিব বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে, কিচেন থেকে ডিম পোজ-রুটি ও ব্ল্যাক কফি নিয়ে আবার বেডরুমে চলে এল। লাউঞ্জে টিভি দেখলে আতিকের ঘুমের সমস্যা হয় বলে সে বেডরুমের জন্য ছোট্ট একটা টিভি কিনেছে। সঙ্গে স্কাইয়ের লাইনও নিয়েছে।

রাকিব দুটো বালিশ ভাঁজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে রিমোটে টিভি চালু করল। স্কাই মুভি চ্যানেলে একটা বাচ্চাদের মুভি চলছে। মুভিটার নাম রেইন। দ্য রেইন নামে ডাস্টিন হ্যপম্যান ও টম ক্রুজের একটা মুভি আছে। বেশ ভালো মুভি। এখানকার এই স্কাই চ্যানেলের রেইন মুভিটা সেটা নয়। এই মুভিটাও সে আগে দেখেছে। এটা হলিউডের মুভি নয়, নিউজিল্যান্ডের মুভি। নিউজিল্যান্ডের ঔপন্যাসিক ক্রিস্টি গানের রেইন উপন্যাস অবলম্বনে নিউজিল্যান্ডের পরিচালক ক্রিস্টিন জ্যাফ রেইন মুভিটা বানিয়েছেন।

তবে মুভিটা খুব চমৎকার। খুব সাধারণ একটা কাহিনি নিয়ে মুভির চরিত্রগুলো আবর্তিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ষাট-সত্তর দশকের ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি নিয়ে কাহিনি গড়ে উঠেছে। তবে রেইন মুভির দুটি চরিত্র, তেরো বছরের জেন ও তার আট বছরের ছোট ভাই জিমের মধ্যে রাকিব পথের পাঁচালির দুর্গা ও অপুকে খুঁজে পায়। যদিও তাদের বাবা-মার চরিত্রের সঙ্গে দুর্গার বাবা-মার চরিত্রের মোটেও মিল নেই। আর পথের পাঁচালি সিনেমায় দুর্গা মারা যায়, অপু নয়। কিন্তু রেইন সিনেমায় জিম মারা যায়, জেন নয়।

রেইন মুভিটা যেহেতু রাকিবের আগেই দেখা, তাই সে কিছুক্ষণ টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেও মুভিটায় মনোযোগ দিতে পারল না। সে নাশতা খেয়ে কফির কাপে আয়াস করে চুমুক দিয়ে আবার আতিককে নিয়ে ভাবতে বসল। আতিকের স্ত্রীর ভিসা হয়ে গেছে। টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। তবে আতিক একটু পিছিয়ে টিকিট কেটেছে। সে একটা বাসা খুঁজে পেয়েছে। ক্লোডল্যান্ড সাবার্বে। তবে বাসার চাবি পেতে তার আরও তিন-চার সপ্তাহ লাগবে। আতিকের টিকিট পিছিয়ে কাটার কারণটা সে জন্যই।

রাকিবের আতিকের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কথা ভাবল। তারও কী একটা ছোট্ট সংসার গড়ে তুলতে ইচ্ছে করে না? হ্যাঁ করে। ছোট্ট ছোট্ট সুখ। ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসা। আর ছোট্ট ছোট্ট কিছু অনুভূতি। সেই সুখ, সেই ভালোবাসা, সেই ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতি সে এমেন্ডার কাছ থেকে পাঁচটা বছর পায়নি বললে ভুল হবে। অবশ্যই সে পেয়েছে। তাই তার জীবনটা থেমে গিয়েছিল এমেন্ডা চলে যাওয়ার পর থেকেই। তার মেয়ে সাদিয়ার মৃত্যুটা তাকে আরও থামিয়ে দিয়েছিল। তারপর আরও দীর্ঘ পাঁচটা বছর। তার জীবনটা হয়তো জীবনের মতোই আপন গতিতে চলছিল। তবে তার জীবনটা ছিল শামুকের মতো। শামুক যেমন অন্য প্রাণীর দৃষ্টির অগোচরে খোলস থেকে বের হয়ে চলে। আবার কোনো প্রাণীর দৃষ্টি পড়লেই খোলসের ভেতর চুপ করে বসে যায়। তার জীবনটা সেরকমই ছিল।

তারপর হঠাৎ করেই নদী এল। রাকিব আবার নদীর স্রোতে ভাসতে শুরু করল। শনিবার বা রোববারে নদীর প্রতীক্ষা। হায়াস প্যাডক। পাঁচটা ওক গাছ। নদীর জলে নেমে যাওয়া একটা ডক। ওয়াইকাটো নদীর পাড়ে পাশাপাশি হাঁটা। নতুন কিছু কবিতা। কবিতার কিছু আলোড়ন।

নদী আজ আসবে না। তার এই না আসার পেছনে যুক্তি আছে। রাকিব ভাবল, এই যুক্তি দিয়ে তো জীবন সাজানো যায় না। ভেতরগত অনুভূতিগুলোকে নিয়ে কোনো বিশ্লেষণে বসা যায় না। রাকিবের ভেতর এখন ক্ষরণ। তার হৃদয়ের ক্ষরণ।

রাকিব কফির কাপ হাতে জানালা গলে আবার বাইরে তাকাল। বাইরে এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে হালকা ঝোড়ো বাতাস।

রাকিব কোনো কিছু না ভেবেই ভেতরের আবেগ নিয়ে বিছানা ছাড়ে নামল। এক হাতে নাশতার খালি প্লেট ও অন্য হাতে কফির কাপটা হাতে নিয়ে সে রুম ছেড়ে বের হয়ে এল। নাশতার খালি প্লেটটা কিচেনের সিংকের পাশে রেখে, কফি কাপ হাতে সে দরজা খুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। বাইরে কনকনে শীত। শীতের শীতল বৃষ্টির জল। এই শীতল জলে অল্প ভিজলেই অসুখ করে। তবুও রাকিব ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইল। বৃষ্টির ছাঁট এসে এলোমেলোভাবে তার গায়ে এসে পড়ছে। তার মুখমণ্ডল, হাত ও শরীর ক্রমান্বয়ে ভিজে উঠছে। কিন্তু সে মোটেও ব্যালকনি থেকে নড়ছে না।

রাকিব ভাবল, হৃদয়ের অসুখের চেয়ে বড় অসুখ আর কী আছে? শীতের বৃষ্টিতে ভেজা অসুখ তো শুধু ক্ষণকালের। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1566027