কাব্য কথনের যাত্রা ও আমার উপলব্ধি

অনুষ্ঠানের একটি পরিবেশনা
অনুষ্ঠানের একটি পরিবেশনা

ক্যানবেরায় এত ভালো আবৃত্তিকার আছে, সেটা এখানে থেকেও জানতে পারতাম না, যদি ‘কাব্য–কথন’-এর আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতাম। সাধারণত আমরা প্রবাসীরা সপ্তাহের সব কাজ জমিয়ে রাখি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোর জন্য। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। গেল ১৭ নভেম্বর (শনিবার) তাই কাজ শেষ করে যখন ভাবছিলাম একটু বিশ্রাম নেব, তখন মনে হলো, এ রকম রোদেলা এক বিকেলে বাড়িতে বসে মোটেই সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। তারপর তড়িঘড়ি করে কাব্য কথনের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি অনুষ্ঠান ঠিক সময়মতো শুরু হয়ে গেছে। নিজেকে মনে মনে একটু বকা দিলাম আর সেইসঙ্গে উপলব্ধি হলো, এই সংগঠনটি তাদের শুরুর অনুষ্ঠান যেভাবে সঠিক সময়ে শুরু করেছে, তারা অতি অবশ্যই অনেক দূর যাবে।

'আজি এ প্রভাতে রবির কর’—রবি ঠাকুরের এই কবিতা সম্মিলিত কণ্ঠে পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুরু। কবিতার পর অনুষ্ঠানের পরিচিতি ও ঘোষণা করেন শামসুদ্দিন শাফি বিপ্লব। আর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার। পুরো অনুষ্ঠানটি আয়োজকেরা তিনটি পর্বে সাজিয়েছীলেন। দেশ, প্রেম ও সাম্য এবং প্রেম পর্বের দুটি ভাগ ছিল যার একটি ছিল শেষের আগে। কী অসাধারণ ভাবনা! দর্শকদের বিরক্তি প্রকাশের কোনো সুযোগই দিলেন না আয়োজকেরা। যা হোক, মূল আলোচনায় ফিরে আসি। শ্রাবণী পুরকায়স্থের দেশ পর্বের পরিচিতি শেষে বিপ্লবের কণ্ঠে শক্তিশালী কবি সৃজন সেনের ‘মাতৃভূমির জন্য’ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আমাদেরও কি মাতৃভূমি আছে? আমরা যারা ভালোভাবে বাঁচার জন্য দেশকে, দেশের কোটি মানুষকে পেছনে ফেলে বিদেশে চলে এসেছি তারা কি জন্মস্থানকে মাতৃভূমি দাবি করতে পারি? এরপরে কাজী নজরুলের ‘নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম’, রবি ঠাকুরের ‘স্ফুলিঙ্গ’, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ ও জীবনানন্দ দাসের ‘আবার আসিব ফিরে’—একগুচ্ছ দেশের কবিতা সম্মিলিত কণ্ঠে শুনতে শুনতে দেশের জন্য আপ্লুত হননি এ রকম দর্শক সেদিন পাওয়াই যাবে না।

অনুষ্ঠানের একটি পরিবেশনা
অনুষ্ঠানের একটি পরিবেশনা

স্বর্ণময় চক্রবর্তীর কবিতা ‘পারিবারিক চালচিত্র’ শ্রাবণীর একক পরিবেশনা ছিল যেটা অনেকবার শোনার পরেও মনে হয় নতুন করে শুনছি। কবিতা পরিবেশনার সঙ্গে আশরাফ আর অমিতের গিটার পরিবেশনার কথা না বললে একটু ফাঁক থেকে যায়। আমাদের মতো অনভ্যস্ত শ্রোতা যাতে কয়েকটা কবিতা শোনার পর একঘেয়ে হয়ে না যায় তার জন্য আশরাফ আমাদের শোনালেন কালিকা প্রসাদের ‘আমি তোমারই গান গাই’ এবং বিপ্লব পরিবেশন করলেন ‘মায়েরা মিথ্যে কথা বলে’ যার সঙ্গে অমিত জেমসের ‘মা’ গানের দুটি অন্তরা পরিবেশন করলেন শুরু ও শেষে। শ্রাবণী আর রাজীব কিশোর কুমারের ‘সে দিনও আকাশে’ এবং সাদিয়া ও আশরাফ তসলিমা নাসরিনের ‘প্রিয় রুদ্র’ যুগল পরিবেশনার পরে সদ্য প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে সৃজা ঘোষের ‘দেখা হলো বছর চারেক পর’ আবৃত্তি করেন শ্রাবণী।

সাম্য পর্বে লালনের ‘মানুষ গুরু নিষ্ঠাচার’ গান দিয়ে শুরু করে একে একে অচিন্ত্য কুমারের ‘ছন্নছাড়া’, সুনীলের ‘পাহাড় চূড়ায়’, তারিক সুজাতের ‘জন্মের আগে আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন’, দেবব্রত সিংহের ‘তেজ’ এবং কাজী নজরুলের ‘গাহি সাম্যের গান’ কবিতাগুলো শ্রোতাদের মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছে।

অনুষ্ঠানের শেষের আগে বুশরা আর বিপ্লবের কণ্ঠে অঞ্জন দত্তের ‘প্রিয় বন্ধু’ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আমরা বোধ হয় সত্যি জয়িতা ও অর্ণবের কথোপকথন শুনছিলাম। দু-একটা তাল লয়ের ত্রুটি ছাড়া অনুষ্ঠানটি আমাদের সবার ভালো লেগেছে। প্রেমের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে রাজীবের কণ্ঠে ‘হাওয়ায় মেঘ সরায়ে’ গানটি অসাধারণ লেগেছে।

এই অনুষ্ঠানের কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের আবৃত্তিকার ও সংগঠক রণজিৎ রক্ষিত এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা স্কুলে পড়ার সময় থেকে দেখতাম সেই সময় একটি আবৃত্তি সংগঠন করার কী অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং অতঃপর ‘বোধন’। এখানেও যারা কষ্ট করে আবৃত্তি সংগঠন করেছেন তাদের প্রতি আশা থাকবে এই সংগঠন যেন শুধু তারকা হওয়ার সংগঠন না হয়ে যায়। আমরা যারা প্রবাসে থাকি তারা অনেকেই কী-করে, কীভাবে নিজেদের তারকা বানাব তাতেই মশগুল থাকি। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে কাব্য কথন তাদের যাত্রার শুরু থেকে ক্যানবেরার নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে সবাইকে বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারের পাশাপাশি ভাষাকে ভালোবাসতে অনুপ্রাণিত করে যাবে।
...

নিউটন দেবু: সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক।