সবুজ মেঘের ছায়া-বিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নাবিদ ও জুঁই আজ নদীকে দোকানে কাস্টমার সার্ভিসের ট্রেনিং দেবে। কিন্তু আজ দোকানে তেমন কাস্টমারই আসছে না। ট্রেনিং আর কী দেবে? তাই ওরা দোকানের কাউন্টারকে বৃত্ত করে গল্প করছে। নাবিদ ও নদী কথা বলছে বেশি। জুঁই শুনছে। তবে সে মাঝেমধ্যে এটা সেটার জবাবও দিচ্ছে।

নদী জিজ্ঞেস করল, আমার জন্মের কথা কি আমার দাদার বাড়ির কেউ জানত?

নাবিদ বলল, হ্যাঁ, জানত। কিন্তু কারও কৌতূহল ছিল না। ওরা মনে করেছে, তোর বাবা মারা গেছে, তোদের ব্যাপারে কৌতূহল রেখে লাভ কী?

নদী ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার মতো বলল, ও।

নাবিদ কী বুঝতে পেরে বলল, এটাই স্বাভাবিক। আর গ্রামের মানুষজন সব সময় একটা প্রথা নিয়ে চলে।

: কী প্রথা?

: সেটা তুই বুঝবি না।

: আচ্ছা, গ্রামের প্রথা না হয় বুঝলাম না। কিন্তু বাবার মৃত্যুর সংবাদটা আপনারা কীভাবে পেয়েছিলেন? আপনাদের সঙ্গে তো বাবা বা মার কোনো যোগাযোগ ছিল না।

নাবিদ বলল, আমাদের চৌধুরী বাড়ি খুব বড় ও প্রভাবশালী। ওরা সব খবর রাখত। এখনো রাখে।

নদী বলল, আমি জানি, চৌধুরী বাড়ি খুব বড় ও প্রভাবশালী। মার মুখে শুনেছি। কিন্তু কথা সেটা নয়। মা কিন্তু বিশ্বাস করেন, বাবার মৃত্যুটা একটা রহস্য। বাবার নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি?

: রাজীব চাচার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, কে বলেছে?

: মা তাই বিশ্বাস করেন।

: নাহ, আমি তো রাজীব চাচার অস্বাভাবিক মৃত্যুর তো কোনো কারণ দেখি না। আর আমি এমন ধরনের কোনো কথাও শুনিনি।

: একজন ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবকের এভাবে হঠাৎ মৃত্যু?

: মৃত্যু কি বলে কয়ে আসে?

: তা আসে না।

: তাহলে? শোন, বরং রাজীব চাচার মৃত্যুর দায়ভার গিয়ে পড়েছিল চাচির ওপর। যার কারণে তোর বাবার মৃত্যুর পর চৌধুরীর বাড়ির কেউ চাচির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। তোর দাদার মৃত্যু হলে তোদের ব্যাপারটা আমাদের বাড়ির সবার মন থেকে পুরোপুরি মুছে যায়।

নদী হঠাৎ খেয়াল করল, নাবিদ তাকে তুমি সম্বোধন না করে তুই সম্বোধনে ডাকছেন। নদী বলল, ভাইয়া, আপনি আমাকে তুই সম্বোধনে ডাকছেন, বেশ ভালো লাগছে।

নাবিদ একটু বিস্মিত হয়ে বলল, তাই নাকি? আসলে আমি খেয়াল করিনি। সরি।

নদী ব্যস্ত হয়ে বলল, না, না, ভাইবোনের মুখ থেকে তুই সম্বোধনে ডাক শোনা খুব মধুর। আমি শুধু মার মুখ থেকেই তুই ডাকটা শুনেছি। ভাইবোন তো আর ছিল না যে, কেউ আমাকে তুই বলে ডাকবে!

নাবিদ মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা, আমি তোকে তুই বলেই ডাকব। তোর ভাবিও এতে খুশি হবে।

জুঁই একটু নাক ফুলিয়ে বলল, তুমি কী ইঙ্গিত করে কথাটা বলছ, আমি কিন্তু ক্লিয়ার বুঝতে পারছি।

: নাবিদ এবার শব্দ করে হেসে উঠল, হা হা, হা হা।

নদী না বুঝেই হাসল।

এ সময় মৌনতা অফিস রুম থেকে এসে বলল, বাবা, তুমি এত জোরে হাসবে নাতো, আমার ডিস্টার্ব হয়।

নাবিদ বলল, দেখ নদী, তোর ভাগনি একটা পাকনি বুড়ি।

মৌনতা জোর গলায় বলল, বাবা, তুমি আমাকে পাকনি বুড়ি ডাকবে না। আই ডোন্ট লাইক দিস সেন্টেন্স।

জুঁই কথাটা টেনে নিয়ে বলল, হয়েছে, তুমি তোমার খেলা কর গিয়ে। তুমি বড়দের মধ্যে কথা বলতে আসবে না।

মৌনতা বলল, মা, তুমি খুব মিন!

জুঁই চোখ পাকিয়ে বলল, হুম, যাও...!

মৌনতা এবার বিনা বাক্যে অফিস রুমে চলে গেল।

নদী বুঝতে পারল, মৌনতা তার নাবিদ ভাইয়ের চেয়ে জুঁই ভাবিকে বেশি ভয় পায়।

দোকানে তখনই একজন কাস্টমার ঢুকল। জুঁই ও নদী কাউন্টারের সামনের টুল ছেড়ে সরে গেল। কাস্টমারটা সিগারেট কেনার কাস্টমার।

কাস্টমারটা চলে যেতেই নদী ও জুঁই আমার টুল টেনে বসল।

নাবিদ নদীর দাদার প্রসঙ্গটা টেনে বলল, নদী, তোর দাদার কী ইচ্ছে ছিল জানিস, রাজীব চাচা চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে বের হয়ে এলে তাকে মুকিমপুর কলেজে জয়েন করাবেন। আমাদের নিজেদের কলেজ। বেশ পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী। ভবিষ্যতে হয়তো রাজীব চাচা কলেজের প্রিন্সিপাল হবেন। আজ পর্যন্ত আমাদের বাড়ির কেউ সেই কলেজের প্রিন্সিপাল হয়নি। আমাদের বাড়ির উচ্চশিক্ষিতরা তো আজকাল আমাদের বাড়িতেই যায় না।

নদী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ভাইয়া, আপনি কিছুক্ষণ আগে বললেন, বাবার মৃত্যুর সম্পূর্ণ দোষ মায়ের ওপর চাপানো হয়েছিল। কিন্তু কেন?

: সেটা অনেক কারণে। আচ্ছা, ওসব কথা বাদ দে। তোকে একটা অন্য কথা জিজ্ঞেস করি।

: কী কথা?

: তুই কিছু মনে করবি নাতো?

: না না ভাইয়া। আমি কিছু মনে করব না।

: তার সঙ্গে তোর কত দিনের পরিচয়?

: কার সঙ্গে?

: ওই যে, যার সঙ্গে তোকে মাউন্ট পিরংগিয়ায় দেখলাম?

: ও, রাকিব ভাইয়ার কথা বলছেন?

: হ্যাঁ, তার সম্বন্ধেই।

: এই তো, নয়-দশ মাস হয়ে গেছে।

: কীভাবে পরিচয়?

: এ দেশি একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। নারওয়াহিয়া টুইন রিভার রেস্টুরেন্টে।

: নারওয়াহিয়ার টুইন রিভার রেস্টুরেন্ট! সে তো বেশ দূরে। এত দূরে কীভাবে?

: আমি আগে গ্রিন্সবড়ো স্ট্রিটের একটা স্টুডেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে এ দেশি দুজন মেয়ের সঙ্গে ফ্ল্যাটমেট হিসেবে থাকতাম। একজনের নাম ছিল লিয়নি আর অন্যজনের নাম ছিল স্ট্যাফিনি। ওটা নাজমুল ভাইয়ের বাসায় বোর্ডার হিসেবে থাকার আগে। তো সেই স্ট্যাফিনির বিয়েতে রাকিব ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। স্ট্যাফিনির বড় ভাই ছিল রাকিব ভাইয়ের বন্ধু। সেই সূত্রেই তার স্ট্যাফিনির বিয়েতে যাওয়া।

নাবিদ মাথা ঝাঁকাল। এক মুহূর্ত সে কী ভাবল। জিজ্ঞেস বলল, তাকে তুই কত দূর জানিস?

নদী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছে?

: তুই আমার বোন না হলে হয়তো তোকে আমি এ কথা বলতাম না। আসলে ওই ছেলেটা তো ভালো না।

: ভালো না মানে...।

শোন, তুই রাকিব সম্বন্ধে কত দূর জানিস তা আমি জানি না। আমি শুনেছি, সে আগে একটা বিয়ে করেছিল। এ দেশি মেয়ে। দীর্ঘদিন সেই মেয়ের সঙ্গে সংসার করেছে। তাদের একটা মেয়েও হয়েছিল।

: আমি সব জানি, ভাইয়া।

: সব জেনেও তুই এমন একটা ছেলের সঙ্গে ওঠা-বসা করিস?

: ভাইয়া, একজন মানুষ এ দেশি কোনো মেয়েকে বিয়ে করলেই খারাপ হয়ে যায় না। বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের স্ত্রী-ই বিদেশি।

: সে কি বিখ্যাত মানুষ?

: না, তবে একদিন বিখ্যাত হতেও পারেন।

: কীভাবে?

: তিনি কবিতা লেখেন।

: ও, কবিতা লেখে।
: হ্যাঁ, বেশ ভালো কবিতা লেখেন।

: শোন, একসময় আমিও কবিতা লিখতাম। তোর বাবার অনুপ্রেরণায় শুরু করেছিলাম। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছিল। কিন্তু এক সময় ছেড়ে দিই। এসব ছাতা-মাথা লিখে আজকাল কেউ নাম করতে পারে না। তা-ও আবার এই বিদেশে। এমনিতে বাংলাদেশে কবির সংখ্যা বন্যার জলের মতো হু হু করে বাড়ছে। এ এক মহা উপদ্রব!

নদী গম্ভীর গলায় বলল, ভাইয়া, আমার মা-ও কিন্তু কবি।

নাবিদ এ কথার কোনো জবাব দিল না। দৃষ্টি নদী থেকে সরিয়ে একবার জুঁইয়ের দিকে তাকাল। একবার দোকানের দরজা গলে বাইরেও তাকাল। নাবিদ বলল, চাচির কথা আলাদা। তিনি বাংলাদেশে আছেন। কলেজে পড়ান। আর ব্যাপারটা কবি বা কবিতা নিয়ে নয়। এই ছেলেটার আরও কিছু বদনাম আছে। সে রেগুলার ড্রিংক করে। অকল্যান্ডে সে জাকারান্ডা লজ নামে একটা বোর্ডিং হাউসে থাকত। সেখানে থাকার সময় একবার অতিরিক্ত ড্রিংক করার কারণে তাকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়েছিল।

: ড্রিংক করে নয়, অসুস্থ হয়ে।

: অসুস্থ হয়ে মানে? তোকে কে বলেছে?

: তিনি নিজেই বলেছেন।

: সে বলল আর তুই বিশ্বাস করলি?

: জি ভাইয়া। তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না।

: তুই আসলে পাগল হয়ে গেছিস। তোর মতো একটা মেয়ে। বুয়েট থেকে পাস করেছিস। এখানে এসে হায়ার স্টাডি করছিস। ভবিষ্যতে পিএইচডি করবি। আর তুই কিনা এমন একটা আলতু-ফালতু ছেলের সঙ্গে চলাফেরা করিস। যার কোনো যোগ্যতাই নেই।

: তিনিও কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলেন। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলেন। বাংলাদেশে থাকলে কমপক্ষে ইউনিভার্সিটির একজন টিচার হতে পারতেন। কিন্তু কথা সেটা নয়। আপনি তার সম্বন্ধে এত খারাপ কিছু বলছেন কেন?

: নদী, আমি মিথ্যে বলিনি। নিউজিল্যান্ডে বাঙালি সমাজটা খুব বড় নয়। এখানে সবাই সবার খবর রাখে। রাকিবের আদি-নক্ষত্র আমি জানি। কিন্তু তুই জানিস না। তুই তাকে জানলে তাকে এত বিশ্বাস করতি না।

নদী মাথা নাড়ল। দৃষ্টিটা ওঠানামাও করল। তারপর বলল, ভাইয়া, একটা কথা বলি। আজ এই যে আপনার সামনে বসে আছি, এটা কিন্তু রাকিব ভাইয়েরই অবদান। তার সঙ্গে মাউন্ট পিরংগিয়া না গেলে আপনার সঙ্গে এভাবে সেদিন পরিচয় হতো না। এ ছাড়া আমি যখন একটা কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছিলাম, তিনিই আমার উপকার করেন। আমার থাকার একটা স্থান ছিল না। এই তিনিই আমাকে নাজমুল ভাইয়ের বাসায় তুলে দেন। থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তারপর থেকেই আমি বাঙালিদের সংস্পর্শে আসি। তবে কিছু কিছু উচ্চশিক্ষিত বাঙালির সংস্পর্শ এসে আমার মনে হয়েছে, তারা যেন মানুষ না, এলিয়েন। তাদের প্রতি আমার ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে।

নাবিদ ঠিক কঠিন গলায় নয়, একটু ভারী গলায় বলল, তুই দেখছি তোর রাজীব চাচার মতোই হয়েছিস। নিজের যুক্তি বাদে অন্যের যুক্তি শুনতে চাস না।

নাবিদের এ কথায় নদীর সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। নদী মন খারাপ করে অসহায় দৃষ্টিতে নাবিদের দিকে তাকাল। নাবিদের এই কথার জবাবে সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারল না। নদী কিছুই বলল না।

নাবিদ এক মুহূর্ত চুপ থেকে কী ভেবে নিজ থেকেই বলল, সরি নদী, রাজীব চাচাকে নিয়ে আমার এই মন্তব্যটা তুই অন্যভাবে নিস না। তিনি কিন্তু আমার খুব প্রিয় ছিলেন।

নদী এবারও কিছু বলল না।

নাবিদ বলল, থাক ওসব কথা। সময়ই তোকে সব বলে দেবে। তবে কথা কী, তোর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে বড়ভাই হিসেবে এই অধিকারটুকু হয়তো এখন খাটাতাম না। এখন যেহেতু পরিচয় হয়ে গেছে, তাই একটু-আধটুকু অধিকার আমি তোর ওপর খাটাবই। আর আমি অবশ্যই তোর ভালো-মন্দ দেখতে যাব।

নদী এবারও কিছু না বললেও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।

নাবিদ নিজ থেকেই মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, তোদের সম্পর্ক কী অনেক দূর এগিয়েছে?

: কীসের সম্পর্ক ভাইয়া?

: রাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক?

: তার সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

: সম্পর্ক নেই মানে, তাহলে?

: ভাইয়া, আমি রাকিব ভাইকে শ্রদ্ধা করি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা শ্রদ্ধার। তিনিও আমাকে যথেষ্ট সম্মান দেন। আজ এতগুলো মাস হয়ে গেছে তার সঙ্গে পরিচয়। হ্যামিল্টনের কাছাকাছি অনেক জায়গায় তার সঙ্গে ঘুরতেও গিয়েছি। কিন্তু কোনো দিন তার কাছ থেকে অশালীন বা অসম্মানজনক আচরণ পাইনি। ভুল করেও তিনি আমার দিকে কখনো খারাপ দৃষ্টিতে তাকাননি।

: বলিস কী!

: জি ভাইয়া। বাবা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজন ছাড়া ঢাকা শহরে একা একা বড় হয়েছি। মা আর কতক্ষণ আমাকে দেখে রাখতে পারতেন। আমি ভালো-মন্দ বুঝি। ভালো ছেলে, মন্দ ছেলের ব্যাপারটা বিচার করতে আমার এক মুহূর্ত দেরি হয় না। বলেই নদী এক মুহূর্তের জন্য থামল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ভাইয়া, আপনারা তাকে যতই খারাপ হিসেবে দেখেন, আমার এতে কিছু যায়-আসে না। তিনি আমার দেখা সবচেয়ে সেরা মানুষটি। আমার মা কবিতা লেখেন। রাকিব ভাইও কবিতা লেখেন। কবিদের মধ্যে যে বিরাট একটা সততা বসবাস করে, তা আমি আমার মা ও রাকিব ভাইয়ের মধ্যে দেখেছি। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1566874