জ্বালো আলো, ঘুচাও কালো

দীপাবলির আলোকসজ্জা
দীপাবলির আলোকসজ্জা

দীপাবলি বা ফেস্টিভ্যাল অব লাইটস দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই পরিচিত একটি উৎসব। বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর জন্য দুর্গাপূজার পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব কালীপূজা। আর কালীপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে দীপাবলি। অন্ধকারকে মুছে দিয়ে আলোর আলোয় ভরিয়ে দিতে এ উৎসব ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বলতে গেলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েই দীপাবলি (Dewali) একটি জনপ্রিয় উৎসব। বিশেষত পশ্চিম ভারতে হিন্দু, শিখ, জৈন ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর একাংশের জন্য দীপাবলি সর্ব বৃহৎ উৎসব।

বাঙালি হিন্দুরা যেমন কালীপূজার দিনে দীপাবলি পালন করে থাকেন, অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনে ভিন্ন ভিন্ন উৎসব পালন করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ জৈনরা এই দিন মহাবীরের মুক্তি দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন। শিখেরা পালন করেন মুঘলদের কারাগার থেকে গুরুদেব হরগোবিন্দের মুক্তি লাভের দিন হিসেবে। তবে যে যেভাবেই পালন করুন না কেন দীপাবলিতে আলো জ্বালানোর রীতি সব জায়গাতে একই। ভারত ছাড়াও ফিজি, মালয়েশিয়া, মরিসাস, মিয়ানমার, নেপাল, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুরিনাম এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এদিন সরকারি ছুটি থাকে।

ফেস্টিভ্যাল অব লাইটস
ফেস্টিভ্যাল অব লাইটস

আমার ছেলেবেলায় প্রতিবছর দীপাবলির দিন অসংখ্য মাটির প্রদীপ বানাতাম আমরা সবাই। যৌথ পরিবারে সবাই মানে কাকাতো, জ্যাঠাতো, পিসতুতো ভাই-বোনেরা। বড়রা অর্থাৎ মা-জেঠিমারা সলতে পাকাতেন এই সব প্রদীপে আলো জ্বালাবার জন্য। প্রদীপ বানিয়ে সারা দিন রোদে শুকানো হতো যেন রাতে ঠিকমতো জ্বলে। আমার বাবা থাকতেন এসবের নেতৃত্বে। তিনি কলাগাছ কেটে ভেলার মতো তৈরি করতেন, আর এই ভেলার ওপরে ছাউনি দিয়ে তৈরি হতো নৌকা। বাড়ির ছোটদের জন্য এমন exciting আর আনন্দঘন দিন আর ছিল না। রাতে একে একে জ্বলে উঠত শত শত প্রদীপ। সারা বাড়ি আলোয় ঝলমল করত। এসব প্রদীপের কয়েকটি দিয়ে সেজে উঠত কলাগাছের নৌকা। এই নৌকা বাড়ির পাশের বারাসিয়া নদীতে ভাসানো ছিল দীপাবলির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ।

আমরা আরও একটু বড় হওয়ার পর প্রতিবছর কালীপূজায় গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো না। শহরের দীপাবলি হতো মোমবাতি জ্বালিয়ে। আমার কাছে মনে হতো দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো। কিন্তু শহরের ব্যস্ত জীবনে এত মাটির প্রদীপ কে বানাবে, আর কলাগাছের নৌকোই বা কোথায় পাওয়া যাবে। আলো জ্বেলে অন্ধকার দূর করাই হচ্ছে এ উৎসবের মূল লক্ষ্য—সে আলো মাটির প্রদীপের না মোমবাতিরই সেটা বড় বিষয় নয়। তবে ছেলেবেলার সেই দীপাবলি সব সময় মিস করি।

ক্রিসমাসে আলোকসজ্জা
ক্রিসমাসে আলোকসজ্জা

জীবনে প্রথম পরিবার পরিজন ছেড়ে নেদারল্যান্ডসে পড়তে যাওয়ার মাস দেড়েক পরেই দীপাবলি এল। ওখানে প্রচুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত মরিশাসের অধিবাসী। তারা মহাসমারোহে এ উৎসব পালন করেন। ভারতীয় ও নেপালি বন্ধুদের সঙ্গে আমিও যোগ দিলাম আলোর উৎসবে। এরপর অস্ট্রেলিয়াতে প্রবাসী হয়ে এখানেই আলো জ্বালিয়ে চলেছি। বেশ কয়েক বছর ধরে পার্থে কেন্দ্রীয়ভাবে দীপাবলি উদ্‌যাপন করে সরস্বতী মহাবিদ্যালয় ও অন্নলক্ষ্মী রেস্টুরেন্ট যৌথ উদ্যোগে। এই মহতী উদ্যোগের কারণে পাশ্চাত্যের মানুষের মাঝে প্রাচ্যের সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ যেন দুই সংস্কৃতির এক মহা মিথস্ক্রিয়া।

অস্ট্রেলিয়াতে সবচেয়ে বড় উৎসব ক্রিসমাস বা বড়দিন। ধর্ম মানুক আর না মানুক ক্রিসমাস সকলে উদ্‌যাপন করে। নগরকেন্দ্রগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই। কর্মক্ষেত্রে ক্রিসমাস ল্যান্স, ক্রিসমাস পার্টি আরও কত আয়োজন। মানুষ নিজেদের বাড়ি রং বেরঙের আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে। বহু প্রবাসী বাঙালির বাড়িও এ সজ্জায় শোভা বর্ধন করে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এসব আলোকসজ্জা দেখে আমার মনে হয়েছে, সারা পৃথিবীজুড়ে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের উৎসব উদ্‌যাপনের নীরব ভাষা আসলে একই। সবাই চায় অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করতে। মাটির প্রদীপ, মোমবাতি আর বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জায় বহিরাঙ্গিক পার্থক্য যতই থাক না কেন, অন্তরের ভাষা তাদের একই—‘জ্বালো আলো, ঘুচাও কালো’।

এই প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়াকে মজবুত করতে আমরা আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারি। দীপাবলির উদ্‌যাপনকে গৃহের অভ্যন্তরে মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজ নিজ বাড়িতে আলোকসজ্জা করতে কোনো বাধা নেই। দীপাবলি সাধারণত অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে হয়। কাজেই এ আলোকসজ্জা কালীপূজায় শুরু হয়ে চলতে পারে ক্রিসমাস বা নিউ ইয়ার অবধি। এতে সংস্কৃতির মেলবন্ধন আরও মজবুত হবে। দিনে দিনে festival of lights যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তাতে বাড়িতে বাড়িতে আলোকসজ্জার প্রচলন নতুন মাত্রা যোগ করবে নিঃসন্দেহে। আর এভাবেই প্রাচ্যের সংস্কৃতি একদিন পাশ্চাত্যের মনোজগতে জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে।