সবুজ মেঘের ছায়া-চব্বিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাসপাতালে এসে এমন একটা দুঃসংবাদ শুনবে, রাকিব ও নদী মোটেও আশা করেনি। প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসনকে কিছুক্ষণ আগেই সিসিইউতে নিয়ে গেছে। তাঁর নাকি ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

অথচ প্রফেসর রজারসনের ড্রেন করে ফুসফুসের পানি বের করার পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। আগামী সপ্তাহেই তিনি হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে বাসায় ফিরে যেতেন। রাকিব ও নদী কত পরিকল্পনা করেছিল, প্রফেসর রজারসন বাসায় ফিরে গেলে তাঁকে মাঝেমধ্যে সময় দেবে। কাছে বা দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে। ডেকে বসে অমাবস্যা দেখবে। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোতে ভিজবে।

প্রফেসর রজারসনকে সিসিইউতে সেই যে ঢোকান হয়েছে, এখনো বের করার নাম নেই। এদিকে দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। অবশ্য সময়টাকে বলা যায়, সকাল ও দুপুরের সন্ধিক্ষণ। কিন্তু চারদিকে নিঃসীম। ওরা যেখানটায় বসে আছে, সেটা সিসিইউর সামনের ছোট্ট একটা লাউঞ্জ। লাউঞ্জে সেন্ট্রাল হিটার চলছে বলে বেশ উষ্ণতা বোধ হচ্ছে। কিন্তু তাদের মনের অস্থিরতা কিছুতেই যাচ্ছে না।

রাকিব ঘড়ি দেখল। এখন পুরোপুরি বারোটা বাজে। লাউঞ্জের জানালার কাচ গলে একটুকরো ধার কাটা আলো ভেতর এসে পড়েছে। ঘড়ির কাঁটাটা চলছে, টিক টিক, টিক টিক।

রাকিব দৃষ্টি ঘুরিয়ে নদীর দিকে তাকাল। নদীর উন্মুখ দৃষ্টি অপারেশন থিয়েটারের দরজার দিকে। আহা বেচারী! প্রফেসর রজারসনকে সে বাবার মতো মান্য করে। ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে নদী প্রথম ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে টিউশন ফি জমা দিয়ে এসেছিল। ভেবেছিল, সে হ্যামিল্টনে কোনো একটা পার্টটাইম চাকরি করে বাসস্থান ও আনুষঙ্গিক খরচ চালাবে। কিন্তু হ্যামিল্টনে এসে সে যেন সমুদ্রের পড়ে। অনেক জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করে কোথাও একটা পার্টটাইম চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। হ্যামিল্টনে একজন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের চাকরি পাওয়া মানে কোনো সোনার হরিণ হাতে পাওয়া।

বাংলাদেশে নদীর অবস্থা তেমন ভালো নয়। বাবাতো মারা গেছেন তার জন্মের আগেই। শুধুমাত্র মা আছেন। যিনি একটা সরকারি কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়ান। তিনি তিল তিল করে টাকা জমিয়ে নদীকে উচ্চশিক্ষার জন্য নিউজিল্যান্ডে পাঠিয়েছেন।

ঠিক এ অবস্থায় নদী হ্যামিল্টনে কী করবে ভেবে না পেয়ে যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসন সাহায্যের হাত বাড়ান। ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটিতে নদীর স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেন। তারপর থেকেই তিনি নদীর মনে বাবার আসন গেড়ে বসে আছেন।

রাকিবের মনে অবশ্য প্রফেসর রজারসন এতটা প্রভাব ফেলতে পারেননি। যদিও শেষের প্রফেসর রজারসনের সঙ্গে রাকিবের একটা শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই এ মুহূর্তে কেন জানি বারবার প্রফেসর রজারসনের চেহারাটা রাকিবের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। একজন বৃদ্ধের মুখ। হাসিখুশি ও প্রাণোচ্ছল। বেশ কৌতুক প্রবণ। ভালো রহস্যও করতে জানেন।

প্রফেসর রজারসনের কথা ভাবতে ভাবতে রাকিব তার বাবার কথা ভাবল। তার বাবা মারা গেছেন কত বছর আগে। পনেরো বছর তো হবেই। রাকিব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনার্সে দ্বিতীয় বছরে উঠেছে। একদিন বড় চাচা অফিস থেকে ফিরে বিকেলে তার বাবার মৃত্যু সংবাদটা দেন।

নদীর না হয় জীবনে বাবার প্রভাব কখনই ছিল না। নদী যখন তার মায়ের পেটে, তখন তার বাবা মারা যান। কিন্তু রাকিব?

রাকিব ভাবল, তার জীবনে কি কখনো তার বাবার প্রভাব ছিল? একটু স্নেহ, একটু ভালোবাসা, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া! সেই চার বছর বয়সে মা তাকে ফেলে চলে যান। তার বাবা এতই হাবাগোবা ছিলেন যে, দিন-রাতের পার্থক্য বোঝার জন্য মানুষের যে একটা অতি ছোট্ট জ্ঞান থাকে, সেই জ্ঞানটাও তাঁর ছিল না।

রাকিবের মনে পড়ল, সে যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ত তখন তার বাবা লুঙ্গিটা অর্ধেক কাছা দিয়ে ও একটা শার্টের বোতাম অর্ধেক না লাগিয়ে শুধু শুধুই স্কুলে চলে আসতেন। স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরত। কেউ কেউ গান বাঁধত—

‘ফরা কাজী, ফরা কাজী
নাকে হিঙ্গুল, দাঁতে ঘি
লুল পড়ে, ই-হিঁ, ই-হিঁ
ফরা কাজী, ফরা কাজী।’

রাকিবের বাবার নাম ছিল কাজী ফরিদ উদ্দিন। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে ফরা কাজী বা বেপতার কাজী হিসেবে ডাকত। সেই ছোট বয়সেই রাকিব তার বাবাকে নিয়ে কী বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই না পড়েছে। এ সব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে সে নিজে নিজে কত যে কেঁদেছে! রাকিব তার বাবাকে স্কুলে আসতে দেখলেই স্কুলের পেছনের সারি সারি আমগাছের আড়ালে লুকিয়ে যেত।

হাইস্কুলে ওঠার পর রাকিবের এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি আরও বেড়ে যায়। তার বাবা শুধু শুধুই স্কুলের টিচার্স রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কাজী বাড়ির মানুষ বলে কখনো কোনো শিক্ষক যদি তার বাবাকে চা-বিস্কুট খাওয়ার কথা বলতেন তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গেই গিয়ে বসে যেতেন। তারপর দেখা যেত তিনি প্রায় প্রতিদিনই সেই শিক্ষকের সামনে শুধু শুধুই হাসতেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। শিক্ষকেরা হয়তো একদিন-দুদিন চা-বিস্কুটের কথা বলতেন। কিন্তু পরে আর বলতেন না। কোনো কোনো শিক্ষক তার বাবার সঙ্গে কুৎসিত ভঙ্গি করে ঠাট্টা করতেন। স্কুলের অন্য ছাত্ররা রাকিবের কাছে গিয়ে এসব ব্যাপারগুলো আরও রস লাগিয়ে বলত, এই রাকিব, তোর বাবা এসেছে যে। দেখ গিয়ে, টিচার্স রুমের সামনে কেমন হা করে তাকিয়ে আছেন। যা না, তোর বাবার কাছে যা। হে হে হে হে...!

রাকিব তার বাবাকে ভালোবাসত। অনেক ভালোবাসত। কেউ তার বাবাকে কিছু বললে সে হয়তো প্রতিবাদ করতে পারত না ঠিকই, কিন্তু নীরবে কাঁদত। মাঝেমধ্যে সেই বয়সেই সে বাবাকে গিয়ে ধমকাত, তিনি যেন স্কুলে না আসেন...।

বাবা কখনো শুনতেন, কখনো শুনতেন না।

একদিন হঠাৎ করেই তার বাবা স্কুলে আসা বন্ধ করে দেন। রাকিব স্বস্তি পায়। কিন্তু পরে সে জানতে পারে, তার বাবা হিরণের মায়ের বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকেন। হিরণের মা বিধবা ছিল। বাড়িতে সে একাই থাকত। তার একমাত্র ছেলে হিরণ ঢাকায় কারও বাসায় কাজ করত।

প্রথম প্রথম তার বাবা ও হিরণের মায়ের ব্যাপারটা নিয়ে গ্রামের কেউ মাথা ঘামাত না। তার বাবা তো এমনই। যেখানে সেখানে যান। কারও বাড়িতে গিয়ে সারা দিন এমনিই বসে থাকেন।

কিন্তু কিছুদিন যেতেই ব্যাপারটা আর সাধারণ থাকে না। সবার মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে। বছর ঘুরতেই শোনা যায়, হিরণের মা পোয়াতি।

এদিকে রাকিবের বাবা বাড়িতে জেদ ধরেন, তিনি হিরণের মাকে বিয়ে করবেন। হিরণের মায়ের পেটের বাচ্চাটা তার। গ্রামেও তিনি ঘরে ঘরে মানুষকে এ কথা বলে বেড়াতে শুরু করেন।

এ কথা শুনে একদিন বড় চাচা ব্যাপারটা সামলানোর জন্য ঢাকা থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। বড় চাচা তখন যুগ্মসচিব। এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে তার ওঠা-বসা। গ্রামে এলে মানুষ লাইন ধরে চাকরির জন্য। এ অবস্থায় তার ভাইয়ের এমন একটা কেলেঙ্কারি...!

রাকিবের স্পষ্ট মনে আছে, তখন সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। একদিন স্কুল থেকে এসে সে দেখে, তার বড় চাচা বাড়িতে তার বাবাকে মোটা রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে কোমরের বেল্ট দিয়ে পেটাচ্ছেন। তার বাবার সে কী কান্না! তখন সকাল-দুপুরের সন্ধিক্ষণ ছিল। তার বাবাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল পশ্চিমের আমবাগানের একটা আমগাছের সঙ্গে। কোমরের বেল্ট দিয়ে পিটানোর পর তার বাবার মুখ থেকে অনবরত লালা ঝরছিল।

রাকিবের দূর থেকে এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। বড় চাচার ওপর কথা বলার মানুষ শুধু তাদের বাড়িতে নয়, দুই-চার গ্রামে ছিল না।

তারপর তার বাবার আর কিছুই হয়নি। হাবাগোবা মানুষ। একবার বউ হারানোর কান্নায় অনেক দিন কেঁদেছিলেন। পরে হিরণের মাকে ভালোবেসে গোমতির পাড়ে গিয়ে আরও অনেক দিন কেঁদেছেন।

কিন্তু হিরণের মা আর গ্রামে থাকতে পারেনি। বড় চাচা তাকে কাজ দেওয়ার নাম করে ঢাকায় নিয়ে কোথায় কাজ দিয়েছিলেন, তা গ্রামের মানুষ থাক দূরের কথা কাজী বাড়ির কেউ জানতে পারেনি। পরে হিরণের মা আর কোনো দিন গ্রামে ফিরে আসেনি। হিরণের মার এক টুকরো সম্পত্তি পরে বড় চাচার নামে হয়ে যায়।

বাবার মৃত্যুতে রাকিব যে খুব একটা কেঁদেছিল, তা নয়। ভালোবাসা ছিল। কষ্ট ছিল। ভেতরগত ভালোবাসা ও অন্তরগত কষ্ট। কিন্তু তবুও রাকিব বাবার মৃত্যুতে কাঁদেনি।

রাকিব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দৃষ্টিটা ওঠা-নামা করল। অযথাই ছোট্ট লাউঞ্জটার এপাশ-ওপাশ দেখল। কিছুক্ষণ আগের ছোট্ট রোদের ফালিটা এখন আর নেই। বাইরের রোদটাও কেমন মিইয়ে এসেছে। ঘড়ির কাঁটা চলছে টিক টিক, টিক টিক।

নদীর তখনো সিসিইউর দরজার দিকে উন্মুখ দৃষ্টি।

ঠিক তখনই সিসিইউর দরজা ঠেলে দুজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।

নদী লাফিয়ে উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাউ ইজ মিস্টার রজারসন?

একজন ডাক্তার নির্জীব গলায় বললেন, হি ইজ নো মোর...! (সপ্তম পর্ব সমাপ্ত)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: