একটি সরল নদীর গল্প-এক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেলের রোদে দুজনের ছায়া দিঘল আকৃতি ধারণ করেছে। রাকিব আর নদী পার্কের ঘাস মাড়িয়ে পাশাপাশি সমান্তরালে হাঁটছে। রোদটা বেশ নরম। যদিও তির্যক রোদটা সরাসরি ওদের চোখে এসে পড়েছে, কিন্তু ওদের চোখ জ্বালা করছে না।

রাকিব জিনসের প্যান্টের সঙ্গে শার্ট-সোয়েটার ও একটা ভারী লেদারের জ্যাকেট পরেছে। নদীর পরনেও জিনসের প্যান্ট। নদী জিনসের প্যান্টের সঙ্গে ফতুয়া, ফতুয়ার ওপর লম্বা ও ভারী ওভারকোট পরেছে। ওভারকোটটা ছাই রঙের। শীতটা এ সপ্তাহে বেশ জেঁকে পড়েছে। দক্ষিণ দ্বীপের বেশির ভাগ শহরে বেশ তুষারপাত হয়েছে। কোথাও কোথাও তুষার জমেছে প্রায় মিটার উঁচু। উত্তর দ্বীপের কোনো কোনো শহরে ত্রিশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে তুষারপাত হয়েছে। স্থানে স্থানে পুরু স্তরে বরফ জমেছে।

নদী দাঁড়িয়ে আছে প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসনের বাড়িটার দিকে মুখ করে। নদী যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা ঠিক ফুটপাত নয়। অপ্রশস্ত একটা পার্ক। পার্কটার নাম ডেলিকার পার্ক। ডেলিকার পার্কের ঘাস মাড়িয়ে তার দৃষ্টিটা পুরোপুরি স্থির। রাকিবও তার পাশে। তবে রাকিবের দৃষ্টিটা তার মতো স্থির নয়। রাকিব থেমে থেমে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টি কখনো নদীর ওপর স্থির হচ্ছে, কখনো পার্কে। কখনো বা পার্কের পাশের ওয়াইকাটো নদী, স্টেট হাইওয়ে ওয়ানের বাইপাস কনহ্যাম ড্রাইভ ও তার পাশের গাছগাছালিতে গিয়ে থামছে।

নদী বলল, দেখেছেন, কীভাবে দুই সপ্তাহ চলে গেল?

রাকিব বলল, হ্যাঁ, সময় বড় অদ্ভুত!

: সবকিছু আগের মতোই আছে। কিন্তু...!

: কিন্তু মানুষটা নেই, তাই তো?

: হ্যাঁ রাকিব ভাই। শুধু সময় নয়, সবকিছুই কেমন অদ্ভুত!

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, গ্রামের একটা কথা আছে, আজ মরলে কাল দুই দিন। আমার দাদি এ কথাটা খুব করে বলতেন।

নদী দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে প্রফেসর রজারসনের বাড়িটার দিকে আবার পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিতে তাকাল। একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। আজকে মরলে কালকে সত্যিই দুই দিন।

আজ শনিবার। দুই সপ্তাহ আগে এমনই এক শনিবারে প্রফেসর রজারসন মারা যান। তিনি মারা যান ঠিক দুপুরে।

প্রফেসর রজারসনের আত্মীয়স্বজনেরা তাঁর মারা যাওয়ার পরদিন থেকেই আসতে শুরু করেন। কেউ আসেন তাওরাঙা শহর থেকে। কেউ আসেন অকল্যান্ড থেকে। এ ছাড়া, ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-শিক্ষক আসেন। হ্যামিল্টনের বেশ কিছু বিশিষ্টজনও নিউস্টিড সমাধিতে তাঁর স্মৃতিচারণ করতে আসেন।

অকল্যান্ডের মানোকাউতে প্রফেসর রজারসনের যে ছেলে থাকে, সেই শুধু এসেছিল। প্রফেসর রজারসনের আর কোনো ছেলেমেয়ে তাঁকে দাফন করতে আসেনি। অবশ্য তারা বেশ দূরে দূরে থাকে। রাকিব ভাবল, এ এক আজব জীবন এখানকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। তাদের সবকিছু থেকেও নেই। সবকিছু পেয়েও তারা কিছুই পান না। মৃত্যুর পর তাদের একজন কান্নার মানুষ থাকে না।

নদী সেদিন খুব কেঁদেছিল। হাসপাতাল থেকে বাসা। পরদিন বিকেলে নিউস্টিড সিমেট্রির হলরুমে। নিউ স্টিড সিমেট্রির হলরুমে নদী প্রফেসর রজারসনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।

প্রফেসর রজারসন তাঁর বাড়িটা মারা যাওয়ার বেশ আগেই উইল করে ট্রাস্টকে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী তার ছেলেমেয়েদের কেউ এই বাড়ি থেকে একটা কানাকড়িও পাবে না। অবশ্য তাঁর ছেলেমেয়েরা যে সেই আশায় বসেছিল, তাও নয়। নিউজিল্যান্ডের জীবনযাত্রা এমনই। এখানে ছেলেমেয়েদের অনেকে বাবার সম্পত্তিকে নিজের সম্পত্তি মনে করে না। বাবার ফার্ম বা অফিসে ছেলেমেয়েদেরও ঘণ্টা হিসাব করে কাজ করতে হয়। অনেক ছেলেমেয়ে আঠারো পেরোতেই বাবা-মা অথবা সহায়–সম্পত্তির দিকে ফিরেও তাকায় না। সেই বয়স থেকেই তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।

বছর কয়েক আগে অকল্যান্ডে থাকাকালে রাকিব নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডে একটা মজার ঘটনা পড়েছিল। অকল্যান্ডের এক মিলিয়নিয়ার ভদ্রলোক তার কয়েক মিলিয়ন ডলারের বাড়ি ও সম্পত্তি মারা যাওয়ার আগে ছেলেমেয়েদের এক তোলা না দিয়ে তার প্রিয় কুকুরটার নামে উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন।

ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর সেই বাড়ি ও সম্পত্তি নিয়ে আইনগত সমস্যার সৃষ্টি হয়। কুকুর তো এসব বৈষয়িক কোনো কিছু বোঝে না। কিন্তু তারপরও কুকুরটার হয়েছিল রাজকীয় হাল। কুকুরটা মিলিয়ন ডলারের বাড়ি ও সম্পত্তির মালিক! ল ইয়ারের পক্ষ থেকে তিনজন কর্মচারী রাখা হয়েছিল কুকুরটাকে শ্যাম্পু করিয়ে গোসল করানো, সকাল-বিকেল দাঁত ব্রাশ করানো, সময়-সময় নখ কেটে দেওয়া, চিরুনি দিয়ে তিন-চার বেলা লোম আঁচড়ে দেওয়া ও সময়মতো টয়লেটে বা জগিংয়ে নিয়ে যাওয়া। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডে কুকুরটার ছবি যখন ছাপা হতো, তখন সেটার কী যে রাজকীয় ভঙ্গি থাকত...!

রাকিব বলল, নদী, চল আমরা হাঁটি।

নদী বলল, চলেন।

বিকেলটা প্রায় পড়ে এসেছে। শেষ বিকেলের নরম সোনালি রোদ ওয়াইকাটো নদীর দুই পাড়ের ঝুঁকে পড়া সারি সারি গাছগাছালিতে লেপটে রয়েছে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে হায়াস প্যাডকের কাছে চলে এল।

রাকিব পাঁচটা ওক গাছের দিকে তাকাল। ওক গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতাহীন ওক গাছগুলোর কেমন উদাস দৃষ্টি। কয়েকটা পাইন গাছ। নদীর ওপারে অসংখ্য গাছগাছালির মধ্যে একটা সাইপ্রাস গাছ উন্মুক্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। শেষ বিকেলের শীতের কুয়াশা হালকা হালকা ধোঁয়া হয়ে নদীর স্রোতের ওপর উড়ছে। স্রোতের বিপরীতে তিনটা হাঁস সাঁতার কাটছে। ঢেউয়ের বিপরীতে ঢেউ।

জেলিকো ড্রাইভ ও প্লাংকেট টেরেস ধরে কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি আসা-যাওয়ার করছে। দুই-চারজন মানুষ এদিক-ওদিক ফুটপাত ধরে বৈকালিক হাঁটা হাঁটছে। পরিবেশটা তেমন নিস্তব্ধ নয়। তবুও রাকিবের কাছে পরিবেশটা বেশ নিস্তব্ধ লাগছে।

নদী জিজ্ঞেস করল, কোথাও বসবেন?

রাকিব বলল, আমি বসব না। একটু ডকে গিয়ে দাঁড়াব। তুমি যাবে?

নদী বলল, আপনি যেখানে যাবেন আমি সেখানেই যাব।

: নরকে গেলেও?

: হ্যাঁ, নরকে গেলেও।

রাকিব মৃদু হেসে বলল, বেশ বেশ।

নদী বলল, তবে আমার একটা শর্ত আছে।

: কী শর্ত?

: আপনি ডকে দাঁড়িয়ে একটা কবিতা আবৃত্তি করবেন। নতুন যে কবিতাটা লিখেছেন।

রাকিব আবার মৃদু হেসে সায় দিল।

ওরা ডকে এসে দাঁড়াল। নদীতে তখন জোয়ারের টান। নদীর স্রোত পাড়ের বড় বড় পাথরে ও ডকে এসে আছড়ে পড়ছে-ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি ডাকছে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে কাটতে হাঁসগুলো ডাকছে-প্যাঁক প্যাঁক, প্যাঁক প্যাঁক।

নদী জিজ্ঞেস করল, কই, কবিতা আবৃত্তি করছেন না কেন?

রাকিব বলল, এর আগে একটা কথা বলতে চাই।

: কী কথা?

: আসলে কথা নয়, তোমাকে কিছু দিতে চাই।

: কী দিতে চান?

: তোমাকে আমার গাড়িটা দিতে চাই।

: নতুন গাড়িটা?

রাকিব হেসে বলল, আমার নতুন গাড়িটা নিবে?

নদী বলল, না।

: কেন নিবে না?

: আমি এত বড় গাড়ি পছন্দ করি না, তাই। টয়োটা প্রাডো! আপনি পাগল হয়েছেন?

: পাগল নয়, সত্যি বলছি।

: দেখুন, আমার সঙ্গে এ ধরনের মজা করবেন না। আমি জানি, আপনি এ ধরনের পাগলামি করার মানুষ নন।

: তুমি ভুল জেনেছ।

নদী এবার একটু কঠিন হয়ে বলল, কী ভুল জেনেছি?

নদীকে কঠিন হয়ে যেতে দেখে রাকিব হেসে ফেলল।

নদী জিজ্ঞেস করল, হাসছেন কেন?

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এমনিই। আচ্ছা, এবার মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমার আগের গাড়িটা আমি ট্রেড-ইন করিনি। ওরা গাড়িটার দাম খুব কম বলছিল। মাত্র তিন হাজার ডলার। অথচ আমি এমনি কারও কাছে বিক্রি করতে গেলে ছয় হাজার ডলারের ওপরে পাব।

: তাহলে আপনার আগের গাড়িটা কোথায়? আমি তো আপনার বাসার সামনে নতুন গাড়িটা দেখেছি।

: আগের গাড়িটা আমাদের অফিসের কার পার্কে রেখেছি।

: গাড়িটা যদি প্রাইভেটে বিক্রি করতে চান তাহলে বিক্রি করে দেন। শুধু শুধু তিন হাজার ট্রেড-ইন করার দরকার কী? ছয় হাজার ডলার পাবেন, ওটা ভালো না?

: গাড়িটা আমি তোমাকে দিতে চাই।

: কী বললেন?

: তোমার একটা গাড়ির প্রয়োজন। আমি সেই গাড়িটা তোমার দেওয়ার জন্য রেখেছি।

নদী এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। তারপর কী ভেবে আস্তে করে বলল, আমি আপনাকে অত টাকা দেব কোথায় থেকে?

রাকিব বলল, তোমাকে টাকা দিতে হবে কেন?

নদী জিজ্ঞেস করল, আমাকে দিতে হবে না কেন?

রাকিবও এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। নদীর ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অযথাই পাড়ের ওক গাছগুলোকে দেখল। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা হাঁসগুলোর দিকেও সে একবার তাকাল। তারপর নদীর দিকে আবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, নদী, আমাদের কি এমন কোনো সম্পর্ক হয়নি যে তোমাকে একটা গাড়ি দিতে পারি?

নদী কিছু বলল না।

রাকিব বলল, আমি তো তোমাকে আমার নতুন গাড়িটা দিচ্ছি না।

নদী জিজ্ঞেস করল, কেন দিচ্ছেন না? গাড়ি দিলে নতুন গাড়িটা দেবেন।

: না, নতুনটা দিলে ওটা বাহুল্য মনে হবে।

: কেন বাহুল্য মনে হবে?

: সেটা তুমি ভালো করেই জানো।

: পুরোনো গাড়িটা দিলে কি বাহুল্য মনে হবে না?

: না, কারণ তোমার গাড়িটা প্রয়োজন। আমি তোমার প্রয়োজনটা দেখছি। আর তুমি তো একটা গাড়ি কিনবে বলেই পরিকল্পনা করেছিলে, তাই না?

নদী মাথা ঝাঁকাল। বেশ নরম দৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকাল। রাকিবের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি কি আপনার হাতটা ধরতে পারি?

রাকিব নরম হেসে বলল, হ্যাঁ, ধর।

নদী হাত বাড়িয়েও কেন জানি রাকিবের হাতটা ধরল না। বলল, থাক, আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

: কী কথা?

: আপনি কি নতুন গাড়িটা কিনেছেন আমাকে আপনার আগের গাড়িটা দেওয়ার জন্য?

রাকিব একটু চুপ থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন