যে ব্যবস্থার ফাঁদে অরিত্রীর জীবন গেল

নিপীড়নমূলক শিক্ষাব্যবস্থা কেড়ে নিল আরেকটি পরিবারের স্বপ্ন; একটি প্রতিভাবান তাজা প্রাণ। রাজধানী ঢাকার বিদ্যাপীঠ ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার খবরটি পড়ে খুবই অস্থিরতায় ভুগছি। পত্রিকার পাতা কিংবা টিভি অন করলে এই খবরটি ঘুরে ফিরে চলে আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সেই একই খবর। চাইলেও এ ঘটনা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। একটি অপমানিত ও পরাজিত একটি করুণ মুখ বারবার আমার চিত্রপটে ভেসে উঠছে। একটি তরুণ প্রাণের করুণ পরিণতির জন্য দায়ীদের ওপর ঘৃণা, ক্ষোভ ও ব্যক্তি হিসেবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে না পেরে নিজের ওপর খুব রাগ এবং নিজেকে খুবই ক্ষমতাহীন মনে হচ্ছে।

এই ঘটনাটি শোনার পর থেকে আমার মনের মাঝে নানা প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের কাছে পায়ে ধরে মাফ চাইতে হবে? কেন অভিভাবককে শিক্ষকের কক্ষে বসতে দেওয়ার মতো সৌজন্য দেখানো হবে না? নকল করার অপরাধে কেন স্কুল থেকে টিসি দিতে হবে? চরম শাস্তি দিয়ে শিক্ষকেরা কী অর্জন করতে চেয়েছিলেন? কেন অরিত্রীকে ভিকারুননিসা স্কুলেই বা পড়তে হবে। ভালো স্কুল বলে পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার যদি এই হয়, তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কেমন। সরকারি-বেসরকারির বাইরে মাদ্রাসা বোর্ড ও আবাসিক স্কুলগুলোর অবস্থাই বা কেমন।

অরিত্রীকে পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে যাওয়ার অপরাধে স্কুল থেকে টিসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সন্তানের সামনে বাবা-মাকে হেনস্তা ও অপমান করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের শাস্তি দেওয়ার আইনগত অধিকার স্কুল কর্তৃপক্ষের নেই। তার পরও স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ধরনের আচরণ করতে পেরেছিল তার কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। ক্ষমতার অপব্যবহারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরা যে পিছিয়ে নেই, ভিকারুননিসার শিক্ষকেরা জাতির সামনে তাই প্রকাশ করলেন।

শিশু মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষকদের ধারণার অভাব রয়েছে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। স্কুলের শিক্ষক হতে গিয়ে তাদের বেশ কিছু প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেখানে শিক্ষকদের শিশু শিক্ষার কৌশল, শিক্ষা মনস্তত্ত্ব, প্রণোদনামূলক শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষা পরিবেশ ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার যে মূলনীতিগুলো রয়েছে, সেগুলো শিক্ষকেরা কর্মক্ষেত্রে চর্চা করেন বলে মনে হয় না।

সমাজের অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সুশাসন ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার সংকটটি যে ভেতরে-ভেতরে প্রকট আকার ধারণ করেছে এই আত্মহত্যার ঘটনাটি তারই প্রমাণ দিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে রয়েছে ভয়ের এক সংস্কৃতি। শাসনের নামে শিক্ষার্থীদের নির্মম শাস্তি দেওয়া, শারীরিক নির্যাতন ও প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া নিত্যদিনের ঘটনা। শিক্ষা পদ্ধতি মূল্যায়ন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে শিক্ষকেরা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি অনুসরণ করেন না। প্রশিক্ষণ থাকার পরেও শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় নির্যাতনমূলক পদ্ধতিকেই বেছে নেন। কারণ কেউ পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতে চান না অথবা নির্যাতন করার মাধ্যমে বিকৃতি সুখে তৃপ্ত হন।

নেতিবাচক শিক্ষা পরিবেশে চাপে পড়ে শিক্ষার্থীরা হয়তো কিছু শিখে ফেলছে সত্য। তবে মানসিক চাপে তাদের মানসিক, বৃদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তি বিকাশ ব্যাপকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। যার নেতিবাচক ফলাফল হবে দীর্ঘকালীন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। শিক্ষার মূল নীতি থেকে সরে গিয়ে কৃত্রিমভাবে শিক্ষার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে প্রতিযোগিতা। নামী স্কুলে সন্তানকে পড়ানো, পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পাওয়া বা ক্লাসে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় সকলকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও ছাত্র ভর্তি থেকে হচ্ছে ব্যাপক বাণিজ্য। আর এসব বাণিজ্যে এগিয়ে আছে নামীদামি প্রতিষ্ঠানগুলো।

লেখক
লেখক

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল একটি সুস্থ পরিবেশে ছাত্র-ছাত্রীদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। অভিভাবক-শিক্ষক-আর ছাত্রের মধ্যে দায়িত্বশীল, সম্মানজনক ও সমন্বয়মূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা। আমরা সে লক্ষ্য থেকে অনেক বেশি দূরে চলে গেছি বলেই এসব ঘটনা বা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অরিত্রী ও তার পরিবারের সঙ্গে অমানবিক ও অশোভন আচরণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আর এর পেছনে সমাজ ও সাধারণ মানুষের অসচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অমানবিক ও নির্যাতনমূলক আচরণের একটি সামাজিক অনুমোদন রয়েছে।

সমাজ শিশুদের ‘গড়ে পিটে’ মানুষ করার যে এজেন্সিশিপ শিক্ষকদের দিয়েছে তাকে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। শাসনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলের মধ্যে নিয়ে আসা শিক্ষকদের কর্তব্য বলেই মনে করা হয়। আমাদের সময়ে অর্থাৎ সত্তর দশকে শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা পড়া না পারা বা অন্য কোনো ছোটখাটো ভুলত্রুটির জন্য অনেক শাস্তির মুখোমুখি হয়েছি। তার মধ্যে চড়, কিলঘুষি, থাপ্পড়, বেতের বাড়ি, কান ধরে ওঠবস, পায়ে ধরে মাপ চাওয়াসহ নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছিল খুবই স্বাভাবিক। কালে শহরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিশু নির্যাতনের মাত্রা কিছুটা কমলেও গ্রামাঞ্চলের স্কুল ও মাদ্রাসা–মক্তবে নির্যাতন এখনো খুবই মামুলি বিষয়। নেতিবাচক পরিবেশের চাপে প্রতিদিনই হয়তো অনেক বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে যায়; সেসব ঘটনার অনেক কিছুই হয়তো আমরা জানতে পারি না।

লাগামহীন শিক্ষা প্রশাসনের নির্দয় আচরণের জন্যই অরিত্রীকে প্রাণ দিতে হলো। এই ঘটনায় ক্ষমতার অপব্যবহার, কোমলমতি শিশুদের প্রতি মানসিক আঘাত ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি পরিবারগুলোর অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। শিক্ষক গ্রেপ্তার বা ছাত্র আন্দোলন এই পরিবেশ উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা জানি না। তবে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুশাসন, সুনীতি ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় করতে হবে। শিক্ষাকে পেছন ফেলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হতে পারে না। স্কুলে শিক্ষা পদ্ধতি কতটা বিজ্ঞানসম্মত, বিধিসম্মত ও আধুনিক তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলার দায়িত্ব গবেষণা ও মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার প্রয়োজনে।