আমাদের শিকড় বাংলাদেশেই

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধের কথা সবচেয়ে বেশি শুনেছি আমার মায়ের কাছ থেকে। মা বলতেন, তোর জন্ম তো এই স্বাধীন দেশে। কত রক্ত, কত ত্যাগের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ, তুইতো কিছুই দেখিসনি।

আমি খুব করে জানতে চাইতাম সেই যুদ্ধের কাহিনি। মা বলতেন আর আমি অপলক শুনতাম। মন খারাপ হয়ে গেলে মা বলতেন, আজ থাক অন্যদিন আবার বলব। এভাবেই মুক্তিবাহিনীর কথা, বুদ্ধিজীবীদের কথা, সাধারণ মানুষের কথা, রাজাকারের কথা শুনেই বড় হয়েছি। পরে ইতিহাস পড়ে আরও জেনেছি। যতই জেনেছি অবাক হয়েছি, দেশের সঙ্গেও বেইমানি করেছে কিছু মানুষ। আবার এই দেশেই জন্ম নিয়েছে বীরেরা, মুক্তিযোদ্ধারা, সূর্য সন্তানেরা।

গতকাল ১৪ ডিসেম্বর ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।

দেশের এই সূর্যসন্তানদের জানাই শ্রদ্ধা। ১৯৭১ সালে এই দিনে পাকিস্তানিরা আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। তারা বুঝে গিয়েছিল পরাজয় তাদের হতে চলেছে। তাই তারা খুঁজে খুঁজে পরিকল্পিতভাবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সূর্যসন্তানদের। দেশকে মেধাশূন্য করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। বিজয়ী বাঙালি যাতে ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য এই ঘৃণ্যতম কাজ করেছিল পাকিস্তানিরা। আর তাতে মদদ দিয়েছিল আলশামস বাহিনী, আলবদর ও রাজাকারেরা। আজ যদি আমাদের সেই সব বুদ্ধিজীবী বেঁচে থাকতেন দেশ আরও এগিয়ে যেত। ১৪ ডিসেম্বর ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল, তার সঠিক পরিসংখ্যান আজও কেউ দিতে পারেননি। তবে ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। ১৪ ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল।

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ–দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা অনেকের মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পান। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ–দেশীয় দোসর আলশামস বাহিনী, আলবদর ও রাজাকারেরা বুদ্ধিজীবীদের এতটা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল যে অনেককে তাঁদের স্বজনেরা চিহ্নিত করতে পারেননি। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা বাঁধা। কারও কারও শরীরে একাধিক গুলি। অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে। কী নির্মম, কী বীভৎসভাবেই না হত্যা করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের!

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুরু করে বুদ্ধিজীবীদের নিধনযজ্ঞ কার্যক্রম। পরিকল্পিতভাবে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী নিধন করা হয়েছিল। তাই, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই দিনকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ ঘোষণা করেন।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আলশামস ও রাজাকারদের সহায়তায় বাংলাদেশের বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে তাঁদের মিরপুর এলাকায় ফেলে রাখে। স্বাধীনতার পর সেখানে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্মরণে এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি মোস্তফা হালি কুদ্দুস। পরবর্তীতে ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের সম্মানে নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি স্মৃতিসৌধ। স্থপতি মো. জামী-আল সাফী ও ফরিদউদ্দিন আহমেদের নকশায় নির্মিত এ স্মৃতিসৌধ ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ বের করেছে।

বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের ফলে ৪৭ বছর পরও দেশ সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে আছে। অবশ্য বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে অর্থনৈতিকভাবে। কিন্তু একটা দেশ শুধু অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যায় না, পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানও দরকার। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে এ দেশ আরও অনেক এগিয়ে যেত সব ক্ষেত্রে।

আমি প্রবাসে প্রায় দীর্ঘদিন। আমার মা বলতেন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো না কেন, একটা কথা মনে রেখো, তোমার শিকড় এই বাংলাদেশে। পৃথিবীর আর কোনো দেশ এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়নি। তোমার দেশের গৌরবগাথা ইতিহাস আছে, আছে ঐতিহ্য। এ দেশের মাটির প্রতি কণায় লেগে আছে শহীদের রক্ত। বুদ্ধিজীবী, বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধারা এই মাটিতেই ঘুমিয়ে আছেন। তাঁদের নিয়ে লেখো। জানিয়ে দাও নতুন প্রজন্মকে। এ বছর দেশের মাটিতে ঘুমিয়ে গেছেন আমার মাও। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সবাইকে।