কানাজাওয়ায় বিজয়ের গৌরবগাথা

বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা
বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা

জাপান আর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় যেমন অসাধারণ মিল তেমনি দুই দেশের বন্ধুত্বের ইতিহাসও অনেক দিনের। এমন বন্ধু দেশে আমরা যারা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে এসেছি, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি আর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথার ইতিহাস প্রতিনিয়ত প্রবাসের নতুন প্রজন্মকে জানানোর তাগিদ অনুভব করি।

প্রতি বছরের মতো এবারও ছাত্রজীবনের শত ব্যস্ততা ভুলে প্রাণের বিজয় উৎসব আয়োজনে এগিয়ে আসেন কিছু নবীন প্রাণচঞ্চল ছাত্রছাত্রী আর কানাজাওয়া বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক দিনের পরিচিত মুখগুলো। আনোয়ার ভাই, সোহেল ভাই, ফণীভূষণ, মামুন ভাই, আশিক ভাই ও JAIST-এর শিক্ষার্থীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে উদ্‌যাপিত হয় এবারের মহান বিজয় দিবস।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

বলে রাখা ভালো, কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী JAIST (জাপান অ্যাডভান্স ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) মিলিয়ে ৪০ কিংবা তার কিছু বেশি বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী জাপান সরকারের শিক্ষা বৃত্তি বা অন্য বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করছেন।

এবারের আয়োজন ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা কানাজাওয়ার কাইকান অডিটোরিয়াম বাংলাদেশের পতাকা আর আশিক ভাইয়ের ডিজাইন করা চমৎকার ব্যানার দিয়ে সাজানো হয়। জাতীয় সংগীতের সুর মূর্ছনায় বাংলাদেশের বিজয়ের উৎসব শুরু হয়। নবীনদের ফুল দিয়ে স্বাগতম জানানোর পর তাদের প্রত্যেকের এই সূর্য উদয়ের দেশের নতুন অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাওয়া হয়। এরই ফাঁকে এক সময় দুপুরের খাবারের জন্য ডাকা হয় সবাইকে। ভাবিরা একে একে নিজেদের সযত্নে রান্না করা খাবার পরিবেশন করেন সকলের মাঝে।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

বিজয়ের এই উৎসব ছিল অন্য দেশের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার ধারণা দেওয়া ও বিজয়ের আনন্দে সকলকে শরিক করা। তাই বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য দেশ যেমন জাপান, ভারত, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার ছাত্রছাত্রীদের সরব অংশগ্রহণ ছিল। বাংলাদেশি খাবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন প্রত্যেকেই।

সকলের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, দেশাত্মবোধক গান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেবিনের 'মাগো ভাবনা কেন...শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি' গান যেন কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা বাঙালির তেজদীপ্ত বহিঃপ্রকাশ। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করিসহ বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বরাবরের মতো গানের অংশ মাতিয়ে রাখেন আনোয়ার ভাই, অরিন ভাবি ও সঞ্চিতা ভাবি ছাড়াও নবাগতরা।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

একে একে গেয়ে যাওয়া দেশাত্মবোধক গানগুলো কখনোবা বিজয়ের আনন্দে গলা ছেড়ে সবাই একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন, আবার কখনো মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী অরিনের সুমিষ্ট কণ্ঠের গানের অপেক্ষায় ছিল অনেকেই।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত করতে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ, ভারত আর থাইল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত ব্যান্ড দল। এ ছাড়া ছিল মজাদার কৌতুক, ধাঁধা আর আনন্দ আড্ডা। খানিক সময় পল দাদা আর বিজয় ভাইয়ের ধাঁধায় মশগুল ছিল অডিটোরিয়ামের সবাই। কৌতুক আর আনন্দ আড্ডার পর্ব বেশ জমিয়ে রাখেন JAIST-এর শিক্ষার্থীরা।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

ছোটদের চিত্রাঙ্কনের বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশি শিশুদের সঙ্গে জাপান ও অন্য দেশের শিশুরাও অংশ নেয়। সাদা কাগজে রং পেনসিল দিয়ে লাল সবুজের পতাকা ফুটিয়ে তুলতে পেরে শিশুদের যে উল্লাস তা ছুঁয়ে গেছে সবার মন। JAIST-এর শিক্ষার্থী রাজ্জাক রাজের সুনিপুণ ফটোগ্রাফি ছিল চোখে পড়ার মতো।

এমন চমৎকার আয়োজনে প্রতিবারই কিছু উদ্যমী মেধাবী শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসেন। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সোহেল ভাই আর সঞ্চিতা ভাবির চমৎকার বিজয়ের সাজ আর প্রাণচঞ্চল সঞ্চালনায় বিজয়ের উৎসব ছিল মুখর। কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কোনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করায় শহিদুজ্জামান সোহেল ভাইকে অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে সকলের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে স্বাগতম জানানো হয়।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির ছাত্র হিসেবে মাঝে মাঝেই সুযোগ হয় জাপানের বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিজের দেশের সংস্কৃতি আর ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করার। তেমনি কিছুদিন আগে কানাজাওয়া শহরের প্রথম সারির এক উচ্চবিদ্যালয়ে বেশ কয়েক দেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের প্রত্যেককেই নিজের দেশকে নিয়ে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর তাদের অবহিত করতে বলা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে এবং তাদের নিজেদের বিদ্যালয়ের দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের অবহিত করে।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

তাদের বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের শুরু হয় সকালের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান দিয়ে। আমি বলছিলাম আমার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা। সকালে বইপত্র শ্রেণিকক্ষের টেবিলে রেখে ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে পরে বিদ্যালয়ের মাঠে। সবাই একসঙ্গে হালকা ব্যায়াম শেষে বুকে হাত দিয়ে একসুরে জাতীয় সংগীত গেয়ে তারপরেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হয়! আমি খেয়াল করেছি এই বিষয়টি জাপানের এখানকার উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।

উপস্থিতির একাংশ
উপস্থিতির একাংশ

স্বাধীনতা, স্বদেশ, প্রিয় বাংলাদেশ, তোমার উন্নয়নে, বিজয়ে প্রবাসে আমরাও উদ্ভাসিত হই। আর তোমার বদনখানি মলিন হলে আমরাও সুদূরে নয়ন জলে ভাসি। শেষ করছি আমাদের বিজয় দিবসের ব্যানারের কথা দিয়ে—

বিজয়ের সূর্য মিশে আছে যেমন
লাল-সবুজের পতাকায়,
তেমনি মিশে আছে আমাদের
সৃজনে, মননে ও অমোঘ সত্তায়।
বিজয় শব্দটি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
কোটি বাঙালির প্রাণ জেগে উঠুক
বিজয়ের উজ্জীবিত মহিমায়।
...

সোহাগ মিয়া: পিএইচডি. শিক্ষার্থী, পরিবেশ রসায়ন, কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইমেইল: <[email protected]>