একটি সরল নদীর গল্প-এগারো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হেদায়েত হোসেন চার দিন আগেই এক রাতে এসে আজমল হোসেনের কিউই ফলের অরচার্ডে কাজ করা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। আজ সেই আশঙ্কা কেমন যেন সত্য হয়ে গেছে...! এখন আজমল হোসেনকে বাংলাদেশে চলে যেতে হবে। এখানে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই।

জাহিদ এই আকস্মিক ঘটনায় কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হাত-পা ছেড়ে ঘাসের ওপর বসে আছে। এখানটায় এতক্ষণ অরচার্ডের প্রায় সব শ্রমিকেরা একত্রে জড়ো হয়েছিল। আজমল হোসেনের ব্যাপারে ওদের কারও কিছু করার নেই। বাঙালি শ্রমিকেরা জাহিদের পাশে আরও বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে গেছে। এখন সবাই যার যার কাজে অরচার্ডের ভেতর ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। একেকটা কিউই ফলের গাছের ডাল কাটলেই আট ডলার। তাদের সারা দিনে অন্তত পঁচিশটা কিউই ফলের গাছের ডাল কাটতে হবে। তারপরই না তাদের দৈনিক দুই শ ডলার ইনকামের টার্গেট পূরণ হবে। মাসের শেষে ছয় হাজার ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় চার লাখ টাকা। কেউ কেউ আছেন একাই দৈনিক পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটা কিউই ফলের গাছের ডাল কেটে ফেলতে পারেন। অনেকে আবার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেন। তাদের তো মাসের শেষে বারো হাজার ডলার ইনকাম। বাংলাদেশি টাকায় আট লাখ টাকা...! তাই আজমল হোসেনের জন্য তাদের অযথা সময় নষ্ট করে কী লাভ? ওরা যতটুকু দুঃখ প্রকাশ করেছে, ততটুকুই যথেষ্ট। এ ছাড়া আজমল হোসেনের এহেন পরিস্থিতে তো কারও কিছু করার নেই।

কিন্তু জাহিদের তো মন মানছে না। ঘাসের ওপর হাত-পা ছেড়ে বসে আকাশপাতাল ভাবছে। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, আজমল হোসেন এ মুহূর্তে বেথেলেহ্যাম অরচার্ডে নেই। গত পাঁচ দিন ধরেই ওরা এই অরচার্ডে কাজ করছে। আর দুই দিন কাজ করলেই এই অরচার্ডটা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এরই মধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল!

জাহিদ ভেবে পেল না, আজমল স্যার কার এমন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন যে, তাকে ইমিগ্রেশন অফিসার ও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো? তিনি নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। বাংলাদেশে একটা কলেজের শিক্ষক ছিলেন। প্রায় সাড়ে ছয়-সাতটা বছর ধরে কী অসহায়ভাবেই না নিউজিল্যান্ডে পড়ে আছেন! মাত্র দুই কী আড়াই মাস হয়েছে তিনি নিউজিল্যান্ডে অবৈধ নাগরিক হয়েছেন। যাকে বলে ওভার স্টেয়ার। কিন্তু এই তাওরাঙ্গা-টিপুকি শহরে অনেকে আট-দশ বছর কিংবা আরও বেশি সময় বসবাস করেও তো ইমিগ্রেশন-পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে না। মাত্র আড়াই মাসে তিনি ধরা পড়ে গেলেন?

ঘণ্টাখানেক আগের দৃশ্যটা জাহিদের মনে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ করেই তিনজন পুলিশ অফিসার ও দুজন ইমিগ্রেশন অফিসার বেথেলেহ্যাম অরচার্ডে এসে হাজির হন। তারা সরাসরি আজমল হোসেনের কাছে গিয়ে তাকে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। ততক্ষণে জাহিদ সেখানে গিয়ে হাজির হয়। কিছুক্ষণ পর আরও কিছু শ্রমিক এসে সেখানে হাজির হন। এরই মধ্যে এক পুলিশ অফিসার ভদ্র ভাষায় আজমল হোসেনকে তাদের সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠতে বলেন। আজমল হোসেন বিমর্ষভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে অনুসরণ করে তাদের একটা গাড়িতে গিয়ে বসেন। ওরা মোট দুটো গাড়ি নিয়ে এসেছিল। একটা পিকআপ ভ্যান। একটা সিডান। গাড়ি দুটো আজমল হোসেনকে নিয়ে ধীর গতিতে বেথেলেহ্যাম অরচার্ড ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে মাত্র আধা ঘণ্টা সময়ের মধ্যে।

জাহিদ নিশ্চিত, ইমিগ্রেশন ও পুলিশ অফিসাররা আজমল হোসেনের সব তথ্য পাই পাই করে যাচাই করেই বেথেলেহ্যাম অরচার্ডে এসেছিল। নয়তো ওরা কেন আর কাউকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি? যদিও আজমল হোসেন বাদে এই অরচার্ডে আর কেউ নিউজিল্যান্ডের অবৈধ নাগরিক নয়।

জাহিদ সাধারণত কুসংস্কার বিশ্বাস করে না। কিন্তু আজ সকালে ড্রাইভওয়ে থেকে বের হওয়ার সময় একটা কালো বিড়াল তার গাড়ির চাকার নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিল। আজমল হোসেন বেথেলেহ্যাম অরচার্ডে এসেই ঘাসের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়েন। জাহিদের আজ দুপুরের আগে কিউই ফলের ডালে লেগে আঙুল কেটে যায়।

জাহিদ ভাবল, কিউই ফলের গাছের ডালে লেগে একটা আঙুল কাটতেই পারে। কিউই ফলের গাছের ডালগুলো পুরোনো ক্লিপ দিয়ে আটকানো। ড্রাইভওয়ে ধরে কালো বিড়াল যেতেই পারে। নিউজিল্যান্ডের মানুষ কালো-সাদা রং মাথায় নিয়ে বিড়াল পোষে না। আর আজমল স্যার কিউই ফলের বাগানে ঘাসের ওপর হোঁচট খেতেই পারেন। এখানে প্রায় প্রত্যেকটা অরচার্ডে খরগোশেরা গর্ত করে। কিন্তু তারপরও জাহিদের মনে ব্যাপারগুলো খচখচ করছে। আজমল হোসেন আজ এখানে ইমিগ্রেশন অফিসার ও পুলিশ অফিসারদের কাছে ধরা না পড়লে হয়তো সে এসব কিছু মাথাতেই আনত না।

জাহিদ এখন ঘাসের ওপর হাত-পা ছেড়ে বসে হেদায়েত হোসেনের অপেক্ষা করছে। হেদায়েত হোসেন দূরের একটা গ্রিনভ্যালি অরচার্ডে আছেন। ওখান থেকে আসতে কমপক্ষে চল্লিশ মিনিট লাগবে। এরই মধ্যে অবশ্য এক ঘণ্টা চলে গেছে। কিন্তু হেদায়েত হোসেন এখনো আসেননি।

জাহিদ হেদায়েত হোসেনকে ফোন দিতে গিয়ে কী ভেবে ফোন দিল না। ভাবল, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। তারপর না হয় ফোন দেবে। জাহিদ দৃষ্টির ওঠানামা করে একবার আকাশ দেখল, একবার সবুজ প্রান্তরের দিকে তাকাল। তারা আজ জি-ব্লকে কাজ করছে। বেথেলেহ্যাম অরচার্ডটা পাহাড়ের উঁচুনিচুতে বলে অরচার্ডের জি-ব্লক থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বেশ দূরে দূরে কৃষকদের বাংলো। কৃষকদের বাংলোর চিমনি দিয়ে এখনই ধোঁয়া উঠছে। এখনো পুরোপুরি বিকেল হয়ে আসেনি। দুপুর-বিকেলের সন্ধিক্ষণ বলা যায়।

জাহিদ ঘড়ি দেখল। সবে বিকেল তিনটা বাজে। সাধারণত ওরা পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে।

ঘাসের ওপর বসে থাকতে থাকতে জাহিদের একধরনের নিস্তব্ধতা পেয়ে বসল। আজ দিনটা বেশ পরিষ্কার। চারদিকে কাঁচা সোনা গলা রোদ পড়েছে। পাহাড়ের ঢালে রোদটা যেন সবুজ ঘাসের ওপর নরম বিছানা পেতে রেখেছে। বসন্ত আসি আসি করে আসছে না। শীতটাও কেমন যাচ্ছে না। বরং রাতে শীতটা আরও জেঁকে পড়ছে।

জাহিদের একটা সিগারেট টানতে ইচ্ছে হলো। প্যান্টের পকেটেই সিগারেটের প্যাকেটটা। লাইটারটাও সঙ্গে আছে। জাহিদ উঠে দাঁড়াল। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটারটা বের করল। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা শলা বের করল ঠিকই, কিন্তু সে ধরাল না। সে গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। আপাতত এখানে না বসে থেকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা টানবে। গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট টানার অভ্যাসটা তার দীর্ঘদিনের। এটা তার ভালোও লাগে।

গাড়িটা শেডের পাশে। জি-ব্লক থেকে শেডটা বেশি দূরে নয়। জাহিদ সেদিকে হাঁটতে শুরু করল। সবুজ ঘাস মাড়িয়ে সে ধীর পায়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। হেদায়েত হোসেন এলে এখানেই প্রথম আসবেন। সবার গাড়িগুলো এখানেই পার্ক করা।

জাহিদ গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেটটা ধরাল। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে নীলের ওপর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। তবে মেঘগুলো সূর্যের মুখে থেকে বেশ দূরে দূরে। শেডের এখান থেকে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ প্রান্তরটা দেখা যায় না।

জাহিদ ভাবল, হেদায়েত ভাই এত দেরি করছেন কেন? তিনি কী ইচ্ছে করেই দেরি করছেন? তিনি ইচ্ছে করে দেরি করতেও পারেন। একে তো আজমল স্যারের নিউজিল্যান্ডে বসবাস করা ও কাজ করার বৈধ অনুমতি নেই। এটা জেনেও হেদায়েত ভাই আজমল স্যারকে কাজ দিয়েছেন। এখন তাকে হয়তো বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে। ইনকাম ট্যাক্স অফিস ও ইমিগ্রেশন তাকে নিয়ে টানাটানি করতে পারে।

জাহিদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এবার দিঘল অরচার্ডের দিকে তাকাল। তার সামনে এফ-ব্লক। এরপরই জি-ব্লক। এমনিতেই সে কিউই ফলের বাগানের উইন্টার প্রুনিংয়ের কাজটা ভালো লাগে না। এখন স্যারের এই ঘটনার পর বাগানের প্রতিটা গাছ যেন কেমন হা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

জাহিদ কিউই ফলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কেমন উদাস হয়ে গেল। বিকেলের এক ফালি রোদ তার চেহারায় এসে পড়েছে। হঠাৎ সাইদ আহমেদের কথা তার মনে পড়ল। ভাবল, এই সাইদ ভাইই তো দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর আজমল স্যারকে বিভিন্নভাবে কাজ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। তাকে তো একটা ফোন দিয়ে আজমল স্যারের বিষয়টা জানানোর দরকার।

জাহিদ ভাবতে ভাবতেই প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। আর ঠিক তখনই সে হেদায়েত হোসেনের গাড়িটা দেখতে পেল। গাড়িটা গেট পেরিয়ে শেডের দিকেই আসছে।

জাহিদ সাইদ আহমেদকে ফোন না দিয়ে মোবাইলটা আবার পকেটে রেখে দিল।

হেদায়েত হোসেন শেডের কাছে গাড়িটা পার্ক করে নেমে বললেন, সরি জাহিদ, আমার একটু দেরি হয়ে গেল। ঝামেলার ওপর ঝামেলা। মালয়েশিয়ান ও চাইনিজ ওয়ার্কারদের নিয়ে ওমাহোর অরচার্ডে যে কাজ করাচ্ছি, তাদের কাজে নাকি মালিক খুব একটা হ্যাপি না। তাদের কাজ থামিয়ে দিয়েছে। আমাকে সেখানে গিয়ে ব্যাপারটা সামলে আসতে হয়েছে।

জাহিদ মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না।

হেদায়েত হোসেন বললেন, এবার আজমল স্যারের ব্যাপারটা কী হয়েছিল, তা প্রথম থেকে বলো।

জাহিদ সিগারেটটা শেষ করে ফিল্টারটা একটু দূরে ফেলে বলল, ওই তো, আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে জি-ব্লকের ভেতর যার যার লাইনে কাজ করছি। আজমল স্যার আমার পাশের লাইনেই ছিলেন। হঠাৎ দেখি, ঠিক জি-ব্লকের সামনে দুটো গাড়ি এসে থামল। একটা মিনি ভ্যান, একটা সাধারণ সিডান। মিনি ভ্যানটা ছিল পুলিশের গাড়ি। তবে আমি তখন বুঝতে পারিনি যে ওটা পুলিশের পিকআপ ভ্যান। পুলিশের কোনো সাইন ছিল না। একেবারে সাদামাটা ভ্যান গাড়ি। ভেবেছিলাম, মালিক পক্ষের কেউ কাজ দেখতে এসেছেন। আর সাধারণ সিডানটায় এসেছিল দুজন ইমিগ্রেশন অফিসার। তারা সরাসরি স্যারের কাছে চলে আসেন। স্যারকে এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। আমি ঠিক তখনই সেখানে গিয়ে হাজির হই।

হেদায়েত হোসেন নিজে নিজে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ।

জাহিদ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কোন ব্যাপারটা, হেদায়েত ভাই?

: স্যারের ব্যাপারটা।

: স্যারের কোন ব্যাপারটা?

: ওরা জানল কীভাবে যে আজমল স্যার বেহেলেহ্যাম অরচার্ডের জি-ব্লকে কাজ করছেন?

: আমি ঠিক জানি না।

: ওরা কি সরাসরি আজমল স্যারের লাইনেই গিয়েছিল, নাকি আর কারও লাইনে গিয়েছিল?

: না, সরাসরি আজমল স্যারের লাইনেই গিয়েছিল।

: আমি যা সন্দেহ করেছিলাম।

: কী সন্দেহ?

: আচ্ছা, আমি সেটা পরে বলছি। তুমি আমার আরেকটা কথার জবাব দাও। আজমল স্যারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশন অফিসার বা পুলিশ কি আর কারও সঙ্গে কথা বলেছে?

: না, আর কারও সঙ্গে কথা বলেনি।

: ওরা আর কাউকে তাদের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস জিজ্ঞেস করেছে?

: না, কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। এমন কী আমাকেও না।

: এর মানে, ওরা আজমল স্যারের ব্যাপারে স্পেসিফিক ইনফরমেশন নিয়ে এসেছে। স্যার এই অরচার্ডের কোন ব্লকে ও কোন লাইনে কাজ করে, ওটাও ওরা স্পষ্টভাবে জেনে এসেছে।

জাহিদ এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, হেদায়েত ভাই, ওটা তো আমার মাথায় আসেনি? ওটা কীভাবে সম্ভব হলো। ওদের কাছে এত নিখুঁত ইনফরমেশন গেল কোথায় থেকে?

হেদায়েত হোসেন বললেন, আমি ঠিক জানি না। হয়তো ওদের ইনফরমার আগে থেকেই লুকিয়ে আজমল স্যারের ওপর নজর রাখছিল। আর নয়তো এই অরচার্ডের আমার কোনো ওয়ার্কার তিন জয়নালের কোনো এক জয়নালের কাছে আজমল স্যারের ব্যাপারে ইনফরমেশন দিয়েছিল। তোমাকে তিন-চার দিন আগে এক রাতে তিন জয়নালের কথা বলেছি না? ওরা খুব খারাপ। নিজের দশ হাজার ডলার নষ্ট করে হলেও অন্যের ক্ষতি করবে? মরলে ওরা নিশ্চিত সরাসরি হাবিয়া দোজখে যাবে। ওরা শয়তানের চেয়েও বড় শয়তান।

জাহিদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, তার মানে, এই জি-ব্লকে যে কয়জন বাঙালি কাজ করে, তাদের কেউ...?

: বাঙালি নাও হতে পারে।

: তাহলে কারা?

: এখানে তো বাঙালি বাদেও সামোয়া-কুক আইল্যান্ডের ওয়ার্কাররা কাজ করছে। ওদের কেউ হতে পারে। আবার বাঙালিও হতে পারে।

: সেটা যেই হোক, একটা অমানবিক কাজ করছে। ব্যাপারটা যে স্যারের জন্য কী মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে...!

হেদায়েত হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ব্যাপারটা সত্যি অমানবিক ও আজমল স্যারের জন্য মর্মান্তিক।

জাহিদও একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জিজ্ঞেস করল, এখন স্যারের জন্য কী করা যায়, বলেন তো?

হেদায়েত হোসেন বললেন, এখন আজমল স্যারের জন্য কিছুই করার নেই। স্যারকে ডিপোর্ট করা এখন জাস্ট সময়ের ব্যাপার। কিন্তু আমি এখন কীভাবে যে এই সমস্যা থেকে বেঁচে যেতে পারি?

: জি, হেদায়েত ভাই, আপনি নিজেও স্যারের জন্য সমস্যায় পড়ে গেলেন।

: এই সমস্যা থেকে শুধু তুমি আমাকে বাঁচাতে পার।

: সেটা কীভাবে?

: আমার বাসায়, মানে তোমাদের স্লিপ আউটে পুলিশ সার্চ করতে আসবে। আজমল স্যারের কী অ্যাসেট আছে জানতে আসবে। তখন তোমাকে অনেক প্রশ্ন করতে পারে। তুমি শুধু একটা কথা বলবে, আজমল স্যার এ বাসায় তোমার সঙ্গে মাত্র এক সপ্তাহ ধরে থাকেন।

: সেটা কেমনে সম্ভব?

: সম্ভব না কেন?

: স্যার তো এর আগে হেস্টিংস শহরে আমার সঙ্গে সাড়ে পাঁচ বছর থেকে এসেছেন। ওদের কাছে সব রেকর্ড আছে।

: তা বুঝতে পারছি। হেস্টিংসের ব্যাপারটা এখানে না টেনে আনলেও হবে। আজমল স্যার যখন হেস্টিংসে ছিলেন তখন তিনি নিউজিল্যান্ডের টেম্পোরারি ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে হলেও লিগ্যাল ছিলেন। তুমি শুধু এখানকার কথা বলবে। তুমি বলবে, মাঝখানে এত দিন আজমল কোথায় ছিলেন, তুমি সেটা জানো না। গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই এসে তোমার বাসায় এসে উঠেছেন।

: আমি তো এ বাসায় প্রায় আড়াই মাস ধরে থাকছি।

: এ বাসায় তোমার থাকার সঙ্গে স্যারের থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। স্লিপ আউটটায় থাকার জন্য যে রেন্টাল অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে, সেটা তোমার সঙ্গে হয়েছে। আজমল স্যারের সঙ্গে নয়।

জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা, সেটা না হয় বললাম। পুলিশ জিজ্ঞেস করলে আমি বলব, স্যার গত সপ্তাহে হঠাৎ করে বাসায় এসে উঠেছেন। কিন্তু এতে আপনার লাভ হবে কী?

হেদায়েত হোসেন বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, এতে আমার অনেক লাভ হবে। পুলিশ আমাকেও আজমল স্যারের ব্যাপারে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করবে। কারণ আমি আজমল স্যারকে কাজ দিয়েছি। আজমল স্যার নিউজিল্যান্ডে ইলিগ্যালভাবে বসবাস করছেন। ওয়ার্ক পারমিট নেই। তাকে আমার কাজ দেওয়াটাও ইলিগ্যাল। মানে অবৈধ।

: আমি সেটা জানি।

: হ্যাঁ, এখন কথা হলো, আমি পুলিশকে বলব, আজমল স্যার হঠাৎ করেই এ সপ্তাহের প্রথমে আমার সঙ্গে কাজ করা শুরু করেছেন। আমি জানতাম না যে আজমল স্যার ইলিগ্যাল। তার বৈধভাবে কাজ করার কোনো অনুমতি নেই। তিনি ওভার স্টেয়ার।

: আপনি সেটা না হয় বললেন। তারপর?

: এতে আমি স্যারের ব্যাপারটায় পার পেয়ে যাব।

: কীভাবে? পুলিশ জিজ্ঞেস করবে না, আপনি আজমল স্যারের কাগজপত্র না দেখে কেন কাজ দিলেন?

: সেটা জিজ্ঞেস করলে বলব, আজমল স্যার দেব-দিচ্ছি করে দিচ্ছিলেন না। আর এখানে তো সব অফিশিয়াল কাজ কমপক্ষে দুই সপ্তাহের সময় নেয়। মিনিমাম টেন ওয়ার্কিং ডেজ। এ জন্যই তো তোমাকে বলছি। পুলিশ তোমাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, আজমল স্যার এক সপ্তাহ হয় এখানে এসেছেন। আর আমি বলব, এ সপ্তাহের শুরুতে তাকে আমার অধীনে কাজ দিয়েছি।

: আচ্ছা, হেদায়েত ভাই। আমি পুলিশকে তাই বলব। ডোন্ট ওরি।

: থ্যাংক ইউ জাহিদ। একটা কথা বলি, আমি তো আজমল স্যারকে কাজ দিয়ে কোনো অন্যায় করিনি। বরং সবকিছু জেনে রিস্ক নিয়ে কাজ দিয়েছিলাম। প্লিজ, কোঅপারেট মি। এমনিতেই আমার ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। তোমার ভাবি মারা গেল কিছুদিন আগে। এখন আজমল স্যারকে নিয়ে নতুন ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম। এখন লইয়ার ফি ও অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফি যে কত টাকা যায়?

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, হেদায়েত ভাই, আপনার লইয়ার ফি ও অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফি লাগবে কেন?

হেদায়েত হোসেন বললেন, তুমি তো কন্ট্রাক্টরি কর না, সেটা তুমি বুঝবে না। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন