একটি সরল নদীর গল্প-বারো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অরচার্ড থেকে ফেরার সময় গাড়ির পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে জাহিদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ আজমল হোসেন পাশের সিটে নেই। জাহিদের মনটা বেথেলেহ্যাম অরচার্ডে থাকতেই খারাপ হয়েছে। হেদায়েত হোসেনের শেষের কথাগুলো তার মোটেও ভালো লাগেনি। অন্য সময় হলে হয়তো মেজাজও খারাপ করত। কিন্তু আজ তার মেজাজ খারাপ করার মতো ধৈর্য নেই।

জাহিদ হেদায়েত হোসেনের শেষ কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকল। একজন মানুষ অসহায় হলে অন্য আরেকজনের মানবিকতা এত নিচে নেমে যায় কীভাবে?

এদিকে বিকেলটা প্রায় পড়ে এসেছে। জাহিদ ঘড়ি দেখল। পাঁচটা বাজে। সাধারণত কিউই ফলের বাগান থেকে জাহিদ পাঁচটার সময়ই কাজ ছেড়ে বাসায় ফেরে। আজ অবশ্য এতক্ষণ কাজ করেনি। আজমল হোসেনকে পুলিশ ও ইমিগ্রেশন অফিসার ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সেই যে কাজ ছেড়েছে, এতক্ষণ শুধু শুধুই কিউই ফলের অরচার্ডে সময় নষ্ট করেছে। আরও সময় নষ্ট করেছে হেদায়েত হোসেনের জন্য।

পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের তির্যক রশ্মিটা সরাসরি চোখে এসে লাগছে। জাহিদ যথাসম্ভব সূর্যের আলো থেকে তার দৃষ্টিটা আড়াল করে গাড়ি চালাচ্ছে। জাহিদ আপাতত বাসায় যাবে। বাসায় গিয়ে গোসল করে কাপড়চোপড় পরে তাওরাঙ্গা পুলিশ স্টেশনে যাবে। জাহিদ জানে, আজমল হোসেনের জন্য তার কিছুই করার নেই। কিন্তু তারপরও তার মন তো মানছে না। যদি অলৌকিক কিছু ঘটে! তাওরাঙ্গা পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পর কোনো পুলিশ অফিসার যদি বলেন, তুমি আজমল হোসেনকে বাসায় নিয়ে যেতে পার। আজমল হোসেন নির্দোষ...!

জাহিদ জানে, আজ এমন কিছুই ঘটবে না। নিউজিল্যান্ডে এসব আইনের প্রক্রিয়ায় অলৌকিক বলে কোনো শব্দ নেই। আজমল হোসেনকে আইন মেনেই বাংলাদেশ চলে যেতে হবে।

এ সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। জাহিদ দেখল, হেদায়েত হোসেনের ফোন। হেদায়েত হোসেনের ফোন দেখে তার মনটা কেন জানি আবার খারাপ হয়ে গেল। মানুষ নিজের স্বার্থটা এত ভাবতে পারে?

জাহিদ রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামিয়ে ফোন ধরল। তার গাড়িটা পুরোনো বলে গাড়িতে ইনবিল্ড ব্লু-টুথ নেই। জাহিদ একটা ব্লু-টুথ ডিভাইস মাঝেমধ্যে কানের ওপর ঝুলিয়ে রাখে। আজ সেটা সে নিয়ে আসেনি।

জাহিদ বলল, জি, হেদায়েত ভাই, বলেন।

হেদায়েত হোসেন বললেন, তুমি কি বাসায় চলে গেছ?

জাহিদ বলল, না, এখনো রাস্তায়।

: এত দেরি?

: আপনি বেথেলেহ্যাম অরচার্ড থেকে চলে যাওয়ার পর আমি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম।

: কেন? আর কোনো সমস্যা হয়েছিল নাকি?

: না না, আর কী সমস্যা হবে?

: তাহলে দাঁড়িয়েছিলে কেন? আবার কাজ শুরু করেছিলে?

: না, আসলে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল তো, তাই গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

: পরে অরচার্ডের আর কারও সঙ্গে কথা হয়েছে?

: না, ওরা কাজ শেষ করার আগেই আমি অরচার্ড থেকে বের হয়ে গেছি। এখন বাসার কাছাকাছি আছি।

: ও আচ্ছা। বলেই হেদায়েত হোসেন একটু থামলেন। তারপর বললেন, শোনো জাহিদ, একটা জরুরি কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কী জরুরি কথা?

: আজমল স্যার টাকাপয়সা কী ব্যাংকে রাখতেন নাকি বাসায় রাখতেন?

: হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন হেদায়েত ভাই?

: প্রশ্নটা এ কারণে করছি, বাসায় আজমল স্যারের কী কী অ্যাসেট আছে, তা দেখতে পুলিশ আসতে পারে।

: পুলিশ না হয় আসল। আমি কী করব?

: না মানে, আজমল স্যারের টাকাপয়সা যদি ব্যাংকে থাকে, সেটা অন্য কথা। পুলিশ এমনিতেই স্যারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সিজ করবে। আর বাসায় টাকাপয়সা থাকলে পুলিশ সেই টাকাপয়সার খবর জানবে না। তুমি ইচ্ছে করলে স্যারের টাকাপয়সাগুলো আমার কাছে রাখতে পার। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে যাব।
অন্য সময় হলে জাহিদ হেদায়েত হোসেনের কথাগুলো সহজেই মেনে নিত। এমন কী আজ দুপুরেও যদি হেদায়েত হোসেন এই কথাগুলো বলতেন, জাহিদ বিনা বাক্যে মেনে নিয়ে বলত, আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু কতক্ষণ আগে বেথেলেহ্যাম অরচার্ডে হেদায়েত হোসেনের শেষ কথাগুলো জাহিদকে বেশ পীড়া দিয়েছে। মানুষের চেহারা মুহূর্তে এমনে বদলে যায়?

জাহিদ বলল, হেদায়েত ভাই, বাসায় স্যারের তেমন কোনো টাকাপয়সা নেই।

হেদায়েত হোসেন বললেন, ও, আচ্ছা। আমি এখন তাহলে টেলিফোন রাখি।

জাহিদ হ্যাঁ বা না কিছু বলল না।

হেদায়েত হোসেন ওপাশে ফোনের লাইন কেটে দিলেন।

জাহিদ কানের কাছ থেকে মোবাইলটা নামিয়ে দিঘল রাস্তার দিকে তাকাল। রাস্তায় বেশ গাড়ি আসা যাওয়া করছে। কেউ অফিস ফেরত, কেউ অরচার্ড থেকে কাজ করে ফিরছে। জাহিদের একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে হলো। তার মাথার ভেতর হেদায়েত হোসেনের ব্যাপারটা নিয়ে একটা জট পাকিয়ে আছে। কিছুতেই সে জটটা খুলতে পারছে না। কিছুক্ষণ ধরে সে একটা বিষয় ভাবছে, আচ্ছা, আজমল স্যারের আজকের এই ইমিগ্রেশন ও পুলিশের ব্যাপারটায় হেদায়েত ভাইয়ের হাত ছিল না তো? চার দিন আগেই তো তিনি রাতে এসে ইনিয়ে-বিনিয়ে আজমল স্যারকে নিয়ে অনেক আলাপ করেছেন। হঠাৎ করে তিন জয়নালের প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিন জয়নাল কী তাহলে একটা বাহানা ছিল মাত্র?

জাহিদ ভাবতে ভাবতেই গাড়ি থেকে নামল। মোবাইলটা প্যান্টের এক পকেটে রেখে আরেক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটারটা বের করে একটা সিগারেট ধরাল। তার হঠাৎ মনে হলো, সাইদ আহমেদের সঙ্গে তার কথা বলা প্রয়োজন। তিনিই তো আজমল স্যার ও তাকে কিউই ফলের অরচার্ডে কাজ করার জন্য হেদায়েত হোসেনের কাছে পাঠিয়েছিলেন।

জাহিদ সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে পকেট থেকে আবার মোবাইলটা বের করে সাইদ আহমেদকে ফোন দিল। তিনবার রিং বাজতেই সাইদ আহমেদ ফোন ধরলেন।

ফোন ধরেই সাইদ আহমেদ বললেন, কী ব্যাপার জাহিদ, এত দিন পর আমার কথা মনে পড়ল?

জাহিদ বলল, সাইদ ভাই, এত দিন পর মনে পড়েনি। আপনার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। কিন্তু সারা দিন কিউই ফ্রুটের অরচার্ডে কাজ করে রাতে আর কাউকে ফোন দিতে ইচ্ছে করে না।

: কাজটা খুব কঠিন, তাই না?

: জি, সাইদ ভাই। অনেক কঠিন। কিন্তু এখানকার অনেক বাঙালি দশ-পনেরো বছর ধরে এই কাজটা করছে। ওরা কীভাবে যে করে!

: করতে করতে অভ্যাস হয়ে যাবে।

: আমি এই কাজটা বেশি দিন করব না। এটাই লাস্ট সিজন। হ্যামিল্টন অথবা অকল্যান্ডে চলে যাব।

: ওখানে গিয়ে কী করবে?

: ওই তো, লেখাপড়ায় ঢুকব। কোনো একটা কোর্স করে জবে ঢুকব।

: আইডিয়াটা ভালো। তুমি অকল্যান্ড বা হ্যামিল্টন চলে গেলে আজমল স্যারের কী হবে?

জাহিদ এক মুহূর্ত থেমে কী ভেবে ভারী গলায় বলল, সাইদ ভাই, আমি এ জন্যই আপনাকে এখন ফোন দিয়েছি। স্যারকে আজ ইমিগ্রেশন অফিসার আর পুলিশ এসে কিউই ফ্রুটের অরচার্ড থেকে ধরে নিয়ে গেছে।

সাইদ আহমেদ ফোনের ওপাশে আঁতকে উঠলেন। বললেন, কী! কী যা-তা বলছ?

: আমি ঠিকই বলছি, সাইদ ভাই।

: কখন? কীভাবে?

: দুপুরের পর হঠাৎ করেই দুজন ইমিগ্রেশন অফিসার ও তিনজন পুলিশ কিউই ফ্রুটের অরচার্ডে এসে হাজির। স্যারকে ধরে নিয়ে যায়।

: তোমাদের অরচার্ডের আর কাউকে ধরেছে?

: না, স্যার বাদে আর কেউ এই অরচার্ডে অবৈধভাবে কাজ করছে না।

: তাহলে কী ওরা স্যারের খবর নিয়ে এসেছিল?

: আমার মনে হয় তাই।

: স্যারের এই খবরটা ইমিগ্রেশনে কে জানাল?

আমি জানি না। আশ্চর্য ব্যাপার কী, ইমিগ্রেশনে অফিসার আর পুলিশ অরচার্ডের আর কাউকে একটা প্রশ্নও করেনি। অরচার্ডে আমরা প্রায় বিশজন কাজ করছিলাম।

: স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ।

: ব্যাপার আসলেই স্ট্রেঞ্জ। ওরা এত মানুষের মধ্যে কিউই ফ্রুট অরচার্ডে শুধুমাত্র স্যারের লাইনটা চিনল কীভাবে? নিশ্চয়ই কেউ তখন বলে দিয়েছিল?

: আমারও তাই মনে হয়। সেখানে ওদের কোনো ইনফরমার ছিল।

: সাইদ ভাই, আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

: হ্যাঁ, জিজ্ঞেস কর। কী কথা?

: আপনি হেদায়েত ভাইকে কত দিন ধরে চেনেন?

: চিনি তো অনেক দিন ধরেই। নিউজিল্যান্ডে আসার পরপর এক সঙ্গে কাজ করেছিলাম। তবে খুব বেশি দিন নয়। আমি পরে হেস্টিংসে চলে আসি। সে তাওরাঙ্গাতেই থেকে যায়।

: কিছুদিন আগে যে হেদায়েত ভাইয়ের ওয়াইফ মারা গেছে, ওটা জানেন?

: হ্যাঁ, জানি তো। হেদায়েতের ওয়াইফ মারা যাওয়ার পর না তোমার সঙ্গে কথা হলো? হেদায়েতের সঙ্গেও পরে কথা হয়েছে। তার ওয়াইফ সুইসাইড করেছিল, তাই না?

: জি, সুইসাইড করেছিলেন।

সাইদ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ হেদায়েতকে নিয়ে এত কথা বলছ কেন? তোমার কি ধারণা সেই আজমল স্যারকে ধরিয়ে দিয়েছে?

জাহিদ বলল, আমি ঠিক জানি। আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে।

: আজমল স্যারকে ধরিয়ে দিয়ে তার লাভ কী?

: ওটাও আমি জানি না।

: শোনো, হেদায়েত সম্বন্ধে আমার খুব একটা ধারণা নেই। একটা সময় এক সঙ্গে কাজ করতাম, সেটা প্রায় এক যুগ আগে। তারপর অনেক দিন ধরে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। হেদায়েত সম্বন্ধে তোমার এই ধারণা হওয়ার কারণটা কী খুলে বলবে?

: জি বলছি। গত চার দিন আগে হেদায়েত ভাই এক রাতে আজমল স্যার সম্বন্ধে অনেক কথা বলে গেছেন। স্যারের অবৈধভাবে কাজ করা নিয়ে অনেক সতর্কবাণী করে গেছেন। চার দিন পরেই স্যার ধরা পড়েন।

: ওটা কাকতালীয় তো হতে পারে।

: তা হতে পারে। কিন্তু আজ?

: হেদায়েত আজ আবার কী করেছে?

: তিনি কিছু করেননি। আজমল স্যার ধরা পড়ার পর স্যারকে একটুও সাহায্য করছেন তো না-ই, বরং স্যারের টাকাগুলো খাওয়ার ধান্দা করছেন।

: সেটা কেমন?

: হেদায়েত ভাই এখানে কাজের প্রথম দিকের বেতনগুলো দিলেও গত সাত সপ্তাহ ধরে আজমল স্যারের কোনো বেতন দিচ্ছেন না। অথচ স্যারের গত সাত সপ্তাহে প্রায় আট হাজার ডলার ইনকাম করেছেন। পুরো আট হাজার ডলারই হেদায়েত ভাইয়ের কাছে আটকা।

: আটকা থাকলে এখন স্যার যেহেতু নেই, তুমি নিয়ে নিবে। স্যার বাংলাদেশ যাওয়ার পর টাকাটা পাঠিয়ে দেবে। স্যার তো ওখানে ভালোই কাজ করছেন।

: জি, স্যার কিউই ফ্রুটের উইন্টার প্রুনিংয়ের কাজটা বেশ ভালোই পারছিলেন। কিন্তু কথা সেটা না। হেদায়েত ভাই এখন বলছেন, স্যারের এই ধরা পড়ার কারণে তার নাকি লইয়ার ধরতে হবে। অ্যাকাউন্ট্যান্টের সঙ্গে বসতে হবে। এতে নাকি তার অনেক টাকাপয়সা খরচ হবে। তিনি তাই স্যারের টাকাটা দেবেন না। স্যারের আট হাজার ডলার লইয়ার ও অ্যাকাউন্ট্যান্টের পেছনে খরচ করবেন?

সাইদ আহমেদ ফোনের ওপাশে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তারপর আস্তে করে বললেন, হেদায়েত আর পরিবর্তন হলো না। টাকার জন্য এখনো ছ্যাবলামি করে। আচ্ছা জাহিদ, তুমি এ ব্যাপারে চিন্তা কর না। হেদায়েতের কাছ থেকে আজমল স্যারের টাকাটা কীভাবে নিতে হবে সেটা আমি জানি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে না, হেদায়েত আজমল স্যারকে ইমিগ্রেশনে ধরিয়ে দেওয়ার মতো এত নিচু কাজ করতে পারবে।

জাহিদ বলল, আমি তাও জানি না। আমার মাথায় কোনো কিছু কাজ করছে না। এখানে আপনিও নেই যে স্যারের এই সমস্যাটা নিয়ে আপনার সাহায্য নেব। হেদায়েত ভাই তো স্যারের এই ব্যাপারটা নিয়ে কাছেই ভিড়তে চাচ্ছেন না। কেমন দূরে দূরে থাকছেন। দূরে থেকে বাড়তি আরও টেনশন দিচ্ছেন।

জাহিদ বাসায় ফিরে এল। বাসায় ঢুকে কাজের কাপড়চোপড় ছেড়ে প্রথমেই গোসলটা সেরে নিল। বাথরুম থেকে বের হতেই তার পেটের ক্ষুধাটা কেন জানি বেশ জানান দিয়ে উঠল। কিন্তু তার এ মুহূর্তে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রিজে কন্টেইনারে অনেক খাবার আছে। গত রাতেই আজমল হোসেন ও সে মিলে পুরো সপ্তাহের রান্না করে কন্টেইনারে ভরে রেখেছে।

জাহিদ কিছু না খেয়ে আগে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। কিন্তু সে তৈরি হয়েই বাইরে যাওয়ার আগে বেডরুমে গিয়ে ঢুকল। তাদের বেডরুমটা তুলনামূলক ছোট। বেডরুমের দুই পাশে তাদের দুটো বেড। রুমের বামপাশের বেডটা আজমল হোসেনের।

রুমের পশ্চিমে দরজার পাশে জাহিদের বেড হলেও, জাহিদ সাধারণত লাউঞ্জেই ঘুমায়। তাই বেডটা এমনিই পড়ে আছে। জাহিদ আজমল হোসেনের বেডে গিয়ে বসল। বেডের পাশে একটা বড় লাগেজ। আজমল হোসেন বাংলাদেশ থেকে আসার সময় যে লাগেজটা নিয়ে এসেছিলেন, ওটাই।

যেকোনো কারণেই হোক আজমল হোসেনের সেই লাগেজের লকটা খোলা। হয়তো লাগেজে তেমন বিশেষ কিছু নেই বলে তিনি লক করে রাখেননি বা তিনি লক করতে ভুলে গেছেন। আর নয়তো জাহিদকে লাগেজের তালা ভাঙতে হতো।

শেক্‌সপিয়ারের বাংলা অনুবাদ সমগ্রটা লাগেজটার ওপর। জাহিদ সেই বইটা সরিয়ে বেডে বসেই উপুড় হয়ে লাগেজটা খুলল। লাগেজ খুলে প্রথম শার্টটার ভাঁজেই বেশ অনেকগুলো ডলার পেল। দ্বিতীয় শার্টের ভাঁজেও সে খুচরা আরও কতগুলো ডলার পেল। এ ছাড়া লাগেজের পকেটে বাংলাদেশি পাসপোর্ট। পাসপোর্টে মেয়াদ উত্তীর্ণ নিউজিল্যান্ডের ভিসা। আর কিছু ব্যাংক কার্ড। একটা পুরোনো মোবাইল। কয়েকটা টেলিফোন কার্ড। দুটো জামার বোতাম। একটা পুরোনো ছবির অ্যালবাম।

জাহিদ একে একে আজমল হোসেনের সবগুলো শার্ট ও প্যান্টের ভাঁজ খুলে খুলে দেখল। দুটো শার্টের ভাঁজ বাদে অন্য কোনো শার্ট বা প্যান্টের ভাঁজে আর কোনো ডলার বা খুচরা টাকাপয়সা পেল না। সে আজমল হোসেনের শার্ট-প্যান্টগুলো যথাস্থানে রেখে লাগেজের চেইন টেনে দিল। তারপর টান টান হয়ে বসে ডলারগুলো গুনতে শুরু করল। গোনা শেষে দেখল, সব মিলিয়ে মাত্র আটশো সাতান্ন ডলার আছে।

জাহিদ ডলারগুলো নিজের প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে ভাবল, এখন হেদায়েত হোসেনের কাছ থেকে স্যারের আট হাজার ডলার উদ্ধার করতে পারলেই হয়। প্রয়োজনে সে নিজের কাছ থেকে আরও কিছু ডলার যোগ করে স্যারের জন্য হাজার দশেক ডলার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে।

জাহিদ আর দেরি না করে তাওরাঙ্গা পুলিশ স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হলো। এদিকে বেশ আগেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাওরাঙ্গা পুলিশ স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নেমে এল।

কিন্তু তাওরাঙ্গা পুলিশ স্টেশনে এসে জাহিদ শুনল, আজমল হোসেনকে তাওরাঙ্গা পুলিশ স্টেশনে নয়, হ্যামিল্টন পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেছে। বে অব প্ল্যানটি ও ওয়াইকাটো অঞ্চলের ইমিগ্রেশন অফিস হ্যামিল্টন শহরে। আজমল হোসেনকে এ জন্যই হ্যামিল্টন পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন