সান্তা ক্লজের দেশে বাঙালির বড়দিন!

কানাডার টরন্টোয় সান্তা ক্লজ প্যারেডের মধ্য দিয়ে বড়দিন উৎসবের সূচনা হয় নভেম্বরের তৃতীয় রোববার
কানাডার টরন্টোয় সান্তা ক্লজ প্যারেডের মধ্য দিয়ে বড়দিন উৎসবের সূচনা হয় নভেম্বরের তৃতীয় রোববার

আজ পবিত্র বড়দিন। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ঐতিহ্যগত পার্থক্যের কারণে বড়দিন উৎসব পালনের রূপও হয় ভিন্নতর।

কানাডার টরন্টোয় মূলত সান্তা ক্লজ প্যারেডের মধ্য দিয়ে বড়দিন উৎসবের সূচনা হয় নভেম্বরের তৃতীয় রোববার। তিন ঘণ্টার এই প্যারেড গত ১১৪ বৎসরের ইতিহাসে এবার ছিল সর্ববৃহৎ। কানাডার নোনাভুট প্রদেশ থেকে আট শ বিশ কিলোমিটার দূরত্বে নর্থপুলে ইতিহাসের কাল্পনিক চরিত্র সান্তা ক্লজের বাস। ২০১৯ সাল থেকে অফিশিয়ালি সান্তা ক্লজকে কানাডীয় হিসেবে গণ্য করা হবে।

রাস্তার দুই পাশে হাজার-হাজার শিশুরা ঠান্ডা উপেক্ষা করে ব্যাকুল প্রতীক্ষা থাকে কখন আসবে সান্তা। শত শত ড্যান্সার, ক্লাউন আর একুশটি ব্যান্ড মার্চ করে সান্তাকে নিয়ে আসে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে। তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস কচিকাঁচাদের চোখে। আনন্দ গড়াগড়ি যায় রাজপথে। কানাডা পোস্টের ভলান্টিয়ার মার্চ করতে করতে এগিয়ে আসে বাচ্চাদের কাছে। আর বাচ্চারা সান্তার কাছে নিজের হাতের লেখা তাদের ইচ্ছার কথা পোস্ট বক্সের ভেতরে ফেলে। তাদের বিশ্বাস, সান্তা তাদের জন্য ভালোবাসার বার্তা আর উপহার নিয়ে আসবেন। সান্তা তাদের আশা অপূর্ণ রাখেন না। ঠিক যেমন এবার সান্তা ক্লজের কস্টিউমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বরাক ওবামা। কাঁধে উপহারের ঝুলি নিয়ে ছুটে গেছেন হাসপাতালে অসুস্থ শিশুদের মাঝে, হাসি ফুটিয়েছেন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মুখে। যা ছিল মানবিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠ বার্তা।

প্যারেডে যখন কোমলমতি প্রাণেরা পোস্ট বক্সে সান্তাকে লেখা চিঠি ফেলছিল, অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখলাম, বিশ্বাসের ঠিকানায় আজও মানুষ চিঠি পাঠায়।

সান্তা ক্লজ
সান্তা ক্লজ

এর পরদিন থেকেই বর্ণিল সাজে সেজে ওঠে শহর। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় ক্রিসমাস ট্রি। ব্যস্ত জীবনের আরও ব্যস্ততর হয়ে ওঠে শপিং মলে প্রিয়জনের জন্য কেনাকাটার ধুম। এই সময়টাকে বলা হয় হলিডে সিজন। নিজের সঙ্গে ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সিজন।

কানাডীয়রা বিশ্বাস করে বৎসরের এই সময়টায় নেও কম, দেওয়াতে উজাড় কর নিজেকে। ‘নিজেকে তুই বিলিয়ে দে আজ আসমানি তাগিদ’—শুধু গানে কবিতায় না, তাদের আচরণেও তা দেখা যায়।

ছিয়াশি হাজার চ্যারিটি সংস্থা কানাডা জুড়ে দান সংগ্রহ করে এবং তা বিলি করে নিম্নআয় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে। শুকনো খাবার দিয়ে, খেলনা দিয়ে অথবা নিজের স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যে যার জায়গা থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

নিজের কাজের জায়গার কথা বলি। প্রতিবছর স্কারবোরতে একটি স্কুলে দুই শ ছাত্রছাত্রীর জন্য পার্ক হায়াত টরন্টো টার্কি ডিনারের আয়োজন করে ক্রিসমাস উপলক্ষে। কীভাবে সম্ভব হয়? প্রতিবছর পার্ক হায়াত টার্কি বিলি করে কর্মচারীদের মাঝে। অপশন দেওয়া থাকে, আমরা নিজেদের জন্য নিতে পারি কিংবা স্কুলের বাচ্চাদের ডিনারের জন্য দান করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমার দেখা ৯০ ভাগ কর্মচারী টার্কি দান করে। ফান পার্টটি হলো আমরা যারা এই কাজটিতে স্বেচ্ছাশ্রম দিই; মিলিয়ে যাই লাল-নীল ফোয়ারার মতো শিশুদের কলকণ্ঠের কাকলিতে। যারা কুকের কাজ করেন তারা ওই দিনের রুটিরুজিকে ব্যয় করেন সেই সব শিশুদের মাঝে। তারপর আমরা সে খাবার নিয়ে যাই স্কুলে। আমরা যারা সার্ভার কিংবা ফ্রন্ট অফিসে কাজ করি; সবাই মিলে বাচ্চাদের সার্ভ করি। খাবার টেবিলে যাওয়ার আগে থাকে টরন্টোর এক নামী ব্যান্ডের পরিবেশনা। শুধু এই বাচ্চাগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে ওই দিনে তারা কোনো ইভেন্ট রাখে না।

ক্রিসমাস উপলক্ষে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য পার্ক হায়াত টরন্টোর টার্কি ডিনারের আয়োজন
ক্রিসমাস উপলক্ষে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য পার্ক হায়াত টরন্টোর টার্কি ডিনারের আয়োজন

আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কানাডাতে যে যেখানেই কাজ করেন না কেন, প্রত্যেকের কাছে হলিডে সিজনের এমন মানবিক গল্প স্মৃতিতে ধরে আছেন।

পৃথিবীতে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠাই যিশু খ্রিষ্টের জীবনের মহান ব্রত ছিল। যিশু অনাহারক্লিষ্ট দুঃখী, নির্যাতিত ও গরিব মানুষের জীবনে শান্তি স্থাপন ও বিশ্বময় শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। একই সুরে খুঁজে পাই বিবেকানন্দকে—‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।

খ্রিষ্টানদের প্রধান উৎসব হলেও, বর্তমান আধুনিক বিশ্বে প্রতিবছর বড়দিন ফিরে আসে সবার মাঝে ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, উদারতা ও কৃতজ্ঞতা—এই সব মানবিক গুণাবলির প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

অভিবাসী জীবনে অন্যকে আনন্দ দিয়ে, নিজে আনন্দ পাওয়ার মানসে, গত বছরের মতো এবারেও বড়দিনের উৎসব আয়োজন করেছেন, আমাদের সাংস্কৃতিক সুহৃদ বন্ধুবর বড় ভাই রনি মজুমদার ও তাঁর সহধর্মিণী প্রিয় বৌদি রিক্তা মজুমদার। রনিদার ছোট ভাই ছনি দা আর মাকে নিয়ে, যারা বাস করেন টরন্টো থেকে ৪৫ মিনিট ড্রাইভিংয়ের দূরত্বে পিকারিং শহরে। বড়দিন উপলক্ষে আমরা জনা পঞ্চাশেক মানুষ সমবেত হয়েছিলাম। অতিথি আপ্যায়নে দাদা-বৌদির আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়েছি আনন্দের পরতে-পরতে।

মাসিমার নির্মল হাসিতে চার্চের স্নিগ্ধতা দিয়েছে ঘর জুড়ে। তাঁর সরল হাসি, আমাকে পড়িয়েছে প্রভু যিশুর কথা ‘যারা আনন্দ করে, তাদের সঙ্গে আনন্দিত হও; যারা কাঁদে, তাদের সঙ্গে কাঁদো’।

বড়দিন উপলক্ষে ঘরোয়া আয়োজন
বড়দিন উপলক্ষে ঘরোয়া আয়োজন

এত আনন্দ আয়োজনের এক ফাঁকে বসেছিলাম মাসিমাকে নিয়ে। জানতে চাইলাম কেমন কাটে বড়দিন এই সান্তা ক্লজের দেশে? সরলতায় ভরা উত্তর করেন মমতাময়ী, ‘আনন্দতো এখানে অনেক বেশি। উচ্ছ্বাসে ভরায়। আর নিজের জন্মভূমিতে বড়দিনের আনন্দে প্রাণটা জুড়ায়’।

ছেলে, ছেলের বউ ও দুই নাতনিদের নিয়ে, বাসযোগ্য পৃথিবীর উন্নত দেশে থেকেও নিজের শিকড়ের টান পড়ে। টান পরে নবাবগঞ্জের মাটির; আর হাসনাবাজের মিশনারি চার্চ, যেখানে মমতাময়ীর নাতা আছে পোঁতা।

বড়দিনের এই উৎসবে শুভকামনা কাছের, দূরের, সকল মত-পথের মানুষদের। জয় হোক বিশ্ব মানবতার, সুদৃঢ় হোক বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: সাংস্কৃতিক কর্মী।