পরিবারের বাইরে, পরিবারের সঙ্গে

প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে থাকে বারবিকিউ পার্টি
প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে থাকে বারবিকিউ পার্টি

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মনটা বেশ খারাপ। এক সময়ে উপকার করেছি এমন কিছু মানুষেরাই কিছুদিন আগে কষ্ট দিয়ে গেল। ভাবছিলাম আমরা এমন কেন? মানুষের সঙ্গে ভালো থাকা কি এতই কঠিন! তখন মনে হলো সবাইতো এমন না। জীবনে অনেক মানুষের সাহচর্য পেয়েছি যারা না চাইতেই অনেক সহযোগিতা করেছেন। আজকে লিখব এমন কিছু মানুষকে নিয়ে, যারা নিঃশর্তে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যান।

স্নাতকোত্তর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে এসেছি ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যানকুভার ক্যাম্পাসে। ছোট এই ক্যাম্পাসে এর আগে বাংলাদেশের কোনো ছাত্র আসেননি। আমরা তিনজন প্রথমবারের মতো আসি। ক্যাম্পাসের আশপাশে বাংলাদেশি কোনো পরিবার নেই। প্রায় বিশ মাইল দূরে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার বাস করেন। আসার পরে প্রাথমিক সহযোগিতা তাদের কাছে পেয়েছিলাম। পরিচিত গণ্ডির বাইরে এসে শুরুতে বিশাল শূন্যতা আর হাহাকার ছিল আমাদের মনে। সঙ্গে ছিল দেশে ফেলা আসা জীবন, পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময় নিয়ে স্মৃতিকাতরতা। রাস্তায় হাঁটলে মানুষজন খুব একটা দেখা যায় না। আবার টুকটাক দেখা গেলেও সবাই অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক। কিছুদিন পর একজন একজন করে পরিচিত হতে শুরু করার পর দেখলাম আসলে ব্যাপারটা তেমন না। আমেরিকানরা বেশ ভালোই মিশুক যদি একবার কথা শুরু হয়। সবাই বেশ হাসি খুশি আর প্রাণবন্ত থাকেন সব সময়।

লিসা ও মাইকেলের বাসায় ডিনারে লেখক ও তার বন্ধু
লিসা ও মাইকেলের বাসায় ডিনারে লেখক ও তার বন্ধু

প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমাকে আর বন্ধু সায়েমকে এখানকার স্থানীয় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ফোনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে নেন তিনি। ভদ্রমহিলার নাম লিসা। আমাদের নিয়ে যান আশপাশের গ্রোসারি স্টোরে। পরিচয় করিয়ে দেন কোন স্টোর কোন জিনিসের জন্য ভালো আর কোথায় গেলে ছাত্ররা কম খরচে কেনাকাটা করতে পারবে। টুকটাক কিছু কেনাকাটা শেষে ওই দিন রাতেই ওনার বাসায় ডিনারের দাওয়াত দিয়ে বসেন। অচেনা কারও বাসায় দাওয়াত পেয়ে একটু ইতস্তত বোধ করলেও আমরা রাজি হয়ে গেলাম। গাড়ি থেকে থামতেই লিসার স্বামী মাইকেল আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক পেশায় ডাক্তার, বয়স আনুমানিক ষাটোর্ধ্ব হলেও দেখতে বেশ টগবগে তরুণ। কথাবার্তায় এত বেশি আন্তরিক হবেন আমরা আশাই করতে পারিনি।

ফল হারভেস্ট পার্টিতে ফ্রেন্ডশিপ ফ্যামিলির সঙ্গে আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীরা
ফল হারভেস্ট পার্টিতে ফ্রেন্ডশিপ ফ্যামিলির সঙ্গে আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীরা

কথায় কথায় জানতে পারলাম এই দম্পতির এক মেয়েও পেশায় ডাক্তার এবং মিশনারির কাজে বাংলাদেশে গিয়ে এক মাস চিকিৎসা সেবাও দিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তাঁরা বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন। বাসায় প্রবেশ করা মাত্রই নাশতা হিসেবে দিলেন কাঁচা গাজর আর কাঁচা শিম। নাশতার ধরন একটু অন্যরকম হলেও তাঁদের আতিথেয়তা দেখে খুবই ভালো লাগল। আমাদের নাশতা দিয়ে লিসা ও মাইকেল দুজনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন ব্রকলি সেদ্ধ আর পাউরুটি গরম করতে। সঙ্গে গরম করা হলো স্টোর থেকে নিয়ে আসা প্রস্তুতকৃত গ্রিল চিকেন। সিদ্ধ সবজি খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও চিলি সস আর সঙ্গে গ্রিল নিয়ে খেতে বেশ ভালোই লাগল। খেতে খেতে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলাম আমরা আগ্রহ নিয়ে। ভদ্রমহিলা ভারতীয় খাবার পছন্দ করেন। জানতেন আমরা ঝাল বেশি খাই। আগ্রহ নিয়ে আমাদের চিলি সস বারবার নেওয়া দেখছিলেন। আসার সময় চিলি সসের গোটা বয়াম আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন, সঙ্গে দিলেন পুরো একটা গ্রিল চিকেন। আমরা বাংলাদেশিরা ভাবতাম আতিথেয়তায় আমরাই সবার ওপরে, এখানে এসে দেখলাম পশ্চিমা বিশ্বেও আছে এই ব্যাপারটা।

ক্রিসমাস পার্টি। এই পার্টিতে থাকে ছোট ছোট উপহার সামগ্রী আদান প্রদানের ব্যবস্থা
ক্রিসমাস পার্টি। এই পার্টিতে থাকে ছোট ছোট উপহার সামগ্রী আদান প্রদানের ব্যবস্থা

পরদিন তিনি আমাদের নিয়ে যান গুডউইল নামক স্টোরে। যেখানে পুরোনো আসবাবপত্র কম খরচে কিনতে পাওয়া যায়। এরপর কয়েক দিন ধরে আমরা বিভিন্ন আসবাবপত্র কিনতাম আর লিসা তার গাড়িতে করে বাসায় দিয়ে যেতেন। একটু ভারী জিনিস কিনে যখন টেনশন করছিলাম তখন দেখি আরেক ভদ্রলোক এসে হাজির ট্রাক নিয়ে। লিসার বন্ধু মার্ক। শুধু তাই না, মার্ক তাদের গির্জা থেকে অব্যবহৃত সোফা সেট, চেয়ার ও কিছু ল্যাম্পও দিয়ে গেলেন। আরেক দিন দরজায় নক পেয়ে দরজা খুলে দেখি এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। বললেন, লিসার কাছে শুনলাম তোমরা এই শহরে নতুন এসেছ। আমার মা অন্য শহরে চলে যাচ্ছেন, কিছু কিচেন সামগ্রী নিয়ে এসেছি তাঁর কাছ থেকে। তোমাদের যা যা লাগবে নিয়ে নাও।

টাইলার-লিডিয়া পরিবারের সঙ্গে থ্যাংকস গিভিং ডে উদ্‌যাপন। এই দিবসে কুমড়োর গায়ে বিভিন্ন প্রতিকৃতি খোদাই করে ভেতরে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়। এ বছর লেখকেরা খোদাই করেন মানুষের মুখাবয়ব, জাহাজ ও শহীদ মিনার
টাইলার-লিডিয়া পরিবারের সঙ্গে থ্যাংকস গিভিং ডে উদ্‌যাপন। এই দিবসে কুমড়োর গায়ে বিভিন্ন প্রতিকৃতি খোদাই করে ভেতরে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়। এ বছর লেখকেরা খোদাই করেন মানুষের মুখাবয়ব, জাহাজ ও শহীদ মিনার

আমেরিকা আসার আগে এখানকার মানুষদের সম্পর্কে যে রকম ধারণা ছিল এসে দেখলাম পুরো উল্টো। পরে জানলাম, এই সেবাপরায়ণ মানুষগুলো ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ইনকরপোরেট (আইএসআই) নামের একটি অলাভজনক সংস্থার ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে থাকেন। নিজেদের অবসর সময়কে মানবহিতৈষী কাজে ব্যয় করারই একটি ধাপ আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করা। এই সংস্থার অধীনে আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী আর বন্ধুভাবাপন্ন স্থানীয় পরিবারদের নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন পার্টি আয়োজন করা হয়—ফল–হারভেস্ট পার্টি, বারবিকিউ পার্টি, থ্যাংকস গিভিং ডে, ক্রিসমাস পার্টি ইত্যাদি। একেকবার একেক পরিবার আয়োজনের দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। আবার যারা যারা যোগদান করেন তারাও কিছু না কিছু রান্না করে বা কিনে নিয়ে যান। আমরা তো বাংলাদেশি খাবার রীতিমতো জনপ্রিয় করে তুলেছি সবার মাঝে। খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডার সঙ্গে থাকে মজার মজার গেম শো। আবার বিশেষ বিশেষ দিবসে থাকে স্বল্প বাজেটে উপহার সামগ্রী আদান প্রদানের আয়োজনও। গল্পে জল্পে বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে জানার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দেশকে উপস্থাপনেরও এ এক অনন্য সুযোগ।

ভ্যানকুভার লেকে টাইলার ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ছুটির দিন উদ্‌যাপন
ভ্যানকুভার লেকে টাইলার ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ছুটির দিন উদ্‌যাপন

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীকেই আইএসআই–এর পক্ষ থেকে একটা পরিবারের সঙ্গে সংযোগ করে দেওয়া হয়। আমরা বলি ফ্রেন্ডশিপ ফ্যামিলি। দেশের বাইরে যেন পরিবারকে মিস না করি তার জন্য এই ব্যবস্থা। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের ফ্রেন্ডশিপ ফ্যামিলি করা হয় টাইলার-লিডিয়া পরিবারকে। এলি, ম্যাবেল আর সিমিওন নামের ফুটফুটে তিনটা বাচ্চা নিয়ে তাদের সুখের সংসার। বিভিন্ন দিবসে তাদের বাসায় দাওয়াত দেন আমাদের, আবার আমরাও দিই মাঝে মাঝে। আমাদের খিচুড়ি খেয়ে মুগ্ধ হয়ে তারা এখন নিজেরাই বাসায় রান্না শুরু করেছেন। গল্প করতে করতে আমরা যেমন তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানি, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতেও তাদের অনেক আগ্রহ। তাদের বাচ্চারাও এখন আসসালামু আলাইকুম, নমস্কার বলে কুশল বিনিময় করতে পারে। মাঝে মাঝে এই পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে যাই ভ্যানকুভার লেক, ফার্মারস মার্কেট বা পাম্পকিন প্যাচে। ভিনদেশে এমন একটা পরিবারের সঙ্গে থেকে কিছুটা হলেও পরিবারকে মিস করার ব্যাপারটা ভোলা যায়।

লেখক
লেখক

শেষ করব লিসার কথা দিয়ে। একদিন লিসাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে তুমি আমাদের এত উপকার করছ নিজের সময় ব্যয় করে, সেটা কেন। লিসার উত্তর—‘আজ আমি তোমাদের উপকার করছি। কোনো দিন কোনো এক জায়গায় আমার সন্তানদেরও কেউ উপকার করবে।’

সত্যিই তো। কখনো কী এভাবে ভেবেছি!

হাশেম মোহাম্মদ: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ও গবেষণা সহকারী, ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।