বিকেলের নিস্তব্ধতা চারদিকে। ম্যাপল ও ওক গাছের ফাঁক গলে পড়ন্ত বিকেলের রোদ পড়ছে কেমন তেরসা ও ফালি ফালি হয়ে। দক্ষিণের মৃদুমন্দ বাতাস বইছে হিন হিন, হিন হিন। বাতাসে নদীর কপালের কাছের খোলা চুলগুলো উড়ছে কেমন ধোঁয়ার ঢেউ খেলে। যেন সরু সরু ধোঁয়া।
রাকিবের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, নদী এত সুন্দর করে সাজতে পারে। রাকিব শুধু একদিন বলেছিল, তার টিয়ে রঙের সবুজ শাড়ি আর খয়েরি রঙের লিপস্টিক পছন্দ। এতেই নদী তার জন্য এমন করে সেজে আসবে, এটা সে এভাবে ভাবতে পারেনি। এখনো রাকিব কিছুক্ষণ পরপর মুগ্ধ হয়ে নদীর দিকে তাকাচ্ছে।
ওদের দুজনের হাতেই কফির কাপ। বসন্তের পড়ন্ত বিকেল বলে একটু একটু ঠান্ডা পড়ছে। তাদের কাপের গরম কফি থেকে সরু সরু ধোঁয়া উঠছে সেই হিন হিন বাতাস ও পড়ন্ত বিকেলের মৃদু ঠান্ডাকে ভেদ করে। ওরা থেমে থেমে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে।
ওরা ব্যালকনিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। নদী কিছুটা অন্যমনস্ক। কিছু একটা ভাবছে। কফির কাপেও নদী চুমুক দিচ্ছে একটু অন্যমনস্কভাবে।
রাকিব ডাকল, নদী।
নদী বলল, জি।
: তুমি কী ভাবছ?
: নাহ, তেমন কিছু ভাবছি না।
: তুমি কিছু একটা যে ভাবছ তা আমি বুঝতে পারছি।
নদী হেসে ফেলল। বলল, আসলেই আমি কিছু একটা ভাবছি।
রাকিব জিজ্ঞেস করল, কী সেটা?
: আমি মার কথা ভাবছি। মা কলেজ থেকে ফিরলে আর আমি বুয়েট থেকে ক্লাস করে এলে মা ও আমি আমাদের বাসার জানালার দাঁড়িয়ে বিকেলের চা খেতাম। মা কলেজের গল্প করতেন। আমি আমার ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের গল্প করতাম। মাঝেমধ্যে মা গান গাইতেন। নিজের কবিতা আবৃত্তি করতেন। আমি শুনতাম। আমার গানের গলা ভালো না তো, তাই মাঝেমধ্যে ফ্যাসফেসে গলায় মার কবিতা আবৃত্তি করতাম। কিন্তু মা আমার ফ্যাসফেসে গলার কবিতা আবৃত্তি খুব মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। আমাদের ছোট্ট বাসায় সেই জানালাটাকে মনে হতো যেন একটা স্বর্গের জানালা। আজ আপনার পাশে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে তাই মনে হচ্ছে।
: এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তোমার কফি খেতে ভালো লাগছে?
: অনেক ভালো লাগছে।
: আমারও বিকেলের এই সময়টায় এখানে দাঁড়িয়ে কফি খেতে ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগা নয়, খুবই ভালো লাগে। তবে একটা মজার ব্যাপার, ব্যালকনির এক স্থানটা কিন্তু আগে তেমন আমাকে টানত না। তোমার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে টানে। আজকাল তো একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অফিস থেকে ফিরেই আমি কোথাও না গেলে কফি কাপ হাতে বিকেলটা এখানে কাটাই। একাকী মুহূর্তগুলোও আমার এখানে কাটাতে বেশ ভালো লাগে। একাকী অনেক কথা ভাবি।
নদী জিজ্ঞেস করল, আমার কথা ভাবেন?
রাকিব নরম হাসল। বলল, নদী, তুমি আমার সংস্পর্শে আসার পর অনেক কবিতা লিখছি। প্রতিদিন নতুন নতুন কবিতা। তোমাকে নিয়ে ভাবব নাতো কাকে নিয়ে ভাবব?
নদী কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমি জানি। যার কবিতা লেখা ধ্যান, তার কবিতার মানসীও ধ্যান...!
রাকিব বলল, বাহ, তুমি বেশ সুন্দর কথা বলেছ তো! তুমি এত সুন্দর কথা শিখেছ কোথা থেকে?
নদী চোখ বড় করে বলল, দেখুন, যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করলেও আমি একজন কবির মেয়ে। আরেকজন কবির...!
রাকিব জিজ্ঞেস করল, আরেকজন কবির কী?
নদী জবাব না দিয়ে মৃদু হেসে দৃষ্টি নামিয়ে নিল।
রাকিব বলল, নদী, থ্যাংক ইউ।
নদী জিজ্ঞেস করল, থ্যাংক ইউ কেন?
: তুমি আজ এই বিকেলে আমার জন্য আমার পছন্দের শাড়িটা পরে এসেছ যে।
: সত্যি করে বলেন, শাড়িটা আমাকে মানিয়েছে তো?
: পরি লাগছে। পরির রাজকন্যার মতো লাগছে। কপালে সবুজ টিপ, চোখে কাজলের টান, ঠোঁটে খয়েরি লিপস্টিক...!
: আপনার এম্যারল্ডের সেটটা শাড়ির সঙ্গে মানিয়েছে না?
: দারুণ মানিয়েছে। আচ্ছা, হাতের এই সবুজ কাচের চুড়িগুলো কি তোমার আগে থেকেই ছিল?
: নাহ, আমার কাচের চুড়ি থাকবে কোথা থেকে?
: তাহলে?
: এগুলো আমি শিমুল ভাবির কাছ থেকে নিয়েছি।
: এত কিছু তুমি আমার পছন্দের জন্য করেছ?
নদী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ!
রাকিবও মাথা ঝাঁকাল। এক মুহূর্তের জন্য কী যেন ভাবল। তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, নদী, তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?
: হ্যাঁ, করুন।
: আমি কি তোমার পিঠে একটু হাত রাখতে পারি?
নদী এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গিয়ে দৃষ্টির ওঠানামা করল। একবার দূরেও তাকাল। ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট ধরে দূরে তাকিয়ে সারি সারি ম্যাপল ও ওক গাছগুলো দেখল। বিকেলটা প্রায় পড়ে এসেছে। গাছে গাছে পাখি ডাকতে শুরু করেছে। পাখিদের নীড়ে ফেরার ডাক।
রাকিব তাড়াতাড়ি বলল, সরি, আমি মনে হয় একটু বেশিই অনুরোধ করে ফেলেছি।
নদী রাকিবের দিকে সরাসরি দৃষ্টিতে তাকাল। এ মানুষটা সহজে কিছু চান না। বরং সে নিজেই অনেকবার অনেক কিছু চেয়েছে। কখনো হাত ধরা। কখনো বাহু ধরে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটা। কখনো শরীরে শরীর ঘেঁষে বসা...! আজ মানুষটা নিজ থেকে পিঠে একটু হাত দিতে চাচ্ছেন...!
নদী রাকিব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, আপনি আমার পিঠে হাত রাখুন প্লিজ।
রাকিব কী ভেবে তারপরও দ্বিধা করতে শুরু করল।
নদী এবার রাকিবের গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। একটু কাঁপা গলায় বলল, প্লিজ, আপনি আমার পিঠে হাত রাখুন। আমি খুব খুশি হব।
রাকিব এবার নদীর পিঠে হাত রাখল।
নদী সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অবলম্বনহীন মাথাটা রাকিবের কাঁধে এলিয়ে দিল। (শেষ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>
ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: